চলে গেলেন নজরুল ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী সোহরাব হোসেন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যবরণ করেছেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনিসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করায় গত ২৯ নভেম্বর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সোহরাব হোসেনকে।
পরীক্ষায় তার মূত্রথলিতে ইনফেকশন ধরা পড়ে। এছাড়া তার কান, কিডনি, হার্টসহ শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখতে পান ডাক্তাররা। অসুস্থ হওয়ার পর তাকে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো হয়। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। স্কয়ার হাসপাতালের কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াহাব খানের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
সর্বশেষ আইসিউইতে থাকা অবস্থায় আজ ভোরে মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
নজরুল সঙ্গীতের এই কিংবদন্তি ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটের কাছাকাছি আয়েশতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে তিনি গান-বাজনা পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন। ৯ বছর বয়সে রানাঘাটের সঙ্গীত শিক্ষক জয়নুল আবেদীনের কাছে গান শেখা শুরু করেন।
সোহরাব হোসেন যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়েন, তখন একদিন গ্রাম থেকে গোপী মাঝির নৌকায় চড়ে রানাঘাট যাওয়ার সময় তৎকালীন জমিদার ক্ষীরোদ পাল চৌধুরীর নজরে পড়ে তার গান।
জমিদার তাকে কিরণ দে চৌধুরী নামে এক সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন। চূর্ণি নদী পার হয়ে তিনি গান শিখতে যেতেন-আসতেন। এছাড়া নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পূরবী দত্তের বাড়িতে তিনি গান শুনতে যেতেন।
গানের প্রতি এই বরেণ্য শিল্পীর এমনই আকর্ষণ ছিল যে, গ্রামোফোন রেকর্ডে কোনো গান শুনলেই তিনি তাৎক্ষণিক তা গলায় তুলে ফেলতেন। তবে তার এ সঙ্গীতপ্রীতি পরিবারের তেমন একটা পছন্দ ছিল না।
এ কারণে তার বড় ভাই পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে তাকে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। রানাঘাটে একবার শিল্পী আব্বাস উদ্দীন, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, পল্লীকবি জসীম উদদীন এবং তবলা বাদক বজলুল করিম আসেন একটি গানের অনুষ্ঠানে। তাদের সঙ্গে একই মঞ্চে গান করার সুযোগ পান সোহরাব হোসেন। তার শিক্ষক কিরণ দে চৌধুরীর মাধ্যমে পরে কলকাতায় গিয়ে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে মাসে ১২ আনা বেতনে গান গাওয়ার কাজ পান তিনি।
আব্বাস উদ্দীনের সঙ্গে স্যাভয় হোটেলে দেখা করে সোহরাব হোসেন ১৯৪৬ সালে ৬ জুন একটি পাবলিসিটি বিভাগে চাকরি পান।
তিনি এইচএমভি ও রেডিওতে অডিশনে পাস করেন। কলকাতায় তিনি আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, গিরীশ চক্রবর্তী, কৃষ্ণচন্দ্র দের মতো বিশিষ্ট শিল্পীদের সাহচর্যে আসেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন তিনি। তিনি আব্বাস উদ্দীনের মাধ্যমে ৪১ জিন্দাবাজার লেনের একটি বাড়িতে ওঠেন। চাকরি পান ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে।
এ ছাড়াও তিনি নিয়মিত রেডিওতে অনুষ্ঠান এবং টিউশনিও করতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, শিল্পী শচীন দেব বর্মণ এবং অঞ্জলি মুখার্জীর সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আব্বাস উদ্দীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নানা স্থানে ঘুরেছেন এবং গান গেয়ে বেড়িয়েছেন।
চলচ্চিত্রেও প্লে-ব্যাক করেছেন সোহরাব হোসেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো মাটির পাহাড়, যে নদী মরু পথে, গোধূলির প্রেম, শীত বিকেল ও এদেশ তোমার আমার।
অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন সোহরাব হোসেন। কার্জন হল মঞ্চে নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়া তাঁর নাটকে অভিনয় করে দর্শকনন্দিত হয়েছিলেন। দেশের অনেক জনপ্রিয় ও গুণী শিল্পী তার কাছে সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন। তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আছেন সঙ্গীতজ্ঞ সানজীদা খাতুন, শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, আতিকুল ইসলাম, সাদিয়া মল্লিক, মাহমুদুর রহমান বেনু ।
সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য বরেণ্য এই শিশ্পী স্বাধীনতা পদক, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, নজরুল একাডেমী পদক, চ্যানেল আই পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।