গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণের বাজার এত দিন পুরোটাই ছিল বিদেশনির্ভর। মূলত থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করে এই চাহিদা মেটানো হতো। তবে সময় পাল্টেছে। দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন এগিয়ে এসেছেন। অত্যাধুনিক ফিশিং ট্রলার বা মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণ করে পরীক্ষামূলকভাবে সাগরে ভাসিয়ে সফলতা দেখিয়েছেন তাঁরা।
বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত এসব ট্রলার ত্রুটিমুক্ত হওয়া নিয়ে সংশয়ে ছিলেন অনেকে। তবে দুটি ফিশিং ট্রলার নির্মাণের সফলতার সে শঙ্কা কেটে গেছে। আর দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাফল্যের এ খবর জেনে গেছেন ইউরোপসহ বিদেশের ক্রেতারা। ইতিমধ্যে বিদেশি ক্রেতারা দেশে তৈরি কয়েকটি ফিশিং ট্রলার পরিদর্শন করেছেন। এসব ট্রলার নির্মাণের সফলতা দেখে তাঁরা আগ্রহী হচ্ছেন।
উদ্যোক্তাদের সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণে এক দশকের সফলতা আছে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উদ্যোক্তাদের। কিন্তু আধুনিক ফিশিং ট্রলার নির্মাণের সফলতা ছিল না এত দিন। এ ক্ষেত্রে গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণে প্রথম এগিয়ে আসে ঢাকা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস। ২০০৮-০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ছোট আকারের অর্থাৎ ৩০ মিটার লম্বা তিনটি ট্রলার নির্মাণ করে। এই তিনটি ট্রলার হলো এফভি হাফেজ জমিরউদ্দিন, এফভি হাফেজ বারি এবং এফভি হক।
ঢাকা ডকইয়ার্ডের পর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন একাধিক উদ্যোক্তা।
নিয়মানুযায়ী, গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলার পরিচালনার জন্য লাইসেন্স থাকতে হয়। ২০১১ সালে সরকার গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ৩৪টি ট্রলারের লাইসেন্স দিলে এ খাতে নতুন বাজার তৈরি হয়। সরকারের লাইসেন্স অনুযায়ী প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ফিশিং ট্রলার নির্মাণের বাজার তৈরি হয়।
নতুন লাইসেন্সের বিপরীতে চারটি শিপইয়ার্ড এ পর্যন্ত ১৭টি ফিশিং ট্রলার নির্মাণের কার্যাদেশ পায়।
এসব ফিশিং ট্রলারের বাজারমূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওয়েস্টার্ন ফিশার্স নয়টি, এফএমসি পাঁচটি, লাকী শিপইয়ার্ড দুটি এবং রেডিয়েন্ট শিপইয়ার্ড একটি ফিশিং ট্রলার নির্মাণের কার্যাদেশ পায়।
এ মাসে এফএমসি শিপইয়ার্ড ‘এফবি সিএমএল লাবিবা’ নামের একটি ট্রলার সাগরে নামিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়েছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত মাছের বিচরণস্থল শনাক্ত করার প্রযুক্তিসহ আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে এই ট্রলারে। এরপর ওয়েস্টার্ন ফিশার্স শিপইয়ার্ড ‘এফবি অ্যালায়েন্স’ নামে আরও একটি ট্রলার সাগরে ভাসিয়েছে।
এই দুটি ফিশিং ট্রলারে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এ দুটি এখন মৎস্য শিকারের জন্য প্রস্তুত।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যে ৩৪টি নতুন লাইসেন্স দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১২টি বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে। বাকিগুলো দেশীয় উদ্যোক্তাদের ইয়ার্ডে নির্মাণাধীন ও সংগ্রহের অপেক্ষায় আছেন লাইসেন্সপ্রাপ্তরা। ’
নতুন লাইসেন্সের বিপরীতে দেশীয় উদ্যোক্তারা যেসব ট্রলার নির্মাণ করছেন, সেগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে।
থাইল্যান্ড থেকে আমদানির চেয়ে এসব ট্রলারের গুণগত মান অনেক ভালো বলে দাবি করছেন উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে ওয়েস্টার্ন ফিশার্স আইসল্যান্ডের নকশা এবং ডেনমার্কের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এফএমসি ব্যবহার করছে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি।
উদ্যোক্তাদের সূত্রে জানা যায়, সাধারণত দুই ধরনের নকশায় এসব মাছ ধরার ট্রলার তৈরি হচ্ছে দেশে। এর মধ্যে একটি ৪১ মিটার লম্বা ও অপরটি ৪২ মিটার লম্বা।
উদ্যোক্তারা জানান, আমাদের দেশের সাগরের অবস্থা বিবেচনায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে এসব ট্রলার। এসব ট্রলার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাছ ধরার উপযোগী।
তবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে একটা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ ফিশিং ট্রলার আমদানিতে মাত্র দুই শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক দিতে হয়। অথচ একই ফিশিং ট্রলারের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে সব মিলিয়ে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে কম-বেশি ২৮ শতাংশ।
জানতে চাইলে এফএমসি শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াছিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন দেশেই আন্তর্জাতিকমানের ফিশিং ট্রলার তৈরি হচ্ছে। এই খাত সুরক্ষা দিতে বৈষম্য কমাতে হবে। কারণ ফিশিং ট্রলার নির্মাণের চেয়ে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা এখন বহাল আছে। শুধু মানের কারণে টিকে আছে ফিশিং ট্রলার নির্মাণ খাত। অন্যান্য জাহাজের ক্ষেত্রে গ্রস টনের ওপর এ কর দিলেও ফিশিং ট্রলারের ক্ষেত্রে মূল্যের ওপর কর দিতে হচ্ছে।
আমদানিতে শুল্ককর বাড়িয়ে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া উচিত। ’
রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প সমিতির তথ্যানুযায়ী, দেশের এখন ১০টি প্রতিষ্ঠান সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার নির্মাণে সক্ষম। ফিশিং ট্রলার নির্মাণে দেশের বাইরে এখন হাতছানি দিচ্ছে ইউরোপের বাজার। ইউরোপে দুই হাজার ফিশিং ট্রলারের চাহিদা আছে। এর মধ্যে এক হাজার পুরোনো ট্রলার ধাপে ধাপে প্রতিস্থাপন করে নতুন করে বানানো হবে।
আর এক হাজার নতুন ট্রলারের চাহিদা আছে। মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার পর ইউরোপের কয়েকটি দেশের উদ্যোক্তাদের চোখ এখন বাংলাদেশে। কারণ ইউরোপের কোনো ইয়ার্ডে একটি ট্রলার বানাতে যত খরচ হবে বাংলাদেশে বানাতে তার চেয়ে ৩০ শতাংশ খরচ কম পড়বে। এ কারণে নিজেদের ইয়ার্ডে না বানিয়ে বাংলাদেশের কয়েকটি ইয়ার্ডে ট্রলার বানানোর জন্য যোগাযোগ শুরু করেছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে ওয়েস্টার্ন ফিশার্স শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের চাহিদার পাঁচ শতাংশও আনতে পারলে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হবে।
সরকার নীতিগত সহায়তা দিলে এ খাতের উদ্যোক্তারাই ফিশিং ট্রলার নির্মাণে বড় বাজার তৈরি করবে।
উদ্যোক্তারা জানান, দেশীয় খাতকে সুরক্ষা দিলে ফিশিং ট্রলার নির্মাণের বিদেশমুখিতা কমে যাবে। এতে যেমন সাশ্রয় হবে, বিদেশি মুদ্রা, তেমনি দেশীয় জাহাজ নির্মাণশিল্পও আরেক ধাপে পা রাখার সুযোগ তৈরি হবে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে গভীর সাগরে মাছ শিকার করছে অনুমতিপ্রাপ্ত ২১৪টি ফিশিং ট্রলার। এসব ট্রলারের সিংহভাগই পুরোনো।
এর মধ্যে ২৫-৩০টি ট্রলার প্রতিস্থাপনের সময় হয়ে গেছে। অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ট্রলারের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ করা হয় প্রায় ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭৩ হাজার ৪০৮ মেট্রিক টন মৎস্য আহরণ করা হয়। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ৪৮ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য আহরণ হয়।
দেশেই এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাছ ধরার উপযোগী ট্রলার তৈরি হচ্ছে
বাংলাদেশে মাছ ধরার ট্রলার তৈরির খরচ ৩০ শতাংশ কম হওয়ায় ইউরোপসহ বিদেশি ক্রেতারা যোগাযোগ শুরু করেছেন
দেশের ১০টি প্রতিষ্ঠানের এখন সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার নির্মাণে সক্ষমতা রয়েছে
চারটি শিপইয়ার্ড ইতিমধ্যে ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের ১৭টি ফিশিং ট্রলার নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছে
‘‘ইউরোপের চাহিদার পাঁচ শতাংশও আনতে পারলে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হবে
সাখাওয়াত হোসেন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ওয়েস্টার্ন ফিশার্স শিপইয়ার্ড
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।