বেশীদিন আগের কথা নয়, তখন আমি কলেজের শিক্ষার্থী। আমার একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি রসায়ন পড়াতেন। বাংলাদেশের প্রতি তিনি মহা বিরক্ত থাকতেন সবসময়ই। প্রায়শই ধুলা-ময়লা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অশিক্ষিত মানুষদের উপর নিজের বিরক্তি ঝাড়তেন...কিন্তু তিনি আসলেও অনেক মেধাবী ছিলেন, এই কথা আমি অস্বীকার করতে পারবো না। কলেজে পড়া অবস্থায় শুনতাম উনি শীঘ্রই বিদেশ পাড়ি জমাবেন।
সত্যিই চলে গিয়েছেন বিদেশ, হয়েছে প্রায় এক বছর। এখন উনি ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার দেন ডিঙি নৌকার, গ্রুপ খুলেছেন আই লাভ বাংলাদেশ... আমাকে আবার সেই গ্রুপে এডও করেছেন। কলেজেরই আরেকজন শিক্ষক ছিলেন আমার, জীববিজ্ঞান পড়াতেন। উনাকে আফসোস করতে শুনতাম যে সৎ হয়ে দেশে থাকা কষ্টকর। বলতেন যে, ছাত্রাবস্থায় উনিও দেশের মেধাপাচার হওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এসে উন্নতি করার সুযোগ না দেখায় তিনিও হতাশ হয়ে গিয়েছেন। ফলাফল, বিদেশ গমন। উনিও খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং স্কলারশীপ পেয়েই চলে গিয়েছেন। বিদেশে একবার গেলে আর কেউ এই ধুলো-ময়লার দেশে ফিরে আসে না, জানি উনারাও আসবেন না। কিংবা আসলেও কেবল দেশের সাড়ে তিন হাত মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে আসবেন।
এই যে এত কথা বললাম তা কিন্তু মোটেও এই দু’জনকে হেয় করার জন্যে নয়, ব্যক্তিগত জীবনে উনারা দুজনই যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমার উদ্দেশ্য কেবলই সাম্প্রতিক অজস্র উদাহরণের মধ্যে থেকে দুটো তুলে ধরা। এই দুজনের জীবন যে একেবারে নিম্নমানের ছিলো, তা কিন্তু বলা যাবে না। বেশ ভালো চাকরী করতেন, ঢাকার সবচেয়ে ভালো জায়গায় থাকতেন, সম্মান ও সুনামও কম ছিলো না। তবুও তাঁদের স্বদেশ ছেড়ে কেন যেতে হলো সেটিই আসলে ভাবায়।
আমি বলছি না যে একটি উন্নত/আধুনিক জীবন আহরণের অধিকার আপনার নেই। নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য সুরক্ষিত, উন্নত সুবিধাসম্পন্ন ও স্বাস্থ্যকর বাসভুমি সকলেই চায়। এই দেশে মশা ও মানুষ একই হারে বাড়ে ও মরে, সকলে পরিবেশ নষ্ট করার বিদ্যে সাথে নিয়েই জন্মায়; বিসিএসে যে সর্বাধিক আবর্জনা গিলতে সক্ষম সেই দেশের প্রথম শ্রেণীর চাকরি পায়; সৎ থাকলে জীবন দুর্বিষহ, কোন অপরাধের বিচার নেই, পা না চাটলে উন্নতি নেই,.... এরকম অজস্র অজস্র কারণ যা লেখে শেষ হবে না। সবই বুঝলাম, সবই মানলাম। কিন্তু যে দেশের ইতিহাস ৭১’, সেই দেশের সন্তানদের কাছে আমি একটু বেশী আশা করতেই পারি; হোক সেটা দুরাশা।
৭১’ ও তার পরবর্তিতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে কেবল তাদের সৃষ্টিশীলতাকেই আটকানো হয়েছে; কিন্তু চেতনাটুকু আজো জীবিত রয়েছে। আমার বিশ্বাস, চেতনার কোন মৃত্যু নেই।
মেধা পাচারে কারণে যেটা হয় যে গরীব দেশগুলো গরীবই থাকে, উন্নত দেশগুলো আরো উন্নত হয়। মানুষ এখন দেশের মাটিতে পড়াশোনা করে বড়ই হয় বিদেশ চলে যাওয়ার জন্যে, সন্তান আর কেউ দেশে রাখে না। মধ্যরাতে টক শো’তে বসে যে যত বড় বুলিই কপচাক, কারো সন্তান দেশে নাই রে ভাই।
কিন্তু সে হিসাব বাদ, আমাদের দেশের অবস্থা তো আর দশটা গরীব দেশের মতন নয়, ৭১’ সালে আমাদের গোটা জাতি মেধাশূণ্য হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তি দেশে যারা নৈতিক আদর্শ সমুন্নত রাখতেন, সঠিক পথ দেখাতেন ও সেজন্য লড়াই করে যেতেন, তাদেরকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিলো। ক্ষতি ও হারানোর পরিমাণটা যে কি বিশাল... তা পরবর্তিতে সকল নাটকীয় ক্ষমতায়ন/উত্থান পতন পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড়ো ক্ষতিটা হয় তখন যখন শিক্ষকরা ভিনদেশী হয়ে যান। একটি জাতিকে নীতিশিক্ষা দেয়া, তার জন্ম সম্পর্কে জানানোর দায়িত্ব থাকে শিক্ষকের উপর।
একজন শিক্ষক নিজেকে একলা বিবেচনা করলে তার কনট্রিবিউশান নিজের কাছে সামান্য মনে হতে পারে; কিন্তু সম্মিলিতভাবে সকল শিক্ষকের অবদান যদি চিন্তা করতে যাই তা মোটেও সামান্য নয়। এই যে কিছুদিন আগে গেলো “লাখো কন্ঠে সোনার বাংলা”; জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে পরে রয়েছে/পাড়ানো হচ্ছে- এমন ছবি মিডিয়াতে এসেছে। কর্তৃপক্ষের তো দোষ আছেই, সর্বস্তরের লোকের সমাগম হলে এই রকম ঘটবে তাতো জানাই ছিলো- কেন আগে থেকেই সে সম্পর্কে সতর্কবার্তা ও নিয়মাবলি প্রচার করা হয় নি? সংবিধানে আছে- “The ‘Flag’ when it is in such a condition that it can no longer be used, shall be disposed of in a dignified manner, preferably by burying.” কয়জন জানেন এই নিয়ম? কর্তৃপক্ষ তো কর্তৃপক্ষই, কিন্তু এই যে আমার দেশের সাধারণ জনগণ জানে না এই দায় কি আমাদের উপরেও বর্তায় না? যেই জাতি মান এর অর্থই বুঝলো না, তার কাছে সম্মানই কি আর অপমানই কি? ২১শে ফেব্রুয়ারী, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের মত দিনগুলোতে প্রথম টার্গেট থাকে স্কুল/কলেজ/ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চাগুলো; করা হয় নানা প্রশ্ন যার উত্তর এরা সঠিকভাবে দিতে পারে না। তখন এই বাচ্চাদের ইতিহাসে অজ্ঞতার খবর খুব রসায়ে রসায়ে মিডিয়াতে প্রচারিত হয়। তো, এই যে বাচ্চার বাবা-মা’রা ইতিহাস জানেন না/ভুল জানেন/বাচ্চাদের জানানোর বেলায় অসচেতন- এর দায় কি শুধু তাদেরই? আমাদের কি দায় নেই?
আমি বলছি না যারা দেশে আছে তারাই দেশপ্রেমের কান্ডারী, কিংবা বিদেশে যে মেধাবীরা যান তাদের কোন অসহায়ত্বই নেই।
প্রবাসে যেয়ে যে বাঙালিরা স্বদেশ ভুলে যায় বা তার জন্যে কিছু করে না, এটা সম্পূর্ণ অসত্য কথা। বাংলায় মধুসূদন কি একজনই? বিদেশে যেয়েও দেশের জন্য অক্লান্ত মনে কাজ করে যাচ্ছেন এমন বাঙালির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। একটা বাঙালি আছে বিদেশে, দিন শেষে যার দেশের স্মৃতি দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয় না? আমি জানি, বিদেশে থাকলেও বাংলাদেশ প্রতিটি বাঙালির অন্তরে আছে, প্রতিদিন দেশের মাটি তাঁদেরকে ডাকে- যা উনারা ভগ্ন হৃদয়ে প্রতিদিন প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন। বিদেশ যতই আধুনিক, উন্নত হোক, যতই ভালো জীবন দিক- সবসময়ই আপনাকে মনে করিয়ে দিবে যে আপনি ভিনদেশী, আপনাকে আপনি আপন করে পাবেন কেবলই বাঙালির মাঝে।
এখন, আপনি বলবেন দেশে তো আমি আসতেই চাই, কে চায় বিদেশের মাটিতে খাটতে, আমার মন কি কাঁদে না? কিন্তু আসলে কি নিরাপত্তা পাবো, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ/ভালো খাবার পাবো, কাজের পরিবেশ পাবো? না, আমি কিছুই দিতে পারবো না; আজাদ-তারেক-মিশুক... দেশকে কিছু দিতে চেয়েছেন যারা, তাদের অনেককেই আমাদের ব্যর্থতায় হারিয়েছি আমরা।
ফলে, এক কলঙ্কিত প্রবাদ/অপবাদ চাউড় হয়ে গিয়েছে জনমনে- “এদেশের মাটি তার ভালো সন্তানগুলো ধরে রাখতে পারে না। “ অসত্য! কারণ আমি অজস্র জীবিত সন্তান দেখি যারা দেশের মাটিতে শত দুর্যোগ সত্ত্বেও পড়ে রয়েছেন, কাজ করছেন। কিছু করার নেই, সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্য যেটিই ভাবেন- জন্মসূত্রেই যে আমরা এই মাটির কাছে দায়বদ্ধ! আমার আসলেও মুরোদ নেই যে কিছু করে দিবো, শুধু ইচ্ছেটুকুই আছে যার কোন কার্যকারীতার সুযোগ আদৌ নেই বাস্তব জীবনে। এখন এই উত্তর শুনে আমাকে আবেগী/বাস্তবতাবিমুখ বলবেন, কর্মক্ষেত্রে নেমে জীবন দেখে তারপর কথা বলতে বলবেন। হ্যাঁ আমি আবেগী, সত্যি বলছি আমি আবেগী।
কারণ চারদিক অন্ধকার দেখি আমি, বিশ্বাস করুন- ভয় হয় এখন। মনে হয় অন্ধকারে যেন খুব আপন কাউকে তলিয়ে যেতে দেখছি অসহায়ের মত, কিন্তু গুটি কয়েক আমরা মিলে তাঁকে বাঁচাতে পারছি না। মনে হয় যেন আমার দেশ, আমার মাকেই দেখছি হারিয়ে যেতে, ঘুটে ঘুটে মারা যেতে। আলোগুলো শুধু জোনাকির মত উড়ে চলে যায়, তাই চতুর্দিকে আজ শুধু আঁধার আর আঁধার। চারদিক থেকে নেকড়ে-হায়না ঘিরে ধরেছে, কারণ অন্ধকার নামলেই এরা শিকারে বের হয়।
আমরা এই কয়জন সন্তান মিলে মা’কে যেন আর বাঁচাতে পারছি না। এতটাই ঘুটঘুটে আধার যে এখন তো সংশয় আসে মনে... চারদিক অন্ধকার নাকি আমরা নিজেরাই এখন অন্ধ হয়ে গিয়েছি?
যদি একটুও সুযোগ থাকে তবে ফিরে আসুন আলো হয়ে, পঙ্গু হতে চলা আপনার আর আমার মাকে উঠিয়ে তুলুন, নিগৃহীত মা’টিকে তার সম্মানটুকু আবারো ফিরিয়ে দিন। আপনারা ফিরে আসুন- যুক্তিতর্কের জন্য নয়, আমাদের আশাটুকুর বাস্তবায়নের জন্য ফিরে আসুন। পথ দেখান, আলো হয়ে ফিরে আসুন এই ভুমিতে। যখন অজস্র মোমের আলো এক সাথে হবে তখন তা সূর্যের মতনই জ্বলজ্বলে হয়ে উঠবে, পালিয়ে যাবে যত নেকড়ে-হায়না সব।
এমনই একটি সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বেঁচে রয়েছি, সবার স্বপ্নেই মধুসূদনের কুল-লক্ষ্ণী এসে দেখা দিয়ে যাক,থাকলাম সেই প্রতীক্ষায়...
হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে, সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!
স্বপে তব কুললক্ষ্ণী কয়ে দিলা পরে,-
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে। ”
-----------------
-----------------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।