আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অথৈ নীলের ক্যানভাস যাদুকাটা নদী


দেশের উওরপূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় ঘেষে অবস্থিত বারিক টিলা ও পাশ দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি নদী যাদুকাটা। যেন নৈর্সগিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি, দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় এক স্থান। সুনামগঞ্জ জেলার উওর পশ্চিমে এবং তাহিরপুর উপজেলা থেকে উওরে ভারত সীমান্তে অবস্থিত এ বারিকটিলা ও যাদুকাটা নদী। বর্ষায় পাহাড়ি নদী যাদুকাটার বুকে স্রোতধারা আর শীতে শুকিয়ে যাওয়া যাদুকাটার বুক জুড়ে ধূ-ধূ বালুচর। পার্শ্বস্থ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সারি-সারি উচু নীচু খাসিয়া পাহাড় ও বাংলাদেশের বারিক টিলার সবুজ বনায়ন এবং মাটিয়া পাহাড়।

প্রতিনিয়ত ছুটে আসা লোকজনের দৃষ্টি কাড়ে। এ দুই নান্দনিক নৈর্সগিকতার পাশাপাশি তাহিরপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে যাদুকাটা ও বারিক টিলার পূর্ব প্রান্তে ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফর সঙ্গী শাহ আরফিনের আস্তানা। এছাড়াও যাদুকাটা নদীতীরে লাউড় নবগ্রাম শ্রী-শ্রী অধৈত প্রভুর মন্দির ও পনতীর্থ ধাম, পশ্চিমতীরে ইস্কন মন্দির, বোত্তাশাহর মাজার, বড়ছড়া কয়লা ও চুনাপাথর শুল্কষ্টেশন, ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প ।


যাদুকাটা নদীর শান্ত জলে কিসের যেন মায়া। এই শান্ত নদীর উৎস কোথায়? দূরে তাকালেই চোখে পড়ে পাহাড়।

একটি-দুটি নয়, চার-চারটি। উঁচু, সবুজে মোড়া। মাথার ওপর আবছা কুযাশা ওড়াউড়ি করছে। কখনো দলছুট হয়ে একদল গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই সবুজের ওপর। শীতে কুয়াশার জলে ধুয়ে মুছে পাহাড় যেন আরও সজীব-সতেজ হয়ে উঠছে।

দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে নদী। নাম যাদুকাটা। নদীর গভীরতা কম। যাদুকাটার স্বচ্ছ জলে নিচের বালুকণা পর্যন্ত দেখা যায়। নৌকা নিয়ে পাথর তোলায় ব্যস্ত হাজার হাজার বারকি শ্রমিক।

ছোট ছোট নৌকা ঢেউ তুলে ছুটছে এদিক-ওদিক। নদীর এক পাশে বিস্তীর্ণ বালুচর, অন্য পাশে সবুজ পাহাড়ের হাতছানি।


একদা এই যাদুকাটা নদীতীরেই ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। এখন রাজ্য নেই, নেই রাজধানীও। তবে যাদুকাটা নদীর উৎসমুখ, নদীর চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অবশ্যই মুগ্ধ হওয়ার মতো।

এলাকার নামের সঙ্গে রাজ্যের নামটিও জড়িয়ে আছে,‘লাউড়েরগড়’।


নগ্ন পায়ে বালুচরে হাঁটা বা হাঁটুজলে নেমে ছবি তোলা দুটিই ভাল লাগে। পায়ের নিচে যাদুকাটার ঠান্ডা জল আর মাথার ওপরে পাহাড়। সেই পাহাড়ের পিঠ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশে এসেছে যাদুকাটা নদী। যেন নদীর উৎসমুখে দুই পাশ থেকে পাহাড় ঝুলে আছে।

পেছনে আরও একটি পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। সবকিছু দেখতে ছবির মতো। এ নদীর পশ্চিমে বারেকটিলা আর পুবে শাহ আরেফিনের (রহ.) আস্তানা ও লাউড়েরগড় । এ নদীর আদি নাম রেণুকা। কথিত আছে, নদীতীরবর্তী কোনো গ্রামের এক বধূ মাছ মনে করে নিজের যাদু নামের পুত্রকে কেটে ফেলেছিলেন।

আর তখন থেকেই এর নামকরণ হয় যাদুকাটা। শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর ইচ্ছানুসারে এই নদীতে পৃথিবীর সপ্তবারির জল একত্রিত হওয়ার পর থেকে এর নাম হয় ‘পনাতীর্থ’। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এখানে দোল পূর্ণিমার রাতে সপ্তবারির জল একত্রিত হয়। আর এই বিশ্বাসেই প্রতি বছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে যাদুকাটায় স্নান করার আশায় দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থীরা এসে জড়ো হন নদীতীরে অদ্বৈতের ‘নবগ্রামে’। একে কেন্দ্র করে নদীতীরে অনুষ্ঠিত হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মেলা, বারুণি মেলা।

লাউড়েরগড়ের দক্ষিণ মাথায় নদীতীরে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। প্রতিবছর চৈত্র মাসে প্রায় একই সময়ে শাহ আরেফিন (রহ.) আস্তানায় ওরস ও যাদুকাটা নদীতীরে পুণ্যস্নান হয়। দুই উৎসব ঘিরে তখন নদীতীরে হিন্দু-মুসলমানের মিলনমেলা বসে। হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।


বারেক টিলা গাছগাছালিতে ভরা।

টিলার মাঝখান দিয়ে একটি ছোট্ট পাকা সড়ক আছে। উঁচু-নিচু। টিলার ওপর থেকে মেঘালয়কে আরও কাছে মনে হয়। নিচে নদী দেখা যায় বহুদূর পর্যন্ত। চমৎকার লাগে।

নদী ও পাহাড়ী রুপের যুগল মিশেল। ঘন জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাবে উপজাতিদের কাঁচা ঘরবাড়ি। আধা-পাকা টিনশেড ঘরের একটি গির্জা আছে বারিক টিলায়। টিলার ওপর কিছু সময় কাটিয়ে যেতে পারেন শুল্ক বন্দর ও ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পে। মোটরবাইকে মাত্র আধা ঘন্টার পথ।

ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত এই খনি প্রকল্পটি এখন বন্ধ। একসময় এটি খুবই জমজমাট ছিল। প্রকল্প এলাকায় একটি চমৎকার হ্রদ আছে। যেটি পাথর উত্তলনের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। এর গভীরতা প্রায় ১১০ ফুট।

এখনো এ কোয়ারীতে পাথর পাওয়া যায় কিন্তু উত্তোলন খরচ বেশি বলে তা বন্ধ। কোয়ারী বা হ্রদের পাড়েই সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া ঢেউ খেলানো একটি ছোট্ট টিলা আছে। সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা আর একটু পরিচর্যায় লউড়েরগড়,যাদুকাটা নদী, বারিকটিলা আর ট্যাকেরঘাট শুল্কবন্দর নিয়ে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় এক পর্যটনকেন্দ্র। এখানে পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে তা সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য খাত হতে পারে বলে স্থানীয়দের অভিমত। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হলে দেশের বাইরের পর্যটকদেরও কাছে টানতে পারবে যাদুকাটার মোহমায়া।




অন্যদিকে যাদুকাটা নদী থেকে অপরিকল্পিত পাথর ও বালি উত্তোলনরে ফলে বাদাঘাট ইউনয়িনরে লাউড়রেগড়, ঘাগটিয়া, গড়কাটি, ঘাগড়া, বিন্নাকুলি, পাঠানপাড়া, সুহালা, ফাজিলপুর, বাদাঘাটসহ ১৫টি গ্রামরে ফসলি জমি,পার্শ্ববর্তী¦ হাওর ও ঘরবাড়ি ব্যাপক নদী ভাঙনরে কবলে পড়েছে। আর এই কারণেই প্রতিবছর ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি হারা হচ্ছনে নদী তীরর্বতী এলাকায় বসবাসকারী অসংখ্য দরিদ্র মানুষ। বালি-পাথরসহ হরেক রকম প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই যাদুকাটা শত বছর ধরে সারা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সরকারি কোষাগারে বিপুল পরিমাণ রাজস্বের জোগান দিচ্ছে। এক সময়ের গভীর নদী যাদুকাটা গুটিকয়েক বালি ও পাথরখেকো আগ্রাসনকারীর অপতৎপরতায় প্রায় এক কিলোমিটার প্রশস্ত সমতল নদীতে পরিণত হয়ে তার গতানুগতিক নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। গত ১০ বছর ধরে লাগাতার প্রতিযোগিতামূলক নীতির ভিত্তিতে নদীর পাড় কেটে বালি সংগ্রহের কারণে নদীভাঙনের কবলে পড়ে উভয় তীরের বিস্তীর্ণ জনপদ আজ বিলীন হওয়ার পথে।




যেই নদী হাওরপাড়ের অভাবী লোকজনকে নানা ভাবে কর্মসংস্থান দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সেই নদীকে বাঁচাতে এখই তৎপর হতে হবে। নদী তীরবর্তী এলাকার পরিবেশ বিপন্ন যেন না হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে। তাই ব্যবসায়ী নয় বরং প্রকৃতি,পরিবেশ,প্রতিবেশ ও নিরীহ সাধারণ মানুষের মানবিক স্বার্থে অবৈধ,অপরিল্পত বালি ও পাথর উত্তলন এখনই বন্ধ করতে হবে। নদীর পাড় কাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে বিডিআর টহল জোরদার করতে হবে । নদীর উভয় পাড় থেকে গড়ে ২০০ ফুট দূরে বর্তমান নদীর মধ্যবর্তী তলদেশ থেকে বালি উত্তোলন করতে হবে এবং অবিলম্বে যাদুকাটা নদী খনন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।


সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।