ভাবনাতীত অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, গুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভোট বর্জন ও গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে গতকাল সম্পন্ন হয়েছে চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচন। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত চারজন। মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় দল-সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থক এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, ঝালকাঠিতে যুবলীগ নেতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিজিবির গুলিতে যুবদল নেতা ও কুমিল্লায় পুলিশের গুলিতে হতভাগ্য রিকশাচালক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর স্ত্রী। সারা দেশে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন তিন শতাধিক।
এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়েছে অন্তত ১০ জন। তবে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কেন্দ্র দখল, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জিম্মি ও মারধর, পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে নিজ প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরেছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- মুন্সীগঞ্জ : গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কেন্দ্রে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলযোগ। এখানে সংঘর্ষ হয় আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ।
এ সময় বিদ্রোহী প্রার্থী রেফায়েত উল্লাহ খান তোতার সমর্থকদের হামলায় নিহত হন কেন্দ্র-সমর্থিত প্রার্থী আমিরুল ইসলামের সমর্থক সামসুদ্দিন প্রধান। এ সময় তার তিন ভাতিজা আল-আমিন, জুয়েল, লিটু এবং অন্যরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে প্রতিপক্ষের লোকজন গুলি ছোড়ে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। নিহত সামসুদ্দিন বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বড় রায়পুুরা ভোটকেন্দ্রের পাশে সামসুদ্দিন প্রধান আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আমিরুল ইসলামের পক্ষে তদারক করার সময় বিদ্রোহী প্রার্থী তোতার সমর্থকরা হঠাৎ তার ওপর হামলা চালিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে।
পরে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে চিকিৎসকরা সামসুদ্দিন প্রধানকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তেতুইতলা এলাকাবাসী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাখি পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। গোলযোগের কারণে এখানে সাতটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়।
এদিকে মধ্য বাউশিয়া কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজন কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করলে উভয় পক্ষে গোলাগুলি হয়। এ সময় অন্তত ২০ জন আহত হন। এ ছাড়া বিকালে ফের সংঘর্ষে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল মান্নান দেওয়ান মনার স্ত্রী লাকী বেগম (৩২) গুলিবিদ্ধসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন। ঝালকাঠি : রাজাপুরে উপজেলা নির্বাচনে এক যুবলীগ নেতা নিহত হয়েছেন। নিহতের নাম রিপন (২৮)।
তিনি উপজেলার তারাবুনিয়া গ্রামের আবদুস সোবাহানের ছেলে। বেলা ১১টায় তারাবুনিয়ায় নির্বাচনী কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা রিপন ও কর্মী নাসের, রাজা, মুছা, লোকমান, রুহুলসহ ১০ জন আহত হন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে জেলার নাসিরনগর ও আখাউড়া উপজেলা নির্বাচন গতকাল সম্পন্ন হয়েছে। আখাউড়া উপজেলায় ভোট চলাকালে বিজিবির গুলিতে নিহত হয়েছেন উপজেলা যুবদল নেতা হাদিস মিয়া (৪৫)।
উপজেলার তারাগন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। সরকারদলীয় লোকজন কেন্দ্রের ভেতর জোরপূর্বক সিল মারছে এমন খবর পেয়ে বিএনপি কর্মীরা ঢোকার চেষ্টা করলে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-সম্পাদক হাদিস মিয়া গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া একই ঘটনায় আরও কয়েকজনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
তবে বিজিবির ভাষ্যÑ বিএনপি কর্মীরা ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে গুলি ছোড়া হয়। অন্যদিকে নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের শ্রীঘর দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্রীঘর উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বভাগ এসইএসডিপি উচ্চবিদ্যালয়, চান্দেরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাঁতমণ্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কমপক্ষে ১৫টি কেন্দ্রে সকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন প্রতিপক্ষের লোকজনকে কেন্দ্র থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। কুমিল্লা : জেলার বরুড়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন মনির হোসেন (২৫) নামের এক রিকশাচালক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মনির মহেশপুর ভোটকেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুর্বৃত্তরা ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের গুলি ছোড়ে।
সেখান থেকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সময় মনিরের কোমরে এসে দুটি গুলি লাগে। প্রথমে বরুড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তার মৃত্যু হয়। বরুড়া পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন পাটোয়ারী দাবি করেন, নিহত মনির হোসেন যুবদল কর্মী ছিলেন। এদিকে বরুড়ার দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম মিঠুকে আটক করেছে যৌথবাহিনী।
বরুড়ার কাদবা তলাগ্রাম তারিনী লাহা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ১ হাজার ২০০ ব্যালট পেপার ছিনতাই করা হয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসার মহিউদ্দিন মো. শাহজাহান এতে বাধা দিলে তার ওপর হামলা করা হয়। এতে তার মাথা ফেটে যায়। পরে কেন্দ্রটি স্থগিত করা হয়। আদমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুল মান্নানকে লাঞ্ছিত করে ১ হাজার ২০০ ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরা হয়।
পূর্ব নলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ফখরুদ্দিন জানান, একদল দুর্বৃত্ত তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৮০০ ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে প্রবেশ করায়। পাবনা : ঈশ্বরদী উপজেলার সরাইকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে জামায়াত ও আওয়ামী লীগের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই শিবির কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জামায়াত দাবি করলেও পুলিশ এ ঘটনা অস্বীকার করেছে। গুলিবিদ্ধ দুই শিবির কর্মী ছইমুদ্দিন (২২) ও মুনির উদ্দিনকে (২৫) পাবনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কক্সবাজার : কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাচন শেষ হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম আর কেন্দ্র দখলের মধ্য দিয়ে।
ব্যালট পেপার ও বাক্স ছিনতাইকালে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনজন। আলী ফকির ডেইল, তেলিয়াকাটা, মধন্যাপাড়া, দক্ষিণ ধরুং, পূর্ব ধরুং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলে নিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম সিকদারের সমর্থকরা। এ অভিযোগ করেছেন জামায়াত ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী যথাক্রমে শাহারিয়ার চৌধুরী ও এ টি এম নুরুল বশর চৌধুরী। কুতুবদিয়ার উত্তর লেমশিখালী, পশ্চিম লেমশিখালী ও বাঁকখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ছিনতাই করে নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থীর লোকজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগে তিনজনকে আটক করেছে।
পশ্চিম লেমশিখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাইকালে পুলিশের গুলিতে তিনজন আহত হন। কুষ্টিয়া : ব্যাপক কারচুপি, জাল ভোট প্রদানসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। একটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে সাতজন আহত হন। এ ছাড়া অপর একটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের হামলায় দুই বিএনপি নেতা আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া এসব ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। আল্লার দর্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঘোগা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ৪০টি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট কেটে নেওয়া হয়। নোয়াখালী : বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ভাঙচুর ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্র্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হন। এসব ঘটনায় তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়।
সকালে হাজিপুর ইউনিয়নের আবদুল মজিদ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ৯১টি ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়ার পর সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। যশোর : সদর ও কেশবপুর উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট চলাকালে সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মহিলাসহ অন্তত আটজন আহত হয়েছেন। আহতদের সবাইকে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতরা হলেন খোলাডাঙ্গা এলাকার আনোয়ার ও শিরিন; রামনগরের জাহিদ, আমবটতলার শাহাদত ও রহিম মল্লিক; পুরাতন কসবা এলাকার ইসমাইল ও গফুর এবং এনায়েতপুরের সাইদুর।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।