ইদানীং একটা অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছেন জাফর সাহেব। সমস্যার কথাটা কাউকে বলার নয়। যে শুনবে সে হাসবে। কেউ কেউ গম্ভীর গলায় বলবে, একজন ভালো ডাক্তারের কাছে যান। আমার কাছে ঠিকানা আছে।
বলেন তো ফোন করে দিই।
জাফর সাহেব অভিজ্ঞতায় দেখেছেন বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষেরই একেকজন চেনা ডাক্তার থাকে। আর সেই ডাক্তারের কোনো তুলনা হয় না। কাউকে সমস্যার কথা বলা মানে এমন কোনো কীর্তিমান ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া। কেউ কেউ আবার নিজে নিজেই চিকিৎসক।
তার অফিসের অ্যাকাউন্টসের জুনিয়র অফিসার জসিমের প্রতিদিন বিকালে মাথা ধরত। পাশের ডেস্কের আরাফাত সাহেব সমাধানের একটা উপায় বাতলে দিলেন। মাথা কামিয়ে ফেলা। ডাক্তার-কবিরাজে ব্যর্থ হওয়ার পর একদিন জসিম ঠিকই মাথা কামিয়ে ফেললেন। অফিসে তাকে দেখে আরাফাত সাহেবই চিনতে পারলেন না।
বললেন, 'আপনি কে? চেনা চেনা লাগছে যেন!'
জাফর সাহেব তাই কাউকে কিছু বলছেন না। কিন্তু অফিসে মনমরা হয়ে থাকেন। রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুধু মানুষের শার্টের দিকে খেয়াল করেন। রাস্তায় কেউ দেখে প্রকৃতি, কেউ বিজ্ঞাপনের পোস্টার, কেউ খোঁজে সুন্দরী মেয়ে। তিনি দেখেন শুধু গায়ের শার্ট।
শার্ট নিয়েই নিজের সমস্যা বলে এর বাইরের সব কিছু তার কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
সে দিন অফিসে জিএম অ্যাডমিন তাকে ডাকলেন। স্টাফদের পক্ষ থেকে একটা বাড়তি বোনাসের দাবি এসেছে, নোট তৈরি করে দিতে হবে। জিএম সাহেব তাকে কী কী লিখতে হবে তার ডিক্টেশন দিচ্ছেন, কিন্তু জাফর সাহেবের মন সেদিকে নেই। তার চোখ জিএম সাহেবের শার্টের দিকে।
ছাই রঙের একটা শার্ট, দেখে মনে হয় অনেক দিন পর ট্রাংক থেকে বের করা হয়েছে। জাফর সাহেবকে কেউ জোর করলেও তিনি এটা পরতেন না অথচ এ ভদ্রলোক হয়তো শখ করে পরে এসেছেন! শার্ট বিষয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি অবাক একটা জিনিস বের করলেন। মানুষের পছন্দের কী আকাশ-পাতাল তফাত! একজন যে শার্টটা খুব যত্ন করে কেনে, আরেকজনকে টাকা দিলেও সেটা সে নেবে না। আরও একটা ব্যাপার, এত এত মানুষ রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় কিন্তু তাদের প্রত্যেকের পরনে আলাদা রকমের শার্ট। রং আছে অল্প কয়েকটি কিন্তু ডিজাইন কত রকম।
একই রকম শার্ট পরা দুজন মানুষকে এত খুঁজেও পাননি তিনি। শার্ট কোম্পানিগুলোর সৃষ্টিশীলতার এ বৈচিত্র্য দেখে জাফর অভিভূত হয়ে যান।
জিএম সাহেব ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত। তাকে দেখলে মনে হবে দুনিয়ায় মানুষ তৈরিই হয়েছে নোট বানানোর জন্য। যে যত ভালো নোট তৈরি করতে পারে তার জন্ম তত সার্থক।
জাফর সাহেবের অমনোযোগিতা তার চোখে পড়ল না। নিজের কথা শেষ হলে তিনি বললেন, 'বুঝলেন জাফর সাহেব নোটটা এমনভাবে তৈরি করেন যেন একবারেই এমডি ওকে করে দেন। তা যদি হয় তাহলে আপনার জন্য দুটো বোনাস। ওয়ার্ড। আর যদি আমাকে দেখার পর তিনটার বেশি কারেকশন করতে হয়, তাহলে এ বছর আপনার নো বোনাস।
বুঝলেন?'
জাফর সাহেব বলেন, 'জি স্যার। '
'পনের মিনিটের মধ্যে চাই। ফিফটিন মিনিটস। তার ওপর নির্ভর করছে আপনি এবার দু-একটা না শূন্যটা বোনাস পাবেন। হা হা হা।
'
'জি স্যার। '
'কোনো জিজ্ঞাসা?'
'জি স্যার। ' 'বলেন। বলেন। ' নোট সংক্রান্ত নির্দেশনার পর কেউ কিছু জানতে চাইলে জিএম খুব খুশি হন।
প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞান ফলানোর সুযোগ থাকে।
'স্যার আপনার শার্টটা...'
'আমার কী?'
'আপনার শার্ট?'
'আমার শার্টের কী হয়েছে?' জিএম সাহেব লাফিয়ে উঠলেন। সিনেমা-নাটকে তিনি দেখেছেন শার্ট তখনই দেখার বিষয় হয় যখন এতে মেয়েদের লিপস্টিকের দাগ থাকে। তাই দিয়ে বউয়ের কাছে লোকজন ধরা পড়ে। খুব ঝামেলা হয়।
তার বউ-ও খুব ঝামেলাবাজ।
এসব জিনিস লেগে থাকে শার্টের পেছন দিকে। তিনি ব্যস্ত হয়ে শার্টের পেছন দিকটা দেখার চেষ্টা করলেন।
জাফর সাহেব বললেন, 'স্যার। না, না অত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।
আমি জানতে চাইছিলাম এই শার্টটা কি অনেক দিনের পুরনো?'
তিনি আবার লাফ দিয়ে ওঠেন, 'কেন ছিঁড়ে-টিড়ে গেছে নাকি?'
'জি না। দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিনের পুরনো। ট্রাংকে ঢোকানো ছিল। ' জিএম সাহেব হা হা করে হেসে উঠে বললেন, 'আরে না। মাত্রই গত মাসে কেনা।
এটা হচ্ছে নতুন ফ্যাশন। এখনকার ফ্যাশন হলো যত পুরনো দেখাবে ততই দামি। '
'আমি আসলে ফ্যাশন সম্পর্কে ঠিক জানি না। '
'তা ঠিক। আপনি জানবেন কীভাবে? হাল আমলের শার্টের ফ্যাশন সম্পর্কে তো আপনার ধারণা থাকার কথা না।
'
'তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে স্যার। ' মুখ ফসকে কথাটা বলেই বিপদে পড়লেন জাফর সাহেব।
'কী ব্যাপার?'
'মানে আমার একটা শার্ট!'
'কী হয়েছে আপনার শার্টের?'
'আমার শালা আমার জন্য কার্ডিফ, মানে ওয়েলস থেকে একটা কালো শার্ট পাঠিয়েছে। '
'আপনার শালা কার্ডিফে থাকে নাকি? গুড। '
'জি আমার স্ত্রী তো অনেক আগেই মারা গেছে।
ওরা আমার খুব খোঁজখবর রাখে। '
'এটাও তো ভালো ব্যাপার। তা শার্ট পাঠিয়েছে এটা তো ভালো খবর। '
'কিন্তু সমস্যাটা হলো স্যার এই কালো শার্টটা পরলে আমি কেমন যেন হয়ে যাই। '
'কেমন মানে?'
'মানে স্যার আমার মাথায় খালি খারাপ চিন্তা আসে।
একে ঠকানো, ওকে ডোবানো। জানেন স্যার, ওই শার্ট পরে অফিসে এসে একদিন আমি ক্যান্টিনে চায়ের টাকা পর্যন্ত মেরে দিয়েছি। তিন কাপ খেয়ে বলেছি দুই কাপ। '
কথাগুলো বুকে এত দিন ধরে চেপে ছিল বলে একটানে তিনি বলে ফেললেন। কিন্তু এখন মনে হলো, ভুল হয়ে গেছে বিরাট।
বিশেষ করে ক্যান্টিনে টাকা মেরে দেওয়ার ব্যাপারটা। জিএম সাহেব কথাটা একে ওকে বলবেন। ছি! ছি! তার নাম হয়ে যাবে 'চা-চোর। ' কিংবা এই জাতীয় অন্য কিছু।
জিএম সাহেব তাকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন, 'শোনেন জাফর সাহেব।
আপনার সমস্যা হলো একাকীত্ব। বউ নেই দশ বছর। মেয়েরও বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। একা একা থাকলে এরকম অদ্ভুত চিন্তা আসে। আমারও একবার হয়েছিল।
ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাগ করে বউ চলে গেল বাপের বাড়ি। সেই সময় প্রতি রাতে একটা ভূতের সঙ্গে আমার দেখা হতো। কাউকে বলিনি। আজ আপনি আপনার সমস্যার কথা বললেন বলে বললাম। তবে ভূতটা ছিল মেয়ে।
সুন্দরী। গান-টানও জানত। দারুণ সময় কেটেছে আমার। তবে খবরদার, এই কথা আর কাউকে বলবেন না। লোকে এসব গল্প শুনতে আর বলতে খুব ভালোবাসে।
কাজ ফাঁকির আরেকটা উপায় পাবে। সাবধান!'
জাফর সাহেব সাহস পেয়ে বললেন, 'তবে ঘটনাটা ঠিক স্যার। '
'ঠিক হলে ঠিক। তাহলে যেদিন কারও ক্ষতি করতে ইচ্ছে হবে, সেদিন ওই শার্ট পরবেন। আমার জন্য অবশ্য সুবিধা হলো, আমি আপনার কালো শার্ট দেখলেই বুঝব আজ ঝামেলা করবেন।
আপনার কাছ থেকে দূরে থাকব। হা হা হা। চা হবে নাকি এক কাপ?'
'না স্যার। নোটটা বানিয়ে নিই। অফিস আওয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে।
'
তিনি ফিরে এসে অবশ্য নোট নিয়ে খুব ভাবতে পারলেন না। বারবার মনোযোগ অন্যদিকে চলে গেল। জিএম সাহেব নোটটা হাতে নিয়ে ছয়টা লাল দাগ দিলেন। তারপর বললেন, 'জাফর সাহেব। আপনি বাসায় চলে যান।
রেস্ট নিন। যে কোনো জিনিস নিয়ে বেশি ভাবতে নেই। এটা হলো আপনার মনের সমস্যা। '
জাফর সাহেব মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি জানেন সমস্যাটা এত সামান্য নয়।
তিনিও প্রথমে জিএম সাহেবের মতো ভেবেছিলেন। কিছুদিন কালো শার্টটা পরা বন্ধ রাখলেন। তারপরই শুরু হলো আসল সমস্যাটা। একটা সাদা শার্ট পরে বেরিয়ে খেয়াল করলেন, তার মন অস্বাভাবিক রকম উদার। তার খুব খুশি লাগল।
যাক, তাহলে মাথা থেকে কুচিন্তাগুলো গেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই অন্য সমস্যা। ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশাটা দাঁড়িয়েছিল। একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল, তিনি পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা দিতে শুরু করলে এরপর কী কী হয় সেটা তার অজানা ছিল না।
ঝাঁকে ঝাঁকে ভিক্ষুক এসে হাত পাতল তার সামনে। তার বিরক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বিরক্তিবোধ আসে না। খালি হাত চলে যায় পকেটে। তিনি পকেটে যা ছিল তা বের করে ওদের দিতে শুরু করেন।
একসময় ট্রাফিক সিগন্যালের সবুজ বাতি জ্বলল। তার খুব আফসোস হলো, ইস আরও কিছুক্ষণ থাকলে আরও কিছু মানুষকে ভিক্ষা দেওয়া যেত। পরের ট্রাফিকে দাঁড়াতেই তিনি পকেট থেকে টাকা নিয়ে ভিক্ষুকদের ডাকতে শুরু করলেন। রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল, 'স্যার একটা কথা কই! এদের টাকা দিয়ে লাভ নেই। '
তিনি কিছু বললেন না।
রিকশাওয়ালা আরও বিরক্ত, 'এরা স্যার টাকা নিয়ে ডাইল খায়। ভিক্ষা চায় কিন্তু কাজ করতে বলেন, দেখবেন দৌড় লাগাবে। আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলি টাকার জন্য আর এই বদমাশেরা...। শালাদের ভাগ্যও, আপনাদের মতো সরল মানুষদের পেয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। '
রিকশা আবার চলতে শুরু করেছে।
জাফর সাহেবের এখন চিন্তিত হওয়ার কথা। কারণ পকেটের সব টাকা শেষ করে ফেলেছেন। রিকশা ভাড়াও পকেটে নেই। রিকশাওয়ালা এমনিতেই যেমন ক্ষেপে আছে, দু'কথা শুনিয়ে দেবে নিশ্চিত। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন তার তেমন দুশ্চিন্তা হচ্ছে না।
রিকশাওয়ালাকে তিনি হাতের ঘড়িটা দিয়ে দেবেন। দামি সিকো ফাইভ ঘড়ি। তার শ্যালিকা পাঠিয়েছিল কানাডা থেকে। কোনো অসুবিধা নেই।
অফিসের কাছে রিকশা থেকে নেমে তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, 'শোনো একটা সমস্যা হয়েছে।
আমার পকেটে কোনো টাকা নেই। তবে অসুবিধা নেই, হাতে তো ঘড়ি আছে। এটা তোমার। '
রিকশাওয়ালা হা হয়ে চেয়ে থাকল।
জাফর সাহেব বললেন, 'অবশ্য তুমি যদি টাকা চাও তা হলেও সমস্যা নেই।
এই ঘড়িটা রাখো। আমি আমার বাসার ঠিকানা দিচ্ছি। সন্ধ্যার পর চলে এসো। তখন টাকা দিয়ে দেব। আর ঘড়িটা তোমার।
'
রিকশাওয়ালা তাকে অবাক করে দিয়ে কেঁদে ফেলল। বলল, 'স্যার আমার টাকা-ঘড়ি লাগবে না। আপনার মতো মানুষ এখনো জিন্দা আছে দেখেই ভালো লাগল। ঠিকানা দেন স্যার, একদিন সুযোগমতো আমার বউটাকে নিয়ে আপনার পা ধরিয়ে সালাম করিয়ে আনব। ওর ধারণা এই দুনিয়ায় এখন একটাও ভালো মানুষ নেই।
'
জাফর সাহেবের কিছু বলার থাকল না। রিকশাওয়ালাকে জড়িয়ে ধরে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আর তার মনে হলো, এ সবই সাদা শার্টের কারণে। কালো শার্ট পরলে খালি দুষ্টবুদ্ধি আসে। সাদা শার্ট পরলে আসে উদারতা।
এরপর একে একে তিনি জেনে গেছেন কোন শার্ট পরলে কী হয়। পরদিন পরলেন লাল শার্ট। তার সারা দিন খালি গান গাইতে ইচ্ছা করল। এরপর নীল শার্ট, সেটা পরার পর আর হাসি আসে না। সারা দিন গম্ভীর হয়ে থাকেন।
জলপাই রঙের একটা শার্ট ছিল পুরনো, পরীক্ষামূলকভাবে সেটাও পরা হলো। দেখা গেল, সেদিন তার শুধু গাছের কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। প্রকৃতিপ্রেম তৈরি হয় ভীষণ। তিনি রমনা পার্কে গিয়ে বসে থাকলেন। প্রকৃতিপ্রেম সংক্রান্ত কবিতা মাথায় আসতে থাকল একের পর এক।
তিনি দু-একটা আবৃত্তিও করলেন উঁচু গলায়। পাশে লোক জমে গেল।
আজ জাফর সাহেবকে প্রখ্যাত মনস্তাত্তি্বক ড. এজাজুল বারীর চেম্বারে আসতে হয়েছে। তিনি যে খুব আসতে ইচ্ছুক ছিলেন এমন নয়। কিন্তু মেয়ে টুম্পা একেবারে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে।
টুম্পা স্বামীসহ থাকে পল্লবীতে। বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু জাফর সাহেব রাজি হননি। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে রান্নাবান্না করে সে হাজির হয় বাবার বাসায়। ছেলে-মেয়েকে রেখে আসে শাশুড়ির জিম্মায়। তার বক্তব্য এই একদিন সে মা নয়, স্ত্রী নয়, শুধু মেয়ে।
বাবার মেয়ে। সত্যিই এসে মেয়ে হয়ে যায়। বায়না ধরে কিশোরবেলার মতো। সারা রাত কেটে যায় গল্পে-গল্পে। গত সপ্তাহে সে প্রথম খেয়াল করে বাবার আচরণটা কেমন যেন অদ্ভুত।
তা ছাড়া প্রচুর নতুন শার্ট কিনেছেন। টুম্পা আশ্চর্য হয়, সঙ্গে খুশিও। বাবা নতুন শার্ট কিনছেন, সেজেগুজে থাকছেন, এর মানে কী? বাবার তাহলে কাউকে পছন্দ হয়েছে! হলে দারুণ হয়। মা মারা যাওয়ার পর টুম্পা অনেক চেষ্টা করেছে বাবাকে আরেকবার বিয়ে করানোর। তার এক বিধবা ফুপু শাশুড়িকে নিজে প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিল।
বাবা রাজি হলেন না। এখন যদি নিজে কাউকে পছন্দ করেন, তাহলে তো সমস্যার কিছু নেই। টুম্পা বলল, 'বাবা নতুন অনেক শার্ট যে...। ব্যাপার কী?'
'ব্যাপার কিছু না রে মা। '
'আমার তো অন্য ব্যাপার মনে হচ্ছে।
'
টুম্পার মন-মেজাজ জানেন বলে জাফর সাহেব ইঙ্গিতটা ধরতে পারলেন। আর তাই ব্যাপারটা যেন অন্যদিকে না যায়, সে জন্য খুলে বললেন পুরো ব্যাপারটা। এমনিতেও মেয়ের কাছে তিনি কিছু লুকাতে পারেন না।
এটা জানার পর যে কোনো মেয়েই বাবার চিকিৎসার উদ্যোগ নেবে আর টুম্পা হলো সেই মেয়ে যে বাবার দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত রাজি। কাজেই এমন জোরাজুরি শুরু হলো যে, তিনি না করতে পারলেন না।
ওদিকে বিদেশে থাকা শ্যালক-শ্যালিকাদের কাছে খবর চলে গেছে। আজ সকালে ছোট শ্যালিকা ফোন করে বলেছে, 'তিনি ডাক্তারের কাছে না গেলে সে আর তার সঙ্গে কথা বলবে না। '
তাই তিনি এসেছেন। লম্বা সিরিয়াল থাকার কথা কিন্তু টুম্পার ভাসুর ড. এজাজের বন্ধু বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক পড়ল।
ড. এজাজের বয়স পঞ্চাশের মতো।
কথা বলতে শুরু করলে আরও কম মনে হয়। খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলেন যেন দেরি করলে ভুলে যাবেন।
হাসতে হাসতে বললেন, 'আপনার সমস্যার পুরোটা আমি শুনেছি। নতুন করে কিছু বলতে হবে না। আচ্ছা এই মেরুন শার্টটা পরলে আপনার কী যেন হয়?'
'লেখালেখির ইচ্ছা হয়।
'
'কী লিখতে চান?'
'গল্প। '
'কবিতা লেখার জন্য কি আবার আলাদা শার্ট?'
'শার্ট না পাঞ্জাবি। '
'ও বাবা পাঞ্জাবি পর্যন্ত চলে গেছে নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম শুধু শার্টেই আছে। ' ড. এজাজ হাসেন। আত্দবিশ্বাসী ভঙ্গি।
তাই হওয়ার কথা। এর চেয়েও জটিল রোগ তিনি সারান। শার্টের সমস্যা তো তার কাছে সামান্যই মনে হওয়ার কথা। হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, 'এক কাজ করুন। আপনি শার্টটা খুলে ফেলুন।
'
জাফর সাহেব নির্দ্বিধায় শার্টটা খুলে ফেললেন।
ড. এজাজ বললেন, 'এখন কীরকম লাগছে? কী করতে ইচ্ছে করছে?'
'তেমন কিছু না কিন্তু...'
'কিন্তু কী?'
'একটু ভয় ভয় লাগছে। '
'কী রকম ভয়?'
'মনে হচ্ছে আমি একা। যে কোনো সময় কোনো বিপদে পড়ব। কেউ বাঁচাতে আসবে না।
' ড. এজাজ আবার হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, 'ঠিক আছে। ঠিক আছে। আপনার বিপদে বাঁচানোর লোক আছে। আমি আছি।
আর টুম্পা তো আছেই। '
একটু কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর পিয়নকে ডেকে বললেন, 'এই আফজাল আমার টি-শার্টটা নিয়ে আয় তো। '
আফজাল একটা টি-শার্ট নিয়ে এলো। ড. এজাজ সেটা জাফর সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'নিন, এটা পরুন।
'
জাফর সাহেব এবারও নির্দ্বিধায় নিজের শার্টটা খুলে টি-শার্টটা গায়ে দিলেন।
ড. এজাজ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, 'এবার কেমন লাগছে?'
'খেলতে ইচ্ছে করছে। '
'কী খেলতে? নির্দিষ্ট কিছু_ ফুটবল, ক্রিকেট...'
'যে কোনো কিছু। খুব খেলতে ইচ্ছে করছে। ' বলেই তিনি সামনে রাখা পেপারওয়েটটা নিয়ে ওপরে তুলে ক্যাচ ধরার চেষ্টা করলেন।
টুম্পার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ড. এজাজ তবু হাসলেন। এই হাসি আরও অনেক বেশি আত্দবিশ্বাসের। বললেন, 'ঠিক আছে। ঠিক আছে।
টি-শার্টটা বদলে ফেলুন। আরও কিছুক্ষণ এই টি-শার্ট থাকলে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে বঙ্ংি খেলা শুরু করতে চাইবেন। '
জাফর সাহেব টি-শার্টটা খুলে ফেললেন।
ড. এজাজ আবার তার পিয়ন আফজালকে ডাকলেন। সে এলে বললেন, 'তুমি স্যারকে নিয়ে বাইরে বসাও।
কফি খাওয়াও। আর টুম্পা কিছুক্ষণ থাকো। '
জাফর সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ঘর থেকে বেরোতেই টুম্পা কেঁদে ফেলল, 'আংকেল, বাবার কি সিরিয়াস কিছু হয়েছে? বিদেশে নিয়ে যাব?'
ড. এজাজ হাসতে হাসতে বললেন, 'আরে দুর। বিদেশে কেন? আমার কাছে নিয়ে আসারই কোনো দরকার ছিল না।
'
'মানে?'
'সামান্য সমস্যা। উনার হয়েছে কি, উনি একটু মনোযোগ পেতে চান। এই বয়সে একা থাকা মানুষ একটু মনোযোগ চায়। গুরুত্বপূর্ণ হতে চায়। সেই গুরুত্ব পাওয়ার জন্য...।
'
'বাবা কি তাহলে এগুলো বানিয়ে বলছেন?'
'পুরোটা বানিয়ে না। মানুষের কনশাস এবং সাব-কনশাস কখনো কখনো এক হয়ে যায়। উনার হয়তো কালো শার্ট পরার পর যে কোনো কারণেই প্রথম খারাপ একটা কথা মাথায় এসেছিল। তাই এর পর থেকে ধরে নেন কালো শার্টেই সমস্যা। সে সমস্যার কারণেই সাদা শার্টকে মনে হলো উল্টো।
তারপর নিজের মধ্যেই তৈরি হতে থাকল শার্টগুলোর বৈশিষ্ট্য। '
'আপনি শিওর আংকেল?'
'মোর দ্যান হান্ড্রেড পার্সেন্ট। এই যে দেখো উনি যে গল্পগুলো বলেন সেগুলো কিন্তু স্বাভাবিক। ধরো আমরা সবাই মনে করি কালো রং খারাপ, কাজেই কালোর ক্ষেত্রে তার গল্প হলো খারাপের গল্প। সাদা মানে মনে করি পরিষ্কার, কাজেই সাদা মানে উদারতা।
জলপাই হলে প্রকৃতিপ্রেম। লাল হলে উচ্ছ্বাস। আবার দেখো, আমার এখানে খালি গা হলে তার মনে হলো তিনি অসহায়। আবার টি-শার্ট পরাতে মনে হলো খেলার কথা। '
যুক্তিটা টুম্পার খুব মনে ধরল।
বলল, 'তাহলে আংকেল এখন কি বিশ্রাম নিতে বলব? নাকি কোথাও থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব?'
'আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি নার্ভ রিলাঙ্ রাখার জন্য। আর বেড়িয়ে আসো। সেটাও খারাপ হবে না। '
ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি আবার রোগী দেখায় মন দিলেন। আফজাল এসে বলল, 'স্যার এটা আপনার?'
একটা পুরনো প্যাকেট, ভেতরে কাপড় জাতীয় কিছু আছে বলেই মনে হলো।
প্যাকেটটা খুলে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, 'ওই যে একজন মহিলা যে ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছিলেন উনি রেখে গেছেন। বলেছিলেন আপনাকে দিতে। '
ড. এজাজ খুব একটা অবাক হলেন না। এ ধরনের রোগীরা নিজের বিশ্বাসে এত অটল থাকে যে, ডাক্তারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যায় কোনো না কোনোভাবে। তিনি অবশ্য সেগুলোকে ফেলনা মনে করেন না।
পরীক্ষা করে দেখেন। এই কালো শার্টটাও তিনি একবার পরে দেখবেন।
রোগীদের খুব চাপ ছিল। ঘণ্টা দেড়েক মাথা তোলারই সময় পেলেন না। ঠিক ৬টার পর তিনি পনের মিনিট বিশ্রাম নেন।
এক কাফ ব্ল্যাক কফি খান। রবীন্দ্রসংগীত শোনেন একটা। তারপর আবার রোগী দেখা। এটা সব সময়ের রুটিন। আজ এই ফাঁকে আরেকটা কাজ করলেন।
নিজের শার্টটা বদলে জাফর সাহেবের কালো শার্টটা পরে ফেললেন। কিছুক্ষণ পরে থাকবেন। তিনি জানেন পুরো জিনিসটা ভুয়া, তবু জাফর সাহেব যদি আবার ফিরে আসেন তাহলে কাজে লাগবে।
৬:২০ মিনিটে দ্বিতীয় দফা রোগী আসা শুরু হলো। এর সমস্যা হলো, নিজের জীবিত বাবাকে সব সময় তার মৃত মনে হয়।
বাবা দিব্যি ঘরে শুয়ে আছেন কিন্তু তার মনে হয় বাবা মারা গেছেন। তারপর যখন বাবাকে দেখে তখন চিৎকার করে ওঠে।
খুব কঠিন কোনো ব্যাপার না। তিনি তার গল্পগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কিছু পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
বিশ্বাস তৈরি করতে হা হা করে হাসলেন বারবার।
তারপর প্রেসক্রিপশনটা লিখতে বসলেন। সামান্য দু-একটা পরামর্শ দেবেন। কিন্তু লিখতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, তার মন বলছে কয়েকটা পরীক্ষা দেওয়ার কথা। সেটা আবার এমন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেখান থেকে তিনি পার্সেন্টেজ পান।
কী আশ্চর্য, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েকটা অকারণ পরীক্ষা লেখা হয়ে গেল কাগজে। তারপর কয়েকটা দামি ওষুধ, সেই কোম্পানির ওষুধ যে কোম্পানির সঙ্গে তার খুব ভালো খাতির। এমন তো তার কখনো হয় না। একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তার পার্টনারশিপ আছে কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে তিনি পরীক্ষা দেন না। ওষুধও লিখেন শুধুই প্রয়োজনমতো।
আজ তাহলে হলোটা কী?
প্রেসক্রিপশনটা ছিঁড়তে ইচ্ছা হলো কিন্তু পারলেন না। বরং কীভাবে কীভাবে যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, 'যান জরুরি ভিত্তিতে এই পরীক্ষাগুলো করান। তারপর রিপোর্ট নিয়ে পরশু আবার আসুন। কিছু চিন্তার ব্যাপার আছে। '
ওরা চলে গেলে খুব অস্থির লাগে তার।
এটা কী হচ্ছে? নিজের ক্ষেত্রে তিনি জিনিয়াসেরও বেশি কিছু, সামান্য শার্টের ক্ষমতা মানার প্রশ্ন নেই। কিন্তু ঘটনা তো এমনই ঘটছে।
কফি খেয়ে ভাবতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। রোগীর সিরিয়াল বন্ধ করতে আফজালকে ডাক দেন। আফজাল আসতেই তার মনে হয়, এই ব্যাটা তাকে ঠকাচ্ছে নিশ্চিত।
একে বরখাস্ত করতে হবে। নতুন লোক নিতে হবে। নতুন লোক নেবেন, কয়েক মাস পর বাদ দেবেন। অলি-গলি বোঝার আগেই বিদায় করতে হবে এসব বদমাশকে।
তিনি ধমক দিলেন, 'এতক্ষণ ছিলি কোথায়?'
'এখানেই তো স্যার।
' আফজাল অপরাধটা ঠিক বুঝতে পারে না।
'আবার মুখে মুখে কথা। বদমাশ কোথাকার? যা। '
আফজাল হতভম্ব হয়ে বেরিয়ে যায়।
পরের রোগী ঢোকে।
দেখেই তার মনে হয়, আরে দারুণ তো। মালদার পার্টি মনে হচ্ছে। খসাতে হবে।
গভীর রাতে একটা ফোন আসে ড. এজাজের কাছে। টুম্পা উত্তেজিত গলায় বলল, 'আংকেল ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ। '
ড. এজাজ বুঝতে না পেরে বলেন, 'কী ব্যাপার টুম্পা। '
'আংকেল বাবা পুরো স্বাভাবিক। সব ঠিক হয়ে গেছে। উনিই আপনাকে ধন্যবাদটা দিতে বললেন।
আংকেল আপনি সত্যিই জিনিয়াস। '
ড. এজাজ গম্ভীর গলায় বলেন, 'তোমার বাবাকে নিয়ে এসো। তার সঙ্গে কথা আছে। '
'আসব। আসব।
বাসায়ই চলে আসব। আপনি সত্যিই অসাধারণ। অন্য দেশে হলে আপনাকে নোবেল দিয়ে দিত। '
টুম্পা আরও নানা উচ্ছ্বাস দেখাতে থাকে। আর জিনিয়াস ড. এজাজ হতভম্ব হয়ে বসে থাকেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।