এই বিষয়ে সবাই সহমত পোষণ করেন যে এই শতাব্দী এশিয়ান শতাব্দী। পৃথিবীর অর্থনৈতিক নেতৃত্ব এর মাঝেই এশিয়ার হাতে চলে আসছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই দশকের শেষেই চীন পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ এ পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে অর্থনীতির পাশাপাশি চীন কি পৃথিবীর এক নম্বর সামরিক শক্তির দেশ হতে পারবে কিনা? এই নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ তামাম দুনিয়ার আগ্রহের অন্ত নেই। চলছে নানা বিশ্লেষণ।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর প্রকাশিত একটি মার্কিন প্রকাশনার মতে আগামী ২০৩০ সালের মাঝে চীন পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনীতির দেশ হতে পারলেও সামরিক আধিপত্য অর্জন করতে পারবে না, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সামরিক আধিপত্য বজায় থাকবে। এই ধারণা বদলে যেতে পারে যদি কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটে।
চীনের সুপার পাওয়ার না হওয়ার পিছনে অনেকেই অনেক কারন খুজে পেয়েছেন। এর মাঝে কিছু যুক্তির পিছনে ইতিহাসের সমর্থন পাওয়া যায়, কিছু প্রজুক্তিগত, ফিলসফিকাল।
রেনেসাঁর পর থেকে বা তার আগে ইসলামী সভ্যতার সময়কাল থেকে ধার করে নিয়ে বলা যায় যে সময় যে সভ্যতা বিশ্ব শাসন করেছে, সে সময় তারা এমন বিধান, মতবাদ বা ইন্টেলেকচুয়াল ক্ষমতার অধিকারী ছিল যা তারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে ছেয়েছিল এবং সফল হয়েছিল।
ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ব্রিটেন এর প্রযুক্তি, জ্ঞান ছিল দুনিয়ার সেরা। আমেরিকান নেতৃত্বর যে সময় আমরা পার করছি এই সময়ে আমে রিকান প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সুপ্রিমেসি তর্কের অতীত। দার্শনিক Hegel এর মতে এক মতবাদ আরেক মতবাদের উপর জয়লাভ করে বা এক জাতি আরেক জাতির উপর যুদ্ধে জয়লাভ করে কারণ জয়ী জাতির মতবাদ বিজিত জাতির মতবাদের চেয়ে শ্রেয়। তার সময়ে ব্রিটেন দুনিয়াকে গনতন্ত্র বুঝাতে চেয়েছিল, মার্কিনীরা পুজিবাদ, বাক্তিসাতন্ত্রবাদ নিয়ে আছে। প্রশ্ন জাগে চায়না কি নিয়ে যাবে মানুষের দ্বারে।
পুরাতন কনফুসিয়ান মতবাদ নতুন মোড়কে? এই যুগে তা কি খুব গ্রহণযোগ্য হবে? আধুনিক পৃথিবীকে দেওয়ার মত চীনের নিজস্ব কি মতবাদ বা প্রযুক্তি আছে? হ্যাঁ, চায়না শিখাতে পারে কিভাবে অনুকরন করতে হয়? কিন্তু সেটা কি নেতা সুলভ কাজ হবে? অরিজিনাল কিছু না থাকলে আর যাই হওয়া যাক না কেন সবার নেতা হওয়া যায় না। চীনে চলছে COMMUNISM ও MARKET ECONOMY এর সমন্বয়- যা পরস্পরবিরোধী। আবার ধরা যাক চীন চায় বিশ্বজুড়ে তার যেকোনো মতবাদ পৌঁছে দিতে। সেক্ষেত্রে ভাষা একটি সমস্যা হিসেবে দাঁড়াতে পারে। সম্ভবতঃ হাজার বিশেকের উপর বর্ণমালা রয়েছে চাইনিজ ভাষায়।
কেও যদি এই ভাষায় আন্তরিক ভাবেও শিখতে চায় তার জন্য তা সহজ হবেনা। এই দিক থেকে ও চীন পিছিয়েই আছে ইংলিশভাষী আমেরিকান দের চেয়ে। মতবাদ ছড়িয়ে দেয়া অত্যন্ত জরুরী যেকোনো সুপার পাওয়ার এর জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর অনুবাদ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমেই তারা সারা দুনিয়ায় তাদের মতবাদ ছড়িয়েছিল এবং অনেক অনুসারী সৃষ্টি করেছিল- যার ফলে তারা অনেক দিন প্যারালাল সুপার পাওয়ার ছিল। ভাষা গত দুর্বলতা কাটিয়ে চীন এই ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রসর হতে পারে তা দেখার বিষয়।
আরেকটি বিষয় যা বিতর্কিত তা হল আধুনিক ধ্যান ধারণায় কেও যদি প্রচলিত অর্থে সুপার পাওয়ার হতে চায় তাকে আগ্রাসী অর্থাৎ পরদেশ আক্রমণ করার মানসিকতা এবং শক্তি থাকতে হবে। এর সাথে সমর বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি এক শক্তিশালী ব্লক গড়ার বিষয়টি জড়িত। চীনের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে চিন্তা করা যায়। সমর বিদ্যায় মার্কিনীদের চেয়ে তারা পিছিয়ে আছে অনেক দূর। শক্তিশালি সামরিক ব্লক গড়া তার পক্ষে দুরহ।
জাপানের সাথে আছে চির বৈরিতা, south Korean দের সাথে সম্পর্ক ভাল নয়, অনেক পুরনো বন্ধু মায়ানমার সম্প্রতি মার্কিন এর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে, আরেক বন্ধু পাকিস্তানের অবস্থা বলার মত নয়। মার্কিনীদের সাম্প্রতিকালের অভিযানে ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ ন্যাটোর সমর্থন প্রশ্নাতীত এবং বিশাল আকারের। চীনের সামরিক শক্তির মহড়ায় যোগ্য সহচর কে হবে? শক্তিশালী সামরিক জোটের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তীব্রভাবে অনুভূত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্যারালাল শক্তি হয়েছিল এর বিশাল সাম্রাজ্য এবং বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ম এর বিস্তার এর কারণে। চীনের ক্ষেত্রে এই ধরণের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি দেখা যায় না।
এ ছাড়া চীনকে তার নিজের আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যেমন তিব্বত সমস্যা, তাইওয়ান সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে ভাবনায় থাকতে হয়। এর সাথে যোগ হবে জাপানের সাথে সাথে সময়ে সময়ে চলা সীমান্ত সমস্যা। বর্তমান সুপার পাওয়ার ইউ এস এ এর ক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যার কথা শোনা যায় না। সম্প্রতি এক জাপানিজ নাগরিক থেকে জাপান সরকারের ক্রয় করা সেঙ্কাকু দ্বীপ নিয়ে চীন-জাপান সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, যা চীনের জন্য কখনো ভাল হবেনা। জাপান এখনো পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ এবং এমনকি ২০৫০ যখন এর অর্থনীতির GROWTH অনেক কমে যাবে তখন জাপান ফিফথ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত থাকবে।
জাপানের বর্তমান সামরিক শক্তি উন্নয়নের জন্য খুব উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখেনা। তবে তা এমন নয় যে দেশের মৌলিক প্রতিরক্ষার জন্য অপ্রতুল। জাপানে রয়েছে ৪০,০০০ মার্কিন সেনার সমন্বয়ে গঠিত এক শক্তিশালী মার্কিন ঘাঁটি- যা SECOND WORLD WAR এর পর থেকে জাপানের অকিনাওয়া প্রদেশে অবস্থান করছে। US-JAPAN DEFENSE TREATY এবং জাপানে মার্কিনীদের বিশাল আর্থিক স্বার্থের কারণে জাপানের সাথে যে কোন ধরনের সংঘর্ষে ইউ এস এ জড়িয়ে পরবে। এ ছাড়া ইদানীং জাপান সামরিক যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ রাখছে।
জাপানের SOPHISTICATED TECHNOLOGY র কারণে তাদের পক্ষে উন্নত অস্র বানানো সহজতর। MITSUBISHI HEAVY INDUSTRY এর পক্ষে যে কন কিছু বানানো সম্ভব বলে মনে হয়। SECOND WORLD WAR –এর অনেক অস্র এখানেই তৈরি হয়েছে। তাই চীন- জাপান সংঘর্ষ চীনের সুপার পাওয়ার হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা এই সমস্যা শেষ হবার নয়।
জাপানীরা হারিকিরি তে বিশ্বাস করে কম্প্রমাইজে নয়, চাইনিজরা এখন তাদের আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে যাবে শক্তির নিদর্শন হিসেবে।
আধুনিক কালে Germany অন্যতম রাষ্ট্র ছিল যার মাঝে সুপার পাওয়ার হওয়ার মোটামুটি সব উপাদান ছিল বলে মনে করা হয়। 2nd World War ফলাফল টাকে উল্টো করে দেখলে জার্মানদের সুপার পাওয়ার এর জায়গায় দেখা যায়। নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করার পাশাপাশি তাদের ছিল জাতীয় একতা। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল জার্মান দর্শনের(হেগেল, মার্ক্স প্রমুখের) অনুষঙ্গ conflict বা সংঘর্ষের চেতনা যা হিটলারের হাতে পরে ভয়ানক ফ্যাসিবাদী বিকৃত ধারণায় রুপ নেয় এবং ধ্বংস হয়।
চাইনিজ দের মাঝে তা পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের কারণে অনেকেই তাদের দেশে ফিরতে চায় না। পৃথিবীর HIGHEST DEATH PENALTY কার্যকর কারী এই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। CLOSED কাঠামোর কারণে অনেক সংবাদ প্রকাশ পায় না। সম্প্রতি চীনা শাসক শ্রেণীর দুর্নীতি COMMUNIST রাষ্ট্রটির মূল কাঠামো সমতার ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে।
চীনে আঞ্চলিক বৈষম্য প্রচুর- যা কোন COMMUNIST রাষ্ট্রে কাম্য নয়। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা কিউবা র মত তাদের ওয়েলফেয়ার কর্মসূচী যেমন স্বাস্থ্যসেবা ভাল নয়। আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যেমন তিব্বত সমস্যা, তাইওয়ান সমস্যা ইত্যাদির কথা না হয় বাদই দিলাম। এইসব নানাবিধ কারণে চীনাদের তাদের সরকারের উপর খুব SATISFY থেকে নিজেদের খুব বেশি উন্নত জাতি এবং একক জাতি মনে করা কষ্টকর। এই ক্ষেত্রে ও তারা পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়।
সবশেষে চীনের পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনীতি হওয়া নিয়ে একটু সন্দেহ করা যায়। গত শতাব্দীর ৭০ এর দশকের শেষের দিকে এবং আশির দশকের শুরুতে জাপান ঠিক চীন এখন যে অবস্থানে সেই অবস্থানে ছিল। ECONOMIC GROWTH RATE(জাপানের) ৯ বা এর অধিক দুই অংকের ঘরে পৌঁছেছিল। সারা পৃথিবী প্রস্তুত ছিল TOKYO কে NEWYORK এর উপর স্থান দিতে। কিন্তু ৯০ দশকের শুরুতে এসে জাপানের সম্ভাবনার বেলুন ফুটো হল- সে থেকে জাপানের অর্থনীতি ২য় এখন ৩য়...পরে পঞ্ছম।
মার্কিন পলিসি মেকার রা চীন কে বরণ করার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। যে কোন ধরনের শক কিংবা নেতিবাচক প্রচারনা বদলে দিতে পারে হিসাব। অর্থনীতিতে স্পেকুলেসান এর গুরুত্ব অনেক বেশি। শেয়ার বাজারে ধস নামবে এই প্রচারণায় শেয়ার বাজার ধসাতে যথেষ্ট ভুমিকা পালন করতে পারে। চীনের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়ার কারনে শ্রম সস্তা নয়, এই বাস্তবতা এবং প্রচারণা চীনের গার্মেন্টস ও অন্যান্য LABOUR INTENSIVE INDUSTRY র জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
হতে পারে আর অনেক কিছু। তবে সামরিক ক্ষেত্রের চেয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীনের সম্ভাব্য মুরব্বি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। দেখার অপেক্ষায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।