আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“সুনিলার অমাবস্যা”

জানালার ফাঁকে চোখ রেখে পূর্ণিমা চাঁদের ঝলমলে আলো দেখছে সুনিলা। বসন্তের প্রথমা মাসের শেষ কয়েক দিন হতে মৃদু বাতাস শুরু হয়েছে। মৃদু শীত, মৃদু গরম। বসন্ত প্রতিদিন যেন নিজেকে বদলায়। আহা! বসন্তের কতো রূপ।

তাইতো বসন্ত ঋতুরাজ স্বীকৃত। সুনিলা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়, মনে করতে পারেনা, এমন পূর্ণিমা তার জীবনে কতোবার এসেছিলো। সেই কবে, মায়ের পেটের ছোটভাইকে কোলে নিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়ে তাকে ছড়া শোনাচ্ছিল “আয় আয় চাঁদ মামা / টিপ দিয়ে যা” বলে। তার সেই ছোটভাই আজ চাঁদের দেশে বাস করে। তার কিছুদিন পর মা-ও চাঁদের দেশে চলে গেলেন।

সেই থেকে সুনিলার জীবনে অমাবস্যার শুরু। পূর্ণিমার ঝলমলে আলো তাকে আর স্পর্শ করেনি। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার! বৃদ্ধ বাবার কাঁধের বোজা হয়ে দিশেহারা হয়ে পরেছিলো সুনিলা। আজ পূর্ণিমার চাঁদ আর তার জ্যোৎস্না দেখে আনন্দে টিপ টিপ করে চোখের জল গড়িয়ে পরছে। আহ! কী আনন্দ! আজ কোনো দুঃখ নেই, শুধুই স্বপ্ন।



আজ সুনিলার বাসর রাত। উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া ছেলে প্রবাল’র সাথে তার বিয়ে হয়। শত অভাব-অনটনে থাকা সুনিলার পিতা অসম্মত ছিলেন প্রবালের সাথে মেয়ে সুনিলাকে বিয়ে দিতে। কারণ, এলাকায় প্রবালের দুর্নাম ছাড়া সু’নাম নেই। অনেক পরিবারে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসা প্রবালের পিতা অধর চন্দ্র নিরুপায় হয়ে সুনিলার সাথে কথা বলে তার কাছে হাত পাতেন।

পিতার মতো অধর চন্দ্রকে খালি হাতে ফেরাতে পারেনা সুনিলা। “কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন” এই বচনে বিশ্বাস রাখে সুনিলা। নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে সে পিতাকে বুঝায়। সুখ, সে কপালে থাকলে ধরা দেবে। আর কপালে না থাকলে শত চেষ্টায়ও তাকে কাছে টানা যায়না।

তবে চেষ্টায় ভাগ্যের পরিবর্তন হয় কখনো। জীবনে অনেক বড় বড় পরীক্ষা দিতে হয়। সেই পরীক্ষা দিতেই সুনিলা প্রস্তুত। পিতা কন্যার মুখের দিকে চেয়ে বিয়েতে সম্মত হন। শ্বশুর অধর চন্দ্র সুনিলার চোখের দিকে চেয়ে বুঝেছিলেন হয়তো, এই মেয়েই পারবে তার বখে যাওয়া ছেলেকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে।

গরীবের মেয়েরা সংসার ব্রতে চির ব্রতী থাকে। আহা! এই সংসার বড়ই নিষ্ঠুর! গরীবেরাই বলীর পাঁটা হয়। তাদেরকে সবাই আগুণের মুখে ঠেলে দেয়। সৃষ্টিকর্তাও তাদের চরম পরীক্ষা নেন!

এই চাঁদনী রাতে স্বপ্ন বোনে সুনিলা। ভুলে গেছে কপালের লিখন আর ভাগ্যের খেলার বচন।

আজ শুধুই স্বপ্ন। আজ পূর্ণিমার আলো তার হৃদয়ে স্পর্শ করেছে। কিন্তু তার স্বপ্নের এই পূর্ণিমা অমাবস্যায় রূপ নিতে খুব একটা সময় লাগেনি। স্বামী বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু মন আসেনি তার।

তার মন বিক্রি হয়ে গেছে কাঁচের বোতলের সেই যাদুর জলে! যার স্পর্শে মানুষের চেতনা-চৈতন্য, বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। যে যাদুর জল মানুষকে তার দাস করে রাখে প্রতিনিয়ত। সেই যাদুর স্পর্শে নিজেকে বিক্রি করে বাসর ঘরে এসেই বিছানায় শুয়ে পরে প্রবাল। নিদ্রা-দেবী তাকে নিয়ে যায় আঁধার জগতে। সুনিলার চোখে জল, আজ সঙ্গীকে প্রথম কাছে পেয়েও, একটি কথাও বলতে পারলোনা! মধুমাখা পূর্ণিমা রাত কান্নায় পরিণত হলো! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছেনা সুনিলা।

মুহূর্তে সব প্রতিশ্রুতি আর ভাগ্যকে সে ভুলে গেছে। আজ সে শুধু স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু চার-দেয়ালে স্বপ্ন স্থায়ী ছিল কয়েক মিনিটের, কয়েক ঘণ্টার জন্য স্থায়ী হয়নি সে স্বপ্ন! ভুলে গেছে সে, শ্বশুর বলেছিলেন “তোমাকে আগুনে ঠেলে দিচ্ছি মা। প্রথম দিন থেকেই হয়তো তোমাকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে”। এসব সুনিলার মনে নেই।

তার মন আজ প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চেয়েছিলো। সুনিলা চেয়েছিলো, সারা জীবন না-হোক, কয়েকটা ঘণ্টা যেন স্থায়ী হয় তার স্বপ্ন। কিন্তু ভাগ্য তাতে সায় দেয়নি!

রজনী প্রভাত হতে চলল। স্বামী ঘুমের ঘরে অচেতন শুয়ে আছে। কিন্তু সুনিলা সারা রাতেও পারেনি চোখের দুটি পাতার আলিঙ্গনে বিদ্ধ হতে।

কেমন শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে প্রবাল। সারারাত ঘুমন্ত প্রবালের মুখপানে চেয়ে সুনিলা আবিষ্কার করলো, ঘুমন্ত মানুষের মন নিষ্পাপ হয়। যে কিছু বুঝেনা, যে কিছু জানেনা, যার কোনও বিষয় চিন্তা নেই। ধীরেধীরে সুনিলা প্রবালের মাথায় হাত রাখে। বড় মায়া হয় তার।

ভাবতে থাকে, সে একটি শিশুর মতো মানুষের সাথে ঘর বেঁধেছে। যাকে ভালবাসার শাসন দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুকালে মা হারিয়ে, মাতৃস্নেহ বঞ্চিত প্রবালকে পাড়াপড়শি সবাই যাকে খারাপ ও লম্পট ছেলে হিসেবে দেখে, তাকে সবার কাছে ভাল ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। শ্বশুরকে কিঞ্চিৎ এ কথাই সে দিয়েছিলো।

সকালে প্রবাল ঘুম থেকে ওঠার আগেই সুনিলা চায়ের কাপ হাতে প্রবালের কাছে যায়।

জানালা খুলে দিলে সকালের নরম রোদ প্রবালের মুখমণ্ডল আলোকিত করে। প্রবালের মাথায় হাত রাখে সুনিলা। চোখে খেলে যাচ্ছে প্রেমের জল। হৃদয়ে তৃপ্তির ছোঁয়া। প্রবাল জেগে যায়।

সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সুনিলার মুখপানে চেয়ে দেখে তার নয়নে খেলছে প্রেমের তরঙ্গ। জড়িয়ে ধরে সুনিলাকে। আহা! এই বুঝি মহামিলন। প্রবাল সুনিলার নয়নে নয়ন রাখে। ভাবে, তার স্ত্রী-ভাগ্য খুব খারাপ নয়।

সুনিলার ভালবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে। জীবনসঙ্গী এমনই হওয়া চাই। দু’জন দু’জনার মুখপানে চেয়ে আছে। ঠিক সেই সময় সুনিলার শ্বশুর অধর চন্দ্র বৌমা বলে ডাক দিলেন। সুনিলা তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় শ্বশুরের ডাকে।



আজ সুনিলার মন অনেক ভালো। সকালে স্বামীর আচরণে বুঝতে পেরেছে, স্বামী তাকে ভালবাসে। তাই সারাদিন মনের আনন্দে গীতের কলি গেয়েছে আর স্বপ্ন বুনেছে। পূর্ণিমার চাঁদ প্রতিদিন সমান আলো দেয়না। আজ রাত তাই গতকালের চেয়ে অনেক কম ছিলো জ্যোৎস্না।

কিন্তু সুনিলার মনে কোনও প্রভাব ফেলেনা। তার চোখে ভেসে উঠছে প্রবালের হাসিমাখা মুখ। ঘরে যেন চাঁদের আলো পরিপূর্ণ। বারবার মনে পড়ছে প্রবালের কথা। সকালের আলিঙ্গনের টাটকা স্মৃতি।

স্বপ্ন আর স্মৃতির ডোরে আটকা পরে সুনিলা বুঝতেই পারলোনা রাত অনেক হয়ে গেছে। স্বামী এখনো ঘরে ফিরছেনা! অপেক্ষা কতো কষ্টের, সুনিলা তা টের পায়। সময় যতো গড়াচ্ছে, সুনিলার মন ততো খারাপ হচ্ছে। আজ আবার প্রবাল কোন মূর্তিতে আবির্ভূত হবে তা নিয়েই দুশ্চিন্তা। তার দুশ্চিন্তা মিত্যে হয়নি।

নেশাগ্রস্থ স্বামী ফিরেছে। প্রবালের শরীর দোলছে। মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরছে। অচেতন শরীরটাকে কোনোরকম টেনে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। সুনিলা বিছানা ছেড়ে উঠে তাকে ধরতে যায়।

কিন্তু ততোক্ষণে ড্রেসিংটেবিলে আছড়ে পরে প্রবাল। প্রবালের হাত লেগে ড্রেসিংটেবিলে থাকা সিঁদুরের কৌটা মাটিতে পরে যায়। কৌটার গড়াগড়িতে সিঁদুরে লাল হয়ে যায় অনেকখানি জায়গা। প্রবালের বাঁ পা সিঁদুরে রঙে লাল! সুনিলার চোখে জল। সিঁদুর মাটিতে পরে যাওয়া কোনও শুভলক্ষণ নয়! সবখানি সিঁদুর তুলে সুনিলা তার কপালে ও মাথায় লাগিয়ে দেয়।

এই সেই সিঁদুর, যা বিবাহের পরিচয় বহন করে। জীবিত কারো স্ত্রীর পরিচয় বহন করে।

মাতাল স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দেয় সুনিলা। পাশে শুয়ে আধো আধো ঘুমে রাত পার করে দেয়। সকালে প্রবালের অন্যরূপ।

এখন সে একজন সচেতন স্বামী। খবর নেয় সুনিলার। সে ঠিকমতো খাচ্ছে কী না, নতুন জীবনে কোনও সমস্যা হচ্ছে কী না। সুনিলা আবারও অবাক হয় প্রবালের স্বামী-সুলভ আচরণ দেখে। সে মৃদু হাসে।

বিয়ের তৃতীয় রাত পার করলো সুনিলা। কিন্তু প্রবালকে বুঝার মতো কোনো উপলক্ষ আবিষ্কার করতে পারলোনা। না পারারই কথা। মানুষের মনে কতো রঙ, তা সহজে বুঝার নয়।
সুনিলা চা দিয়ে চলে যায় শ্বশুরের ডাকে।

শ্বশুর তার বড়ই ভালো। নিজের মেয়ের মতো করে ডাকেন। তার ডাকে মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা সুনিলা। শ্বশুরের কাছে থেকে আবারও স্বামী প্রবালের কাছে আসে। এবার প্রবাল এক গ্লাস জল আনতে বলে।

সুনিলা রান্নাঘর থেকে জল নিয়ে এসে দেখে প্রবাল বালিশে মুখ ঢেকে বিছানায় শুয়ে আছে। সুনিলা কাছে যায়। প্রবালকে হাত দিয়ে টান দেয়। প্রবালের শরীরটা বেশ শক্ত লাগে! এবার বেশ জোড়ে টান দেয়, কিন্তু প্রবালের শরীর নড়েনা! সে চিৎকার করে উঠে! সবাই ছোটে আসে। কিন্তু, প্রবাল আর নেই।

সে চাঁদের দেশে চলে গেছে! সুনিলা আছড়ে পরে মাটিতে। হাতের শাঁখা ভেঙ্গে হয় খানখান। নয়নের জলে সিঁদুর ধুয়ে মুছে যায়। কপাল হয়ে যায় খালি। যে কপালে আর লিখা নেই সুখ, স্বপ্ন।

পূর্ণিমার চাঁদ ক্ষয়ে গেছে। এখন অমাবস্যা! ঘোর অন্ধকার। শুধুই অন্ধকার!


সমাপ্ত

১১/০৩/২০১৪।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.