বই রিভিউঃ পৃথিবীর পথে পথে
গ্রন্থকারঃ তারেক অণু
প্রকাশকঃছায়াবীথি, বইমেলা ২০১৪
এই পৃথিবী কত বড়। কত বিশাল। কোথাও রয়েছে বিশাল সাগর, কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা তার শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব জানাতে, কোথাও রয়েছে বিশাল অরণ্য যেথা নিঝুম চারিধার, যেথা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আদিম মহাদ্রুম। আমাদের সীমিত জীবনে এইসব স্থান ঘুরে আসা সম্ভব নয়। সম্ভব ভ্রমণ কাহিনীর বই পড়ে।
বাংলা ভাষায় ভ্রমণ কাহিনীর বই অত্যন্ত বিরল। যেগুলো রয়েছে সেখানে একটি নির্দিষ্ট জনপথ কিংবা একটি নির্দিষ্ট জায়গার কাহিনী। কিন্তু সেই ঘাঁটতি পূরণ করতে প্রকাশিত হল পরিব্রাজক তারেক অণুর ‘পৃথিবীর পথে পথে’।
লেখক ভেতো বাঙ্গালীর সন্তান। পদ্মা পাড়ে কেটেছে তার শৈশব এবং কৈশোর।
তাই বলে জীবন থেমে থাকে নি। চষে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে অপ্রান্ত। উত্তর থেকে দক্ষিণ-সর্বত্র পড়েছে তার পদ চাড়না। তারই গল্প তারই কথা ছাপার কালিতে প্রকাশিত হয়েছে ‘পৃথিবীর পথে পথে’ বইটিতে।
বইটিকে সর্বমোট সাতটি অধ্যায়।
সাত ধরণের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
প্রথম অধ্যায় ‘তুষার ও অগ্নির উপাখ্যান’ এ রয়েছে লেখকের উত্তর মেরু অভিযানের গল্প, রয়েছে নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতে যাওয়ার গল্প, অন্নপূর্ণা,আল্পস ও ভিসুভিয়াসের শিখরে উঠার গল্প। লেখকের সাথে সাথে আপনিও ঘুরে আসতে পারবেন সেই স্থানগুলো থেকে।
দ্বিতীয় অধ্যায় ‘মানুষের গল্প জনপদের গল্প’ শীর্ষক অধ্যায়ে আপনি এক পলল্কে চলে যাবেন ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। ঘুরে আসবেন ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো যেখানে রয়েছে আছে হাত বাড়িয়ে দেওয়া যীশু ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার আর আছে ফাভেলা ।
মাইকেল জ্যাকসনের অমর গান দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস গানটির শুটিং হয়েছিল রিওর এক বস্তিতেই যাকে ব্রাজিলিয়ানরা ডাকে ফাভেলা নামে। যাবেন মধ্যরাতের সূর্যের দেশ নরওয়েতে। যাবেন লিথুয়ানিয়ার সেই পাহাড়ে যেখানে রয়েছে শত শত ক্রুশ। আপনি চলে যাবেন কিউবাতে। জানবেন বছরের পর বছর মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের পরও কিভাবে বিশ্বের সেরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তাদের।
চলে যাবেন ঘুরে আসবেন ডারউইনের বাড়ি থেকে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেখানে চার দেয়ালের ভিতর নেলসন ম্যান্ডেলাকে দেওয়া হয়েছিল নির্বাসন সেই কন্সটিটিউশন হিল কারাগারকে দেখে আসবেন। সর্বশেষে আবার সেই দক্ষিণ আমেরিকার মধ্য পেরুর এক গ্রামে যাবেন।
ভূগোলের সাথে ইতিহাস সম্পর্কিত। প্রতিটি স্থানেরই রয়েছে না জানা ইতিহাস।
কত না জানা কথা। সেই সব জায়গাকে নিয়েই তৃতীয় অধ্যায় ‘পথের বাকে ইতিহাস’। প্রথমেই ইনকাদের শহর পিসাক এবং ওয়্যানটাইটামবোর কথা রয়েছে। ৭৯ সালের ২৪ আগস্ট ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের জন্য যাতে রোমান শহর পম্পেই এবং হারকিউলানিয়াম লাভার নিচে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় । এ শহরদুটি পরবর্তীতে আর পুনঃর্নিমাণ করা হয়নি ।
যদিও শহরগুলোর বেঁচে যাওয়া অধিবাসীরা এবং সম্ভবতঃ লুটেরারা ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রচুর জিনিষপত্র সংগ্রহ করেছিল । কালক্রমে শহরদুটির অবস্থান সবাই ভুলে গিয়েছিল; পরবর্তীতে ১৮শ শতকে ঘটনাক্রমে শহরগুলো আবার খুঁজে পাওয়া যায় । সেই হারকিউলানিয়ামে যাবেন লেখকের সাথে দেখে আসবেন দুই হাজার বছর আগের জীবনযাত্রা। জীবনের শেষ মুহূর্তে লোকগুলোর অবস্থা। অ্যাজটেক শহর তেওতিহুয়াকান এবং নরবলির রোমহর্ষক ইতিহাস জানতে পারবেন।
ইনকাদের বিস্ময় মাচু পিচু ঘুরে আসবেন এই অধ্যায়ে। এরপর এক লাফে ইউরোপে চলে যাবেন প্রথমে ইংল্যান্ডে ঘুরে আসবেন স্টোনহেঞ্জ, এরপর ইতালির পিসার হেলানো মিনার, পোপের দেশ ভ্যাটিকান, এবং বেলজিয়ামের ওয়াটার লুর যুদ্ধক্ষেত্রে।
ইতিহাসের বাঁক থেকে আমরা চলে যাই চতুর্থ অধ্যায় অরণ্য আড়ালে।
মনে পড়ে যায় হীরক রাজার দেশের গান
‘এ যে দৃশ্য, এ যে অন্য /এ কি বন্য, এ অরণ্য/হেথা দিনেতে অন্ধকার/ হেথা নিঝুম চারিধার...............’
মেক্সিকোর রেইন ফরেস্ট এর মাঝে দুর্গ শহর কালাকমুলের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে এই অধ্যায়। এরপর রয়েছে এক শ্বাপদের মুখোমুখি হওয়ার গল্প।
এরপর আমাদের ঘরের কাছে নেপালের চিতোয়ান বনে চলে যাবেন, প্রেইরির মাঝে নিশাচর পেঁচা আর শেষে জঙ্গলের রাজা বুনো আফ্রিকার গল্প।
অরণ্যের পর পঞ্চম অধ্যায়ে নেমে যাবেন জলের ভিতর। ‘জলে কার ছায়া’ অধ্যায়ে টিটিকাকা হ্রদ, কানিবার নদী, মেক্সিকো উপসাগরের স্বাদ পাবেন। সবশেষে লেখকের সাথে নেমে যাবেন ক্যারিবিয়ান সাগরতলে।
সাহিত্য সাফারি অধ্যায়ে লেখক চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন বিশ্বের নানাজায়গার যেগুলো সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
প্রথমে প্যারিসে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের দোকান শেক্সপীয়ার অ্যান্ড কোম্পানিতে চলে যাবেন। অ্যানা ফ্রাঙ্ক নামের পনেরো বছরের মেয়েটির ডায়েরি যে আগুন ধরিয়ে ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে সেই অ্যানা ফ্রাঙ্ক যে বধ্যভূমিতে মারা যান তার বর্ণনা জানতে পারবেন এখানে। কিউবার যে জেলে পল্লীতে থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে রচনা করেছিলেন তার অমর সৃষ্টি ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ সেখান থেকে ঘুরে আসবেন লেখকের সাথে। চুপি চুপি বলে রাখি হেমিংওয়ের জীবদ্দশায় প্রকাশিত ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-র প্রধান চরিত্র সহানুভূতিপ্রবণ কিউবার জেলে সান্টিয়ানোর কারণে উপন্যাসটি কিউবায় একটি স্কুলপাঠ্য বই।
তিনি তার নোবেল পুরস্কার মেডেল (প্রাপ্ত অর্থ ৩৫০০০ ডলার জয়) কিউবার একটি চার্চকে দিয়ে দিয়েছেন।
ফ্রাঙ্কফুটের বিখ্যাত বইমেলা দেখে আসবেন। আর যাবেন কিংবদন্তী বাশিওয়ালার শহর হ্যামিলনে।
সপ্তম এবং শেষ অধ্যায়ে কলাকেলিতে ফ্লোরেন্স ঘুরে আসবেন লেখকের সাথে। যাবেন গ্রীসের পার্থেননের মন্দিরে। যাবেন তুরস্কের বিখ্যাত স্থাপনা হাজিয়া সোফিয়া বা সেইন্ট সোফিয়ার মসজিদে।
দ্যা ভিঞ্চির গ্রামে ঘুরে আসবেন, দেখে আসবেন তার আঁতুড় ঘর। ভ্যান গগের জাদুঘর দেখে আসবেন। সব শেষে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর স্থানে যাবেন বহুকাল আগে যাকে দেখে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন আর অমর কবিতাঃ
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে শুধাই ‘বলো দেখি
মোরে ভুলিবে কি’,
হাসিয়া দুলাও মাথা; জানি জানি মোরে ক্ষণে ক্ষণে
পড়িবে যে মনে।
দুই দিন পরে
চলে যাব দেশান্তরে,
তখন দূরের টানে স্বপ্নে আমি হব তব চেনা—
মোরে ভুলিবে না।
পঁয়তাল্লিশটি ভ্রমণকাহিনীর এক অনবদ্ধ সংকলন ‘পৃথিবীর পথে পথে’।
পুরোটা সময় পাঠককে আঁটকে রাখবে বইয়ের পাতায়। নিয়ে যাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
একটা কথা না বললেই নয় অনেকেই ভ্রমণ পিয়াসী। অনেকেই ছবি তুলে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কিন্তু সে স্থানের বর্ণনা যাতে করে পাঠকদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সে স্থানের নিখুঁত ছবি এবং পাঠকেরও সে স্থান ভ্রমণের ইচ্ছা হয় তা কিন্তু সবাই করতে পারেন না। তা নিপুণভাবে করেছেন তারেক অণু।
লেখার সাথে সাথে সুন্দর ছবিগুলো এক নিমিষে পৌঁছে দেয় পাঠককে সে স্থানে। ভ্রমণকাহিনী কতটা সুখপাঠ্য হতে পারে তার একটি নমুনা এই বই। সকলকে পড়ার অনুরোধ রইল।
আমার জানামতে লেখক আরও অনেক জায়গা ভ্রমণ করেছেন। আশা করি ভবিষ্যতে সেগুলোর সংকলন পাব।
সাথে সাথে আরেকটি বই দাবি করছি ‘বাংলাদেশের পথে পথে’ নামে।
একাকী মানব
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।