বিয়ে মানে যে স্বাধীনতার সূর্য চিরতরে অস্তমিত যাওয়া তা টের পাওয়া যায় একেবারে প্রথম রাতেই। যে মানুষ জীবনের পঁচিশ-ত্রিশটি বসন্ত কাটিয়ে দেয় ”খোলা মানুষ” হিসেবে সেই মানুষটিই প্রথম বারের মতো শোবার ঘরের দরজা করে ঘুমাতে যায়। জানালার পর্দ খোলা না থাকলে যার দম বন্ধ বন্ধ লাগে সেও পর্দা ঠিক মতো টেনে দেয়। তারপর বাকি জীবন মশারি টানানো, আড্ডার উপর ১৪৪ ধারা জারি, স্টার জলসা আর টেন এ্যাকশন নিয়ে টানাপোড়েনতো আছেই।
আর সেই বিয়ে যদি হয় প্রেমের পরিণয়, তাহলেতো আম-ছালা দুটিই হাওয়া।
প্রেম খুব স্বাস্থ্যকর একটা জিনিস। কিন্তু জ্ঞানী-গুণীরা বলেন, প্রেম চর্চা মহাচর্চা যদি না কর বিয়ে। প্রেম সম্পর্কে তাঁদের বিবেচনা হচ্ছে প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই প্রকৃত প্রেম, আর প্রতিটি সফল প্রেম হলো বায়োলজির ক্লাশের মতো প্রেমের ব্যবচ্ছেদ। এবং প্রেমের বিয়ে সম্পর্কে ভাবতে গেলেই মনে পড়ে রেসলিং এর ফাকে ফাকে দেখানো একটা সচেতনতা মূলক প্রচারণার কথা। যে প্রচারণার শেষ লাইনটা ছিল এরকম--Please, don’t try this at home! প্রেমটাকে নাটকে দেখ, নভেলে পড়, প্রয়োজনে তুমি নিজেই কর; তবে প্রেম আগানে হোক, প্রেম বাগানে হোক; প্রেম ভার্সিটিতে হোক, আর ফাস্টফুডেই হোক, কিন্তু কথা ওই একটাই--Please, don’t try this at home!
বিয়ে, প্রেম এবং প্রেমের বিয়ে নিতে এত কথা, এ সবই আরাফাতকে উৎসর্গ করে বলা।
অফিসে একমাত্র সৎ ও যোগ্য পাত্র হলো এই আরাফাত। শুনেছি বাড়িওয়ালার কাছে ব্যাংকার ভাড়াটিয়ার খুব ডিমান্ড। এবং পাত্রী বা তার পক্ষের কাছে নাকি ব্যাংকার পাত্রের ডিমান্ড বাড়িওয়ালার চেয়েও আরও বেশী। ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তাই নিজের ”বাজারমূল্য” সম্পর্কে কোন সম্যক ধারনা নেই। এমনকি কখনও কখনও ব্যাংকারের এই ডিমান্ড নাকি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের চেয়েও বেশী।
আমরা যারা ইতিমধ্যে লাড্ডু খেয়ে বসে আছি এই সৎ ও যোগ্য পাত্র আরাফাতকে যে যার মতো করে বোঝাচ্ছি লাড্ডু কত প্রকার ও কী কী। সে ইতিমধ্যে বুঝতে শুরু করেছে যে লাড্ডু খাওয়াতো পরের কথা, লাড্ডু খেতে চাওয়াই কম পস্তানো নয়। যে খ্যাতির কিছু বিড়ম্বনা থাকে তা থেকে আরাফাতকে মোটেই রেহাই দিচ্ছিনা।
কোন সুন্দরী ইন্টার্ন, রূপসী কাস্টমার, তরুণী অনুসন্ধর্থী--কিছ্ ুএকটা পেলেই তার সাথে জুড়ে দিই আরাফাতের নাম। আরাফাত একদিন শেভ না করে আসলেও হিট, একদিন নতুন টাই পড়লেও হিট, ডায়েট করলেও স্টার, একটু মুটিয়ে গেলেও হিরো।
আমাদের চাকরির ৩ বছর পূর্তিতে হঠাৎ খেয়াল করলাম--৩ বছর আগে যখন আমরা ব্যাংকে যোগদান করলাম আমাদের দু’জনেরই যোগ্যতা সমান--বিবিএ পাশ টগবগে তরুণ। এই ৩ বছরে আমি এমবিএ করলাম, বিয়ে করলাম, ব্যাংকিং ডিপ্লোমা করলাম, বাবা হলাম। আর আরাফাত এখনও একজন বিবিএ।
তবে আরাফাত আদাজল খেয়েই লেগেছে। গত ৩ বছরে যা পারেনি তা করে দেখাবে আগামী ১ বছরে।
ঠিকই আরাফাত পরবর্তী এই ১ বছরে এমবিএটা শেষ করলো, এমবিএ করতে যেয়ে প্রেমটাও সেরে ফেললো, ব্যাংকিং ডিপ্লোমা শেষ করলো, আইসিএমএতে ভর্তি হলো। ১ বছর হতে বাকি দিন গুলিতে বিয়েও করবে এবং হয়তো হবে বাবাও।
সেই এক বছর হতে আর মাস আটেক আছে। বাবা হওয়া একদম অসম্ভব নয়। সেই আজ থেকে দু হাজার বছর আগেও পিতা-মাতা হতে নয়-দশ মাস সময় লাগতো আর এই আধুনিক যুগেও নয়-দশ মাসই লাগবে তা আজকালকার আধুনিক পিতা-মাতারা কেউ কেউ মানতে নারাজ।
অফিসের এক সহকর্মী বিয়ের সাড়ে আট-ন’ মাসে বাবা হলো, এক বন্ধুর মামাতো ভাই এবং আরেক বান্ধবী বিয়ের ন’মাসেই সন্তানের মুখ দেখলো। ওগুলো সব অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। তাই সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যেটুকু বলা যায় তা হলো ’গুলি’ একটাও মিস যায়নি। আর কিংবদন্তী যতই বলুক ’দশ মাস দশ দিন’ ’দশ মাস দশ দিন’ প্রকৃতপক্ষে এটা ১০ দিন কম বেশী ২৭০ দিন।
অতএব ৯ মাসই যথেষ্ট।
তাই বলে সাড়ে সাত মাস? বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দূরসম্পর্কের বান্ধবী এই কৃতীত্বের অধিকারী। ওর অবশ্য প্রেমের পরিণয়। প্রেমের বিয়েতে যেহেতু সাড়ে সাত মাসের নজির আছে, আরাফাতকে নিয়ে আমি আশাবাদী।
আরাফাত বছরখানেক ধরে প্রেম করছিল।
জাহাঙ্গীর নগরে সান্ধ্যকালীন এমবিএ করতে যেয়েই প্রণয়, যা এগুচ্ছে পরিণয়ের দিকেই। আর এ উপলক্ষে আমরা যারা এই লাইনে তিন-চার বছরের অভিজ্ঞ তারা এমন একটা মোক্ষম উপলক্ষ পেয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ হাতছাড়া করছি না।
আরাফাত ফিনান্স মেজর। আমি ম্যানেজমেন্টের। ও সুযোগ পেলেই বলার চেষ্টা করে ম্যানেজমেন্টের চেয়ে ফিনান্স কত মহান।
আর এখন আমি সুযোগ পেলেই ওকে ফিরিয়ে দিই ঘাতক কাটা, ওকে বলি, বিয়ে করলেই বুঝবে অনেক জিনিসই আছে যা টাকায় হয় না, হয় যথাযথ ব্যাবস্থাপনায়। বুঝবে ম্যানেজমেন্ট ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান ফিনান্স।
যারা এখনও আরাফাতের ’ইয়ে’র ব্যাপারটা জানেনা তারা এখনও তার বিয়ের ব্যাপারে দু’একটা পাত্রী-টাত্রীর কথা বলছে। কার শালীর ননদ, কার বোনের বাসার ভাড়াটিয়ার মেয়ে, কার গার্লফ্রেন্ডের বান্ধবীর বোন... এরকম অনেক আছে। তবে আজকাল এ্যারেঞ্জড ম্যারেজ আসলেই একটা অসাধ্য সাধন।
ভার্সিটি পড়–য়া একটা সুন্দরী মেয়ে মানেই তার প্রেমের বয়স বছর পাঁচেক। আর প্রেম করে না মানে মনে সন্দেহ জাগে কোথাও কোন সমস্যা নেই তো?
দু-চার বছর প্রেম করে বিয়ে করলে এর মধ্যেই একে অপরকে জানা বোঝার সময় পায়। কোন ঘাটতি মেনে নেবার মানসিকতা তৈরী হয়, অথবা একেবারেই না পোষালে সময় সুযোগ থাকে এমনকি সঙ্গী পাল্টে নেবার। অ্যারেঞ্জড বিয়েতে সেই সুযোগ না থাকাতে লোকজন চেষ্টা করে এক গুলিতেই সব পাখি শিকার করতে। হাজারো তুচ্ছ বিষয় তখন হয়ে ওঠে মুখ্য।
এসএসসিতে মেয়ের জিপিএ কম, মেয়ের চাচার দুই বিয়ে, মেয়ের বাবা কাস্টমস অফিসার, হাসি দিলে দাঁতের মাড়ি দেখা যায়, মেয়ের মা এসএসসি পাশ ইত্যাদি হাজারো সমস্যা। মুরুব্বিদের ঘুম হারাম।
তাই এখন অনেক বাবা-মা’রাও চান ছেলে-মেয়ে ”একটু দেখে-শুনে” প্রেম করেই বিয়ে করুক। যখনএখনও কিছু এ্যারেঞ্জড বিয়ে হচ্ছে। তবে আমার মনে হয় এ্যারেঞ্জড বিয়ের এরাই শেষ প্রজন্ম।
এ্যারেঞ্জড বিয়ের সোনালী প্রজন্মের এক প্রতিনিধি তাঁর নিজের বিয়ের সময় মুরুব্বিদের কাছ থেকে শেখা এক টোটকা আরাফাতকে শিখিয়ে দিল--তোমার বোনকে বিয়ে দাও তোমার চেয়ে উচু পরিবারে আর তুমি বিয়ে কর তোমার চেয়ে একটু নিচু পরিবারে। কারণ সমান সমান হলেই নাকি তাল মেলানো কঠিন। আর বউ যদি একটু উচু হয় তাহলে নাকি উচু করে রাখতে রাখতে আজীবনের জন্য ঘাড় ব্যাথা হয়ে যাবে।
তবে এসব পরামর্শ-উপদেশ, কবরেজি-হাকিমি কোন চিকিৎসাতেই কাজ হবে না যদিনা সঠিক সময়ে সঠিক রসায়ন হয়। হিসাববিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ’প্রতিটি লেনদেনই স্বয়ং সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র।
’ কোনটির সাথে কোনটির মিল নেই। আর আমরা যে যাই বলিনা কেন, আমরা সবাই কোচ মাত্র, মাঠে খেলতে হবে আরাফাতকেই। অফিসের মতো ’মাঠে’ও সফল হোক ছেলেটা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।