আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে এক আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম।

বিএসএফ কেন সীমান্তে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষকে গুলি করছে?

ঢাকার সংবাদ চ্যানেলে গিয়েও টকশোতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশের মানুষদের একই প্রশ্ন- কেন একটি মেয়েকে সামান্য চুরির অভিযোগে নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে? শুধু তাই নয়, মৃতদেহ গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে ছবি তোলা হবে? এ সব প্রশ্নে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলেছিলাম, আমি কিন্তু ভারত সরকারের প্রতিনিধি নই। আমি ভারতের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি। বিএসএফ ভারতের সরকারি আধা সামরিক বাহিনী যদি অন্যায় অত্যাচার করে তবে আমিও ঠিক ততটাই প্রতিবাদ জানাই, যতটা আপনারা জানাচ্ছেন। কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তবে তার প্রতিবাদেও একইভাবে মুখর হই।

তবে বিএসএফের ক্ষেত্রে অন্যথা হবে কেন? সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনা সভায় ভারতের বিএসএফের প্রাক্তন অধিকর্তা রামমোহনও হাজির ছিলেন। তিনি বললেন, চোরাপাচার-চোরাকারবার অপরাধ-পালানোর চেষ্টা করলে সেই অনুপ্রবেশকারীকে গুলি চালনাই তো বিএসএফের কর্তব্য। যদি কোনো ভারতীয় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢোকে এ কাজ করে তবে বিজিবি কি সেই একই কর্তব্য পালনে বাধ্য নয়?

আসলে ক্ষুদ্র বিষয় থেকে আমাদের এই দুই দেশের সম্পর্কের বৃহৎ প্রেক্ষাপটকে স্পর্শ করতে হবে। প্রথম প্রশ্ন হলো- ভারত এবং বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রয়োজন না অপ্রয়োজন। দুই দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তা সে যে দলেরই শাসন হোক না কেন, মনে করেন সম্পর্ক প্রয়োজন।

ভারত মনে করে, বাংলাদেশ ভৌগোলিক আয়তনে ছোট হতে পারে, কিন্তু তার Geo-strategic (ভৌগোলিক-কৌশলগত) অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। '৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর দুই দেশেই অনেক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে, দুই দেশের মধ্যেই অনেক ভুল বোঝাবুঝির দ্বান্দ্বিকতা আছে কিন্তু সংঘাতের বিষয়গুলোকে নিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে মৌলবাদী আচরণ প্রদর্শনে আসলে কারোরই লাভ নেই। ভারতের মধ্যেই ২৯টি রাজ্য এখন। নিজেদের মধ্যে কত সংঘাত। সংঘাতের স্নায়ুতে সুড়সুড়ি দিয়ে লাভ কার? বরং যখন গোটা পৃথিবী বিশ্বায়নের উদারবাদী পথে হাঁটছে তখন অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য রচনাই শ্রেয়।

পুঁজিবাদ সামন্তবাদের সংঘাত বদলে ঐক্য রচনার মাধ্যমে বাজার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সেটা ইতিহাসের চালিকাশক্তি। কিন্তু সেই সমাজ বিবর্তনের মধ্যে নিজেদের আইডেনটিটি বা নিজস্ব সত্তাকে মর্যাদা দিয়ে এগোনোর পরিস্থিতি তৈরি করাই সংবাদমাধ্যমের কাজ।

সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে যারা মনে করেন তারা ভুল। আমাদের ভূমিকাটা আসলে Social Catalyst বা সামাজিক অনুঘটকের।

সেই ভূমিকাটি ইতিবাচক হওয়া প্রয়োজন। দিল্লিতে কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে আসা সম্পাদকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সম্পাদক বলেছিলেন- ভারতে এসে যখনই দেখি সংবাদ ছাপা হয়েছে যে, বাংলাদেশি সন্দেহে অনুপ্রবেশকারী ধৃত। তখন খুব খারাপ লাগে। মনে হয়, ভারতীয় মিডিয়ার মনোভাব খুব নেতিবাচক। তারপর ধৃত ওই বাংলাদেশির কী হলো, সত্যি সত্যিই সে অপরাধী, না তাকে ধরে রাখা হলো? না ছেড়ে দেওয়া হলো সেসব কিছুই জানা গেল না।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের বিষয়ে খবরও অপ্রতুল। ভারতের বাংলা সংবাদপত্রগুলোতেও প্রচার যথেষ্ট নয়।

২০০৪ সালে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (BEI) ভারত-বাংলাদেশ নবীন সাংবাদিকদের জন্য কথোপকথন- শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সে আলোচনা সভাতে আমার বন্ধু সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভরদারাজন বলেছিলেন, 'The media too needs to Contribute by avoiding stereotyped and biased reporting and analysis'.

আসলে তিস্তাচুক্তি বা সীমান্তচুক্তি যাই হোক, সমস্যাটা রাজনীতির চেয়েও বেশি দুই দেশের ভিতরকার ঐতিহাসিক সংঘাতের পটভূমির। বলা খুব সোজা সংবাদমাধ্যমকে এই সংকীর্ণতা থেকে বেরোতে হবে, কিন্তু বাস্তবে এটি রূপায়িত করা এত সহজ কাজ নয়।

কারণ এই মনস্তাত্তি্বক বিরোধের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।

ঢাকার গবেষক-লেখক রইসউদ্দিন আরিফ তার 'আত্দবিস্মৃত বাঙালী' গ্রন্থে লিখেছেন- অতীতে ভারতবর্ষকে 'হিন্দুস্তান' বলা হতো, আর তার অধিবাসীরা ছিলেন 'হিন্দু'- এই দুটি শব্দের উৎপত্তি আরবি 'হিন্দ' শব্দ থেকে। কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্তে হিন্দু এখন হিন্দু ধর্মে ও ধর্মীয় জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের মুসলমান সমাজকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ব্রিটিশদের বিভেদ নীতি এই ষড়যন্ত্রকে সাফল্য এনে দেয়।

ব্রাহ্মণ ধর্ম, বৌদ্ধ, জৈন ও অন্য ধর্ম সম্প্রদায়কেও এভাবে পরাস্ত করে। এই তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক হতে পারে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি আজও দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের মধ্যেও সত্তার সংঘাত আছে। বাঙালিসত্তা ও ইসলামসত্তার সংঘাত। এই সংঘাতকে সমন্বয়ে পরিণত করাটা কিন্তু বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যমেরও দায়িত্ব।

ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক সংস্কারমুখী বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হতে পারে।

একে নাজমুল করিমের লেখা, পরিবর্তনশীল সমাজ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ গ্রন্থে লেখক বলছেন, ভারত ও পাকিস্তান সমবয়সী হলেও দুটি দেশ দুইভাবে এগিয়েছে গত ৬০ বছর ধরে। ভারত গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পথে হাঁটছে। মোগল আমলের রাষ্ট্রীয় সামন্তবাদ তথা রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদ থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে, কিন্তু পাকিস্তান বার বার সে পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশও ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের পথেই হাঁটতে চাইছে।

অমর্ত্য সেন তার 'পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন' (১৯৮১) গ্রন্থে দেখিয়েছেন '৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় ও '৭৪ সালে সংঘটিত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ ও প্রভাব কী কী? নাজমুল করিম বলছেন, এই দুর্ভিক্ষ যে আর্থিক সংকট সৃষ্টি করে তাও এই উপমহাদেশে সামাজিক স্তর বিন্যাসে গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে ভূমিকা নেয়। এই শ্রেণীসংঘাত ও জাতিগত সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি লড়াই করে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে পৃথিবীর প্রশংসা কুড়িয়েছে।

তাই সংবাদকর্মী হিসেবে বার বার মনে হয়, ভারতের দিক থেকেও 'দাদাগিরির' মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। দাদাগিরির মনস্তত্ত্বর মধ্যে আছে সম্প্রসারণবাদ। আবার বাংলাদেশকেও ভারতের মতো বিশাল দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে হবে।

আর যাই হোক দুই দেশেরই প্রয়োজন দুই দেশকে। অতএব আলোচনাই গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষ অস্ত্র। ভরসা হারালে চলবে না। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব সেই আস্থা বর্ধনের অনুকূল আবহ তৈরি করা। সুদৃশ্য বেডকভার দিয়ে ছিঁড়া তোশক ঢেকে লাভ নেই, বরং খোলামেলা আলোচনা হোক সব সমস্যা নিয়েই, দ্বিধাহীনভাবে।

লেখক : সম্পাদক, দিল্লি আনন্দবাজার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।