মাঠ পর্যায়ে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশের কর্মকর্তারা জেলা পর্যায়ের সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কোনো কথাই শুনছেন না। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে এই দুই প্রশাসনের বিরোধ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। দেশের অনেক স্থানেই জেলা প্রশাসনের কথা শুনেনি পুলিশ প্রশাসন। যার ফলে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় তো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) লাঞ্ছিত করার পর রীতিমতো অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দিয়েছেন পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এসআই-এর বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি পুলিশ। এক্ষেত্রে সরকারের আদেশও মানছে পুলিশ প্রশাসন। তবে
রবিবার শোকজ করা হয়েছে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানকে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের ডাকা সভা-সমিতিতে, এমনকি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতে দেশের অনেক স্থানে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দেন না।
এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিভিল প্রশাসনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। দুই পক্ষের অবস্থান এখন মুখোমুখি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসন পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছে। আর মুন্সীগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, সারা দেশের সব জায়গায় যে সমস্যা তা কিন্তু ঠিক নয়।
কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা আছে। অনেক জায়গায় ভালো চলছে। তবে সরকার দেখছে কীভাবে এসব সমস্যা সমাধান করা যায়। তিনি আরও জানান, মুন্সীগঞ্জের ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসন অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ সুপারদের কাজ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সমন্বয় হচ্ছে না। বরং পুলিশ নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করছে। দীর্ঘ দিন ধরেই এই অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের অনেক স্থানেই সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
মুন্সীগঞ্জে গজারিয়ার ঘটনায় তার বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে।
গত ২২ মার্চ চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে মালামাল পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার এএসআই এমদাদ গজারিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অকথ্য গালিগালাজ করেন। এমনকি একপর্যায়ে ইউএনওকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। অসংখ্য লোকজনের সম্মুখে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ঘটনায় দ্রুত বিচার আইন ২০০২ ও দি পুলিশ আইন ১৮৬১-তে গজারিয়া থানাকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও গতকাল পর্যন্ত পুলিশ সেটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেনি।
সূত্র জানায়, এ ঘটনায় সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না। প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু মুন্সীগঞ্জেই নয়, সারা দেশেই পুলিশ প্রশাসন নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ তো এখন নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চলে। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা মনে করছে তারাই সবকিছু।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় মাদক, চোরাচালান, চুরি, ডাকাতি, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়া ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির নেপথ্যে মূলত মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের ঠাণ্ডা লড়াই। পুলিশ সুপাররা মাসিক অপরাধ চিত্র, চোরাচালান, টাস্কফোর্স কর্তৃক পরিচালিত অভিযানের প্রতিবেদন, পাক্ষিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গোপনীয় প্রতিবেদন যথা সময়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে পাঠান না, কিংবা পাঠাতে অনীহা দেখাচ্ছেন। যার ফলে সারা দেশে জেলাগুলোর সঠিক তথ্য যথা সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়গুলোতে পৌঁছাচ্ছে না। এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসন কার্যত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত পরিপত্র উপক্ষো করছে। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রেও জেলা প্রশাসনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহযোগিতা না করার অভিযোগ উঠেছে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এদিকে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাইফুল হাসান বাদলের একটি গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ডিসির পাঠানো ওই প্রতিবেদনে এসপির বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। এদিকে সরকারি আদেশ অমান্য করার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরও পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) বিরুদ্ধে মামলা না নেওয়ার কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয়েছে মুন্সীগঞ্জের এসপিকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আশফাকুল নুমান স্বাক্ষরিত করেছেন সোমবার বিকালে পুলিশ সুপারকে (এসপি) পাঠানো ওই নোটিসে- কেন তার (এসপির) বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা ১০ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।