রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় একটি রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান চারটি। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। যে ব্যক্তিটি এই থিওরী দাড় করিয়েছিল, সৌভাগ্য যে, তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পাননি। যদি পেতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিনি আরেকবার ভেবে দেখতেন রাষ্ট্রের উপাদানের মধ্যে “রাজনীতি”কে যোগ করা যায় কিনা।
পৃথীবির সকল গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দল আছে।
গণতন্ত্র টিকে থাকে বিভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উপর ভিত্তি করে। বিভিন্ন মত থেকে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন দলের। গণতান্ত্রিক দেশসমূহের সবগুলোতেই দুই বা ততোধিক করে রাজনৈতিক দল রয়েছে। সেসব দেশে স্বাভাবিক পদ্ধতি অনুসারেই নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জনগণের রায় অনুযায়ী সরকার গঠিত হয়। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এর ব্যতিক্রম নয়।
তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চেয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একেবারেই ভিন্ন। খুব ভালো হত, যদি এই ভিন্নতা ইতিবাচকভাবে হত। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের পোড়া কপাল, এ ভিন্নতা অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক কথায় খুব খারাপ। কিভাবে খুব খারাপ? চলুন মাত্র কয়েকটা দিক পর্যালোচনা করা যাক-
শহরাঞ্চলে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিশাল বিশাল ছবি সম্বলিত পোষ্টার কারোরই চোখ এড়ানোর কথা নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে এই সংস্কৃতি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপক হারে। এইসব পোষ্টারে থাকে সংশ্লিষ্ট নেতার বিশাল ছবি, তার উর্ধ্বতন কয়েক পর্যায়ের নেতাদের নাম ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছবি এবং সবার উপরে থাকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ভেদে জিয়াউর রহমান, বেগম জিয়া ও তারেক রহমান এবং শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা ও জয়ের ছবি। খুব পরিষ্কার বিষয় যে এর মাধ্যমে তারা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন, যাতে পরবর্তিতে আরেকটু বড় সাইজের পদ পাওয়া যায়। বিষয়টা খুবই খারাপ হয়, যখন ছাত্র সংগঠনের নেতারা এই ধরনের কাজ করে। এই প্রশ্ন কি আমাদের মনে কখনোই আসেনা যে, একটি ছাত্র কিভাবে কোত্থেকে নিজের নামে পোষ্টার ছাপানোর মত টাকা পায়? বাড়ি থেকে টাকা এনে কেঊ পোষ্টার ছাপায় না।
তার সংগঠনও তাকে পোষ্টার ছাপানোর জন্য টাকা দিবেনা। তাহলে এই অর্থের উৎস কি? এই অর্থের জন্য ঐ ছাত্রটি বাছে নেয় অস্বভাবিক পথ যেমন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি। এছাড়া নতুন কমিটি গঠনের সময় মোটা অংকের পদ বাণিজ্যের কথা এখন আর সাধারণ মানূষের অজানা নয়।
রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতি বিশ্লেষকদের খুব কমন ডায়লগ হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতাল কি? বাংলাপিডিয়া অনুসারে, হরতাল শব্দটি মূলত একটা গুজরাটি শব্দ, যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ১৯১৮ সালের ৩০ই মার্চ প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এটা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন। হরতালের সময় সকল কর্মক্ষেত্র, দোকান, আদালত বন্ধ থাকে। তবে সাধারণত এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারসার্ভিস, গণমাধ্যমসমূহ এর আওতার বাইরে হয়ে থাকে। এটা সাধারণত কোনো একটা দাবি আদায় করার বা এর গুরুত্ব বোঝাতে আহ্বান করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দ্রব্যমূল্যের অত্যধিক বা ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি রোধ করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এর ব্যবহার। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে হরতাল ডাকা হয়। শান্তিপূর্ণ হরতালের মূল কার্যক্রম হয়ে থাকে প্রতিবাদ মিছিল এবং সমাবেশ। অর্থাৎ হরতাল সমর্থকরা রাজপথে বেরিয়ে একত্র হয়ে উচ্চস্বরে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানান দিয়ে থাকেন। হরতালের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো হরতালকারীদের কন্ঠস্বর।
সাধারণত তারা রাজপথে বেরিয়ে চিৎকার করে নিজেদের দাবি-দাওয়া জনসমক্ষে কিংবা গণমাধ্যমের সামনে পেশ করে থাকেন। তবে মিছিল করার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ইত্যাদির ব্যবহার হয়ে থাকে। এই হচ্ছে হরতাল, প্রকৃতপক্ষে যে হরতালের অধিকার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই হরতালের ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের মধ্যে মোট ৫ দিন হরতাল পালন করা হয়।
হরতালের ব্যবহার ব্যাপকতা পায় নব্বইয়ের দশক থেকে। ১৯৯১-৯৫ সালে ২৬৬ দিন, ১৯৯৬-২০০১ সালে ২১৫ দিন, ২০০১-২০০৬ সালে ১৭৩ দিন হরতাল পালিত হয়। ২০১০-২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে হরতাল পালিত হয় ১৭ দিন। তারপর থেকে হরতালের পরিমাণ বেড়ে গেছে অনেক বেশি এবং বর্তমানে আমরা সিরিজ হরতালের যুগ অতিক্রম করছি। হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে ভিন্ন।
হরতাল আমাদের দেশে পালন করা হয় বিরোধিদলের সম্পূর্ণ দলীয় স্বার্থে। কারণ, আমাদের দেশ টিপাইমুখে বাধ নির্মাণ, প্রতিবেশি দেশকে ট্রানজিট দান, দ্রব্যমুল্যের লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি এবং আরো অনেক জাতির জন্য হুমকিস্বরুপ এবং জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাওয়ার মত অবস্থা অতিক্রম করেছে। কিন্তু তখন কোন রাজনৈতিক দল হরতাল আহবান করেনি, অথচ তখন হরতাল ডাকার জন্যই তাদের এই হরতাল নামক অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার দেয়া হয়েছে। তারা কখন হরতাল ডাকে? যখন তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, বা সরকার তাদের দলের ক্ষতি হয়, এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। হরতাল ডেকে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কি করে? রাস্তায় আগুন জ্বালানো, গাড়ি ভাংচুর, গাড়িতে আগুন জ্বালানো ইত্যাদি।
এখন অবশ্য বিরোধিদলের এইসব না করেও উপায় নেই। কারণ সরকারও হরতাল শেষে তাদের কমন ডায়লগ ছাড়ে, জনগণ এই হরতাল প্রতাখ্যান করেছে, যখন হরতাল আহ্বানকারীদের ঘোষণা, জনগণ এই হরতাল সর্বাত্বকভাবে সফল করেছে। আমজনতার প্রশ্ন, জনগণ শব্দ দ্বারা আসলে এখানে কি বুঝানো হচ্ছে? হরতালের দিন ভাংচুর, আগুন দেয়া ইত্যাদি ছিল হরতালের দিনের কাজ। কিন্তু ২০০৪ সালের ৪ঠা জুলাই, আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালের আগের দিন, তারা সৃষ্টি করে নতুন সংস্কৃতির। ঐ দিন রাজধানীর শেরাটন হোটেলের সামনে বিআরটিসির একটি দোতলা বাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, যে আগুনে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ১১ জন, পরবর্তিতে হাসপাতালে নিহত হয় আরো ৭ জন।
আওয়ামী লীগ এই দায় অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে ঘটনা আওয়ামী লীগেরই ঘটানো বলে প্রমাণিত হয়। এরপর থেকে হরতালের আগের দিন বিকাল থেকেই হরতালের উত্তাপ ছড়ানোর প্রচেষ্টা চালান হরতাল সমর্থকরা। এই হরতাল পালন করতে গিয়ে অনেককে অনেক প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, এমনকি অনেকের প্রাণ পর্যন্ত যায়। আমাদের দেশে হরতালে সহিংসতার এই বিষয়টা আরো ভয়ানক একারণে যে, জনগণের প্রাণ যাওয়া কিংবা বিভিন্ন রকম ক্ষতির বিষয়টা রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে খুব সাধারন বিষয় বৈ আর কিছু নয়। তারা বলেন যে, কর্মসূচিতে এইরকম ঘটনা ঘটতেই পারে।
চিন্তা করা যায়, এ রাজনীতিবিদদের মন-মানসিকতার অধঃপতন কতটুকু হয়েছে? তাদের কাছে মানুষের জীবনও তুচ্ছ বিষয়।
রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যকার হানাহানি সংঘাত আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি নিন্দনীয় দিক। দলীয় অন্তর্কোন্দল, গ্রুপিং, বিরোধী গ্রুপ, দলের কর্মীদের উপর হামলা ইত্যাদি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে করে তুলেছে জনসাধারণের চোখে অত্যন্ত নিন্দনীয়। ছাত্ররাজনীতিতে দলীয় কোন্দল শিক্ষার পরিবেশকে করে তুলেছে খুবই সঙ্কটাপন্ন। ছাত্রসংগঠনসমূহের মধ্যকার সংঘর্ষ বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আমাদের ছাত্ররাজনীতির স্বর্ণালী যুগ আজ নিতান্তই ইতিহাসের পাতায় ঠাই নিয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার আরেকটি ভয়ানক দিক, যা আমাদের রাজনীতিকে করেছে কলুষিত। রাজনৈতিক নেতাদের যারাই ক্ষমতাই যান, তারাই প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। তাদের অনুসারীরা তখন যেন আইনের উর্ধে অবস্থান করেন। এমন কোন হীন কাজ নেই যা তারা করেন না।
আর “বড় ভাই”এর কল্যাণে তখন কোনকিছুই তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে থাকেন। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ তাদের অন্যায়ের বিপক্ষে রুখে দাড়ালে তাকে শাস্তিমূলক বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
আমাদের রাজনীতির আরেকটি গুরুতর দিক হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ। রাজনৈতিক দলসমূহ ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসন থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণের বন্যা বইয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ দখলের চেষ্টা এবং বলপ্রয়োগে কার্পণ্য করেন না তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে দলীয়করণের সংস্কৃতি চালু করার মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলসমূহ নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠি ছাড়া অন্যদের পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দিতেই চায়না এবং বিরোধীমতের মিডিয়া সমূহের টুটি চেপে ধরার চেষ্টা করে, যার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিককালে আমার দেশ, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে।
রাজনীতি হওয়ার কথা মানুষের স্বার্থে। কিন্তু আমাদের দেশে আজ মানুষই যেন রাজনীতির জন্য।
মানুষ প্রতিনিয়ত রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্তের বলি হয়েই চলেছে। যদিও বলা হয়, গণতন্ত্রে জনগনই সকল ক্ষমতার উৎস, কিন্তু আমাদের দেশে জনগণ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের হাতের পুতুলের মত। ৫ বছরে একদিন জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকে। কিন্তু এখনকার দিনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং তাদের একদিনের অধিকারও যেনে কেড়ে নিতে চায়।
আমরা আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন মেন্ডেলা, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউর কথা জানি, যারা তাদের দেশকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ স্থানে নিয়ে গেছেন।
মেন্ডেলা, মাহাথির কিংবা লি কুয়ানদের দেশের প্রতি ভালবাসা, দায়বদ্ধতা, দেশের মানুষকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা তাদের পরিণত করেছে মহামানবে, তাদের জাতি বিশ্বের দরবারে দাড়িয়েছে মাথা উচু করে। আমাদের দেশে কি আমরা এমন কাউকে পাবনা, যিনি হবেন বাংলার মাহাথির বা বাংলার লী কুয়ান? তার প্রত্যাশায় আজ জাতি পথ চেয়ে আছে। দেশের স্বার্থে, এই দেশের মানুষের স্বার্থে আমাদের উচিত হবে এক একজন মাহাথির হিসেবে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়া। তাতেই আসবে এই দেশের সমৃদ্ধি। তার মাধ্যমেই আমরা গড়তে পারব আমাদের স্বপ্নের সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।
(লেখাটি ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে লেখা) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।