বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আসছে আকাশপথে। তবে বৈধভাবে নয়, চোরাচালানের পণ্য হয়ে। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে প্রায় প্রতিদিনই এসব স্বর্ণ ঢুকছে। মাঝেমধ্যে ছোট চালান ধরা পড়লেও বড় চালানগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে নিরাপদেই। এর পরেও গত এক বছরে যে পরিমাণ স্বর্ণ আটকের ঘটনা ঘটেছে, তা বিমানবন্দরের ইতিহাসে আগে ঘটেনি।
এ সময়ের মধ্যে চোরাচালানের ৫৫০ কেজি স্বর্ণ আটক করে কাস্টমস। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায়ও আটক হচ্ছে স্বর্ণের অবৈধ চালান। রাজধানীতে গাড়ি তল্লাশি করেও পাওয়া যাচ্ছে স্বর্ণের বার। কাস্টমস ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিমাণ স্বর্ণ আটক হয়েছে, তার ১০ গুণ বেশি চোরাচালানের স্বর্ণ ঢুকেছে দেশে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে পরিমাণ স্বর্ণ বাংলাদেশে ঢুকছে, সে পরিমাণ স্বর্ণের চাহিদা নেই বাংলাদেশে।
গত এক বছরে দেশে এক ভরি স্বর্ণও বাণিজ্যিকভাবে বৈধ পথে আসেনি। এর পরেও স্বর্ণ চোরাচালান আকস্মিক বেড়ে যাওয়া এবং বিপুল স্বর্ণ আটকের পর সব মহলে এখন প্রশ্ন- এত স্বর্ণ যায় কোথায়?
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাচালানের সিংহভাগ স্বর্ণ পাচার হচ্ছে ভারতে। আকাশপথে যে স্বর্ণ দেশে আসছে, তা আবার স্থলপথে বেরিয়ে যাচ্ছে। বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। চক্রের মূল হোতারা সিঙ্গাপুর, দুবাই, পাকিস্তান ও ভারতে বসে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন।
চোরাকারবারি চক্রের বাহক কেউ ধরা পড়লেও শাস্তি হয় না। মূল হোতারা সব সময় রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব কারণে স্বর্ণের চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে নিরাপদ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির এক কর্মকর্তা জানান, স্বর্ণ আমদানিতে এখন আর কোনো এলসি (ঋণপত্র) করা হচ্ছে না। দেশে ৮ থেকে ১০ হাজার জুয়েলারি দোকানে প্রতিদিনই কেনাবেচা হয় ২৫ কোটি টাকার গয়না।
বিদেশ থেকে যাত্রীদের আনা ব্যাগেজ ও রিফাইন্ড (পুরনো অলঙ্কার ভেঙে নতুনভাবে তৈরি) স্বর্ণ দিয়েই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বাংলাদেশের বাজারে খুব বেশি স্বর্ণের চাহিদা নেই। তাই চোরাই পথে আসা স্বর্ণ মার্কেটে ঢোকে না। তবে সামান্য কিছু তো ঢুকতেই পারে। এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও সমিতির কাছে নেই বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ঢাকা কাস্টম হাউস, শুল্ক গোয়েন্দা ও পুলিশের দেওয়া তথ্যে এক বছরে ঢাকার শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আড়াই শ কোটি টাকা মূল্যের ৫৫০ কেজিরও বেশি চোরাই স্বর্ণ আটক করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এ তিনটি বিমানবন্দরকে চোরাচালানের স্বর্গদ্বার হিসেবে ব্যবহার করছে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা। এ ছাড়া সীমান্তের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রুট দিয়ে চালান সরাসরি ভারতীয় স্বর্ণ কারবারিদের হাতে চলে যায়। একটি চালান নিরাপদে গন্তব্যে পেঁৗছাতে পাচারকারী সিন্ডিকেটকে ঘাটে ঘাটে টাকা গুনতে হয়।
তবেই কাঙ্ক্ষিত চালান হাতে পায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বর্ণ আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে ভারত সরকার। ফলে দেশটিতে স্বর্ণ আমদানি ৯৫ শতাংশে কমে আসে। তা ছাড়া স্বর্ণ আমদানিতে শুল্কহার ৬ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এতে স্বর্ণ আমদানিতে আরও ধস নামে।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বর্ণ ব্যবহারকারী দেশ ভারতে স্বর্ণ পাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। তাই দুই বাংলার চোরাকারবারিদের কাছে স্বর্ণ পাচার এখন অধিকতর লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই থেকে অবৈধভাবে স্বর্ণ চোরাচালান হয়ে বাংলাদেশে আসছে। আবার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারতে ঢুকছে। চক্রের মূল হোতারা সিঙ্গাপুর, দুবাই, পাকিস্তান ও ভারতে বসেই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সোনা পাচারকে কেন্দ্র করে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গোয়েন্দা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগ, কাস্টমস ও বাংলাদেশ বিমানের শতাধিক কর্মী টাকার বিনিময়ে পাচারকারীদের সহায়তা করছেন। মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে কর্মরত এসব লোক স্বর্ণ চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়ছেন। অথচ মূল হোতারা বিদেশে বসেই তাদের এজেন্ট দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
তাই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন তারা। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ ভারতে পাচারকালে গত তিন মাসে অন্তত ১০ জন ভারতীয় নাগরিক গ্রেফতার হয়েছেন। এরা স্বর্ণের বার নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকছিলেন। আর এসব স্বর্ণ দুবাই থেকে বাংলাদেশে আসে। বেনাপোল পোর্ট থানার পুলিশ ২ জানুয়ারি ৩৬ পিস স্বর্ণের বারসহ মমিনুল চৌধুরী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে।
তার ভাষ্যমতে, ভারতের দমদম বিমানবন্দরে কড়াকড়ি ও নজরদারি বৃদ্ধির কারণে তারা বেনাপোল ও ভারতের বিপরীতে হরিদাসপুর, জয়ন্তীপুর, আংরাইল, বানোবেড়িয়া, সুটিয়া, বাঁশঘাট ও কালি রানী এলাকা দিয়েই পাচার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ঢাকা কাস্টমস হাউসের হিসাবমতে, গত ১৩ মাসে বিমানবন্দরে ১১০টি স্বর্ণের চালান আটকের ঘটনায় থানা ও বিভাগীয়সহ ৭৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক মামলা ধামাচাপা পড়ে গেছে। এসব ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই আদালত থেকে জামিনে মুক্তিলাভ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পর্যন্ত স্বর্ণ চোরাচালানের কোনো মামলায় জড়িতদের শাস্তি হওয়া দূরের কথা মূল হোতাদেরই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তারা বরাবরই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বাহক হিসেবে যারা ধরা পড়েন, আইনের ফাঁকফোকরে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও চোরাচালানে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ ছাড়া চোরাকারবারিদের সহযোগী বিমানবন্দরে কর্মরত যে কয়েকটি চক্র রয়েছে এসব চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এ কারণে বাংলাদেশ এখন স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট। ঢাকা কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার কে এম অহিদুল আলম বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে হওয়া মামলার আসামিরা কীভাবে জামিনে মুক্তি পান, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, কাস্টমসের নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ না থাকায় এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পুলিশের মতো কাস্টমসকে যদি এসব মামলার তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এ সমস্যাটা দূর হতো। আসামিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে মামলা দায়েরের পর পুরো বিষয়টি পুলিশের কাছে চলে যায়। তদন্তে কোনো ফাঁকফোকর থাকে কি না, তা কাস্টমসের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে যখন পর্যালোচনা করা হয়, তখনই আমরা জানতে পারি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।