আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুড়ি-কুড়ির ছন্দে লাগুক দোলা-১

গল্পকথক..

''মিউনিখ পুশ'-এ ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি। মনোবল চাঙ্গা করতে তলব করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ধৃত ব্রিটিশ বন্দীদের। নির্দেশ করেন, ক্রিকেট খেলাটার কায়দা-কানুন শেখানোর। সাত বছর ধরে খেলাটি রপ্ত করা পর সেইসব বন্দীদের সঙ্গে একটি প্রীতি ম্যাচেও অংশ নেন।

তিনি আর কেউ নন, অ্যাডলফ হিটলার !
গুনমুগ্ধ বলতে যা বোঝায়, হিটলারের প্রতি ঠিক তাই ছিলেন অলিভার লকার ল্যাম্পসন। তাকে নিয়ে লেখা 'হিটলার অ্যাজ আই নো হিম' বইয়ে ঘটনাটার উল্লেখ করেন ব্রিটিশ নেভীর সাবেক এ কমান্ডার। তার মতে, হিটলার নাকি খেলাটির নিয়ম-কানুনও পাল্টাতে চেয়েছিলেন ! পায়ে প্যাড পরার ঘোরবিরোধী ছিলেন। অলিভারের ভাষায়,'ফুয়েরার মনে করতেন, ওই লম্বা বস্তুদুটো কাপুরুষোচিত এবং ঠিক জার্মানসুলভ নয়। '
ভাগ্যিস, হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন।

নইলে,টেন্ডুলকারকেও হয়তো আমরা দেখতে পেতাম, ক্রাচে ভর দিয়ে ব্যাট করছেন ! অপাত্রের হাতে তাই আর যাই হোক, ক্রিকেট নয়। প্রিন্স ফিলিপ কি এটা ভেবেই বলেছিলেন-একজন পাগলের হাতে বন্দুক থাকার চেয়ে ক্রিকেট ব্যাট থাকা বেশি বিপদজ্জনক। ' কিন্তু প্রয়োজন তো আর কখনোই আইন মেনে চলেনি। ৫০'র দশকের পর থেকে টেষ্ট ম্যাচ দর্শকদের কাছে পানসে হয়ে পড়ছিল। নেতানো মাঠের সঙ্গে অর্থের যোগানটাও ধরে রাখতে ১৯৭১ সালে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেয় ইংলিশরা।

কিন্তু পঞ্চাশ-পঞ্চাশেও একসময় অরুচি চলে আসে। বিশেষ করে, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মাঠে গড়ানোর পর ২০০২ সালে বেনসন এন্ড হেজেস কাপের মেয়াদ শেষ হলে। ওয়ানডে তখন আর ইংলিশদের মাঠে টানতে পারছে না। বিকল্প পথ বাতলে দিলেন ইসিবির মার্কেটিং ম্যানেজার ষ্টুয়ার্ট রবার্টসন। চারবছর আগে থেকেই ক্রিকেটের বাজার বিশ্লেষন করা রবার্টসন জরিপ চালিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন-'ওভার কমালে এবং ম্যাচগুলো বিকেলে অনুষ্ঠিত হলে মহিলা এবং শিশুরা গ্যালারীতে ভিড় জমাবে।

' অর্থাৎ রথ দেখার সঙ্গে কলাও বেচা যাবে। পরের বছর থেকেই অফিসিয়ালি যাত্রা শুরু করে ক্রিকেটের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সংস্করন-টুয়েন্টি-টুয়েন্টি। ওয়ানডে ক্রিকেট চালু হওয়ার পর স্যার ডন ব্রাডম্যান আক্ষেপ করে বলেছিলেন-'লোকজন তাহলে শেষ পর্যন্ত চিত্ত বিনোদনকেই বেছে নিল। ' ডন বেঁচে থাকলে দেখতেন তার সেই 'চিত্ত বিনোদনকে'ও বেশ কায়দা করে ছেঁটে চোখা বানানো হয়েছে। যেভাবে একটি হীরার উজ্জলতা বাড়ানো হয় তাকে কয়েকধাপে কেটে।

দূত্যিময় ক্রিকেটের সেই উজ্জলতম অংশটুকুই হলো-টি২০ বিশ্বকাপ। ডিন জোন্সের ভাষায়-'পার্ল অব ক্রিকেট। '
খেলাটির এই চটকদার সংস্করনটিকে ঘিরে 'যে কোন কিছুই ঘটতে পারে' কথাটা এত বেশি লাগসই হয়ে উঠছে ফলাফল নিয়ে আগে-ভাগেই মাথা ঘামানোর অবকাশ নেই। এ প্রতিযোগিতায় ম্যাচ নয় প্রতিটি বলই চমক দেখার একেকটা দৃশ্যপট নির্মানের প্রেক্ষাপট। সময় কম তাই মজাটাও বেশ ঘন জমাট বাঁধা।

তবে মাত্রাঅতিরিক্ত উপভোগের নিমিত্তে বদ হজমও হতে পারে। ক্যারিবিয় 'পেস কোয়ার্ট্রেট'-জুটির কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভাষায়,'সবাই বিনোদন চায়। টি২০ সেরকমই একটা আসর। যদিও তা মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেললে পেট খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। '
তাই বলে কিন্তু টি২০'র জৌলুসবৃদ্ধি থেমে নেই।

ক্ষনকালের এই ছন্দের আবেদন সবার কাছেই চিত্তগ্রাহী। বিনিয়োগকারিরাও বসে নেই। দেদারসে উঠে আসছে মুনাফা। স্বল্প সময়ে নিজের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দেয়ার তাগিদে ক্রিকেটারেরাও ঘাম ঝড়াচ্ছেন বেশি করে। ২০ ওভার শেষে রানের কোঠা তাই এখন দেড়শ ছাড়িয়ে দুইশ, কখনো আড়াইশ !
তার বিপরীতে বোলারাও বসে নেই।

নানান উদ্ভাবনী বৈচিত্রে ক্রিকেটের ভাঁড়াড়ে তারা নিত্য-নতুন যোগ করছেন মণি-মুক্তো। ফিল্ডারদের থাকতে হয় আরও বেশি ক্ষিপ্র,শাণিত এবং লক্ষভেদী। ধকল যায় আম্পায়দের এবং স্কোরারদের ওপরও। প্রতি পর্বে পরিবর্তিত আইনের ধারা-উপধারা প্রয়োগ, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির খবরদারি-ইত্যাদি।
আরেকটি দিক থেকে টি২০ ক্রিকেট বেশ শাণিত।

আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে তিন দশক ধরে ক্রিকেটারেরা 'স্লেজিং' এর নামে প্রগলভতাই বেশি প্রকাশ করছে। অষ্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল একবার বলেছিলেন,'মাঠে জিভ দিয়ে যে চেক লেখ, সেটা তোমার ব্যাট বা বল যদি ক্যাশ করতে না পারে তবে সেই চেক লিখে কাজ নেই। ' এই চেক লেখা এবং ক্যাশ করার দায়টা টি২০ ক্রিকেটারদের ওপর একটু বেশি। আর সেই দায়মুক্তির সাধনায় দর্শকদের চক্ষুসুখের আনন্দটাও বেড়ে গেছে। এতটাই বুভুক্ষু থাকে যে মাঠে নৃত্যরত হ্রস্ব বর্মন নর্তকিদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।

ধুমধাড়াক্কা খেলার মাঝেও ক্রিকেটের সনাতনী মুল্যবোধগুলো সমুন্নত রাখার কায়দা-কানুন দর্শক এখন শিখে ফেলেছে। একটা দুটো নতুন ধরনের শট, নতুন কৌশলের বল হয়তো অপেক্ষা করছে ! কে জানে ? তবে নিজেকে নেহায়েত সনাতনী ঘরানার মনে করলে বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্রিকেট লিখিয়ে স্যার নেভিল কার্ডাসের ওই মন্তব্যটি একবার গলাঃধকর করে নিন-'ক্রিকেট হলো নদীর স্রোতধারার মতো। আয়তন বুঝে গড়ন পাল্টায়'.......(চলবে)।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।