ফের চাঙ্গা অবৈধ ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) ব্যবসা। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করা এ অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা যাচ্ছে না সরকারি কোনো পদক্ষেপেই। র্যাবের অভিযান চলাকালে অবৈধ কারবারিরা কিছুদিনের জন্যে সতর্ক অবস্থান নিলেও হালে তারা আবারও সক্রিয়। বরং আগের চেয়ে ব্যবসার ব্যাপকতা বেড়েছে। চলছে মহা লুটপাট।
অবৈধ এ ব্যবসা সংক্রান্ত দায়ের করা অর্ধশতাধিক মামলায় গ্রেফতারকৃতদের কেউই আর আটক নেই। প্রত্যেকেই জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, অবৈধ ব্যবসায় প্রভাবশালীরা সরাসরি জড়িত। এ কারণে কোনো ভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, টেলিকম মন্ত্রণালয়, রেগুলেটরি সংস্থা বিটিআরসির কতিপয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন ধরেই অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিগত পাঁচ বছরে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার এই সিন্ডিকেট লুটে নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বৈধপথে দিনে কলের পরিমাণ তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মিনিট। দুই বছর আগে ছিল ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি মিনিট। অর্ধেকের বেশি কল চলে যাচ্ছে অবৈধ পথে। এ বিপুলসংখ্যক অবৈধ কল অবৈধভাবে ট্রান্সফার থেকে সরকার বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মধ্যে এর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। হাতে নাতে গ্রেফতার হন ভিওআইপি ব্যবসার কর্মচারীরা। প্রভাবশালীরা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আটক কর্মচারীদেরও বেশি দিন থাকতে হচ্ছে না কারাগারে। পুলিশ সূত্র জানায়, এসব মামলায় অপরাধের ধরন গুরুতর হলেও ধারা জামিনযোগ্য রাখা হয়েছে।
আইনের এই দুর্বলতার কারণে আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যান। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, র্যাব সব সময় অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে কাজ করছে নিয়মিত। যেখান থেকেই তথ্য আসছে, সেখানেই র্যাব অভিযান চালাচ্ছে। তিনি বলেন, অবৈধ এই ব্যবসার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। দেশ পঙ্গু করা এসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভিওআইপি ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
কর্নেল জিয়া বলেন, সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়। কর্মচারীরাও হন গ্রেফতার। কিন্তু মামলায় কোনো আসামির সাজা হচ্ছে না। জানা গেছে, বিগত মহাজোট সরকার এ খাতের লুটপাট বন্ধ করতে পারেনি। বরং অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রছায়ায় থেকে দেশি-বিদেশি অবৈধ ভিওআইপি কারবারিদের সিন্ডিকেট এর ব্যাপকতা বাড়ে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা একের পর এক ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডবি্লউ)-এর লাইসেন্স নিয়ে জড়িয়ে পড়েন ভিওআইপির মাধ্যমে অবৈধ কল টার্মিনেশনে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য এবং টেলিকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনে গত পাঁচ বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। আর কল চুরি থেকে গত পাঁচ বছরে অবৈধ আন্তর্জাতিক কল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আয় হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে বিগত মহাজোট সরকারকে। এবার এই অবৈধ ব্যবসা রোধে বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। অবৈধ ভিওআইপির কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। এদিকে দিনের পর দিন অবৈধ ভিওআইপি কারবারিদের কার্যক্রম বাড়লেও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত যন্ত্রপাতি, প্রতিরোধ টিম, র্যাব এর মাধ্যমে সরঞ্জামাদি উদ্ধার-এটুকুর মধ্যে সীমিত ছিল ভিওআইপি বিরোধী অভিযান। অথচ অবৈধ কল টার্মিনেশনে জড়িতরা বরাবরই থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় এই হাইটেক ব্যবসা গোপনে চললেও এখন তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। মাঝে মধ্যে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান চালালেও তাতে কোনো ফল হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, খোদ বেড়াই সাবড়ে নিচ্ছে খেতের ফসল। সংস্থাটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার মদদে রাঘববোয়ালরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এই অবৈধ বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব হানা দিয়েও দমন করতে পারছে না এই শক্তিশালী চক্রকে।
দেশের টেলকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অবৈধ ভিওআইপি রোধ করতে না পারার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এ খাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া। আর বেশিরভাগ লাইসেন্স হাতিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বজনরা। আগে দেশে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান করত মাত্র চারটি আইজিডবি্লউ প্রতিষ্ঠান। বিগত মহাজোট সরকার এ খাতে ব্যবসার জন্য আরও ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। এতে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে এই ২৯টি আইজিডবি্লউ প্রতিষ্ঠান।
সূত্র জানিযেছে, আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঢাকায়ই এটা হতো। এখন চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রংপুর, খুলনায়ও এ ব্যবসা চলছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ অবৈধ ব্যবসায় বিটিসিএলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অনেক তথ্য মিলেছে। বিটিসিএলের ব্যান্ডউইথের মাধ্যমেই ঢাকার বাইরের ভিওআইপি হচ্ছে। প্রথম দিকে র্যাব ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ঢাকার বাইরে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের অভিযান না করায় তারা প্রকাশ্যেই এ ব্যবসা করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও রংপুরে ভিওআইপির তিনটি অভিযানে সফল হয়েছে র্যাব। অভিযানের সময় কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রাংশ আটক করা হয়। সূত্রমতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকরী পদক্ষেপের অভাবে প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কোনো কোনো আইজিডবি্লউ প্রতিষ্ঠান ৩ দশমিক ৪৫ সেন্টের পরিরর্তে দেড় থেকে দুই সেন্ট করে অবৈধ পথে কল টার্মিনেশন করা শুরু করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ খাতে বেশি সংখ্যক লাইসেন্স দেওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার হিসাব অনুযায়ী, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা সংশ্লিষ্ট এ ধরনের ঘটনায় মামলা রয়েছে অর্ধশতাধিক।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসার অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো শুরু হয়। এর পর থেকে এসব ঘটনায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫০টিরও অধিক মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলাই তদন্তাধীন রয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।