( এক বন্ধু তার এক কাজের জন্য গল্প চাইলো । ভিডিও বেস কাজ । কয়েক মিনিটের । থিমটাও দিলো । আজ সকালে এক বসায় লিখে ফেললাম গল্পটা ।
সরল একটা গল্প । গল্পটা উৎসর্গ করলাম মামুন রশিদ ভাইকে । যে কয়জন মানুষের উৎসাহ এই ব্লগে লিখতে সাহস যোগায় তার মাঝে আপনি একজন ।
গল্প তবে শুরু হোক... )
১
নিতুনের আরও বড় হওয়ার কথা ছিলো ।
২
না এমন বড় নয় যে, গত বছরের জামাটা এই বছরে আর গায়ে হবে না ।
এমন বড়ও না হঠাৎ দেখে কেউ চোখ বড় বড় করে বলবে, আরে নিতুন এতো বড় হয়ে গেছিস ! সেদিনও তো কোলের মধ্যে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে পড়ে থাকতিস । কিংবা পাশের বাসার নিঝুম এসে কানে কানে কোনও গোপন কথা বলে চোখ পাকিয়ে বলবে, তুই এটা জানতিস না?? এতোটা বড়ও না ।
কিন্তু নিতুনের এখন ফড়িং ধরবার কথা ছিলো । মখমলের মতো নরম ঘাসের গায়ে খুব সতর্ক যে ফড়িং তার লেজে সুতো বেঁধে দৌড়ে বেড়ানোর কথা ছিলো নিতুনের । দুপুরবেলা দারোয়ান চাচা ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো ।
তারপর সারা দুপুর হেঁটে হেঁটে সারা পাড়া । আইসক্রিমওলা কিভাবে গলা টেনে টেনে ডাকে, আইসক্রিম নিবেন আইসক্রিম । মধ্যদুপুরে মাঝপুকুরে ঢিল ছুঁড়লে কতটা আওয়াজ হয় । নিঝুমদের বড়ই গাছে টুনটুনিটা কি ডিম দিয়েছে , বিরেন চাচা আজকেও জিলেপিতে মিষ্টি বেশি হয়েছে কিনা জানবার কথা ছিলো মিতুনের । নিঝুমের সাথে নতুন পুতুলটা নিয়ে ঝগড়া করে, আড়ি দিয়ে জীবনের মতো সম্পর্ক শেষ করে কান্না করার কথা ছিলো ।
স্কুলে গিয়ে পড়া না পেড়ে কান ধরা , খানিকপরে প্রিয় বন্ধুকেও কান ধরে দাঁড়াতে দেখে মুচকি হাসা , স্কুল শেষে আঁচার খেতে খেতে বাড়ি ফেরা । বৃষ্টি এলে আম্মুর ফোন , ভিজবে না কিন্তু একদম সাবধান করে দিলাম । তারপর বৃষ্টিতে ভিজে শরীর মুছে লক্ষ্মী মেয়ের মতো আম্মুর অপেক্ষা । আর জ্বরটা যদি এসেই যায় তাহলে অপরাধীর মতো মুখ করে আম্মুকে ডাকা । এতোটুকুই বড় হওয়ার কথা ছিলো নিতুনের ।
৩
কিন্তু নিতুন বড় হতে পারে না । ওর জীবন আটকে গেছে এক দুর্ঘটনায় । সেদিনও ব্যস্ত সকাল ছিলো । স্কুল ড্রেস পড়ে দ্রুতই নামছিল নিতুন সিঁড়ি বেয়ে । তাড়াহুড়োতে খেয়াল করেনি তার সদ্য হাঁটতে শেখা ছোট ভাই মিতুন একটা খেলনা ফেলে রেখেছিলো সিঁড়িতে ।
নিতুনের পা পড়েছিলো খেলনাটার উপরে , তারপর ওর আর কিছু মনে নেই । জ্ঞান ফেরার পর অবাক বিস্ময়ে নিতুন আবিষ্কার করে অন্ধকার কি প্রবল হতে পারে । ও চিৎকার করে বলেছিলো, মা আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেনও ?? এরপরে আর সে ঘাস ফড়িঙের পেছনে দৌড়াতে পারেনি । দারোয়ান চাচা ঘুমিয়ে গেছে কিনা আর খোঁজ রাখে না মিতুন । আইসক্রিমওয়ালার ডাক অলিতে গলিতে হারিয়ে যায় ।
ভর দুপুরে ঢিল পরে না মাঝ পুকুরে । টুনটুনিরা আজও আছে কিনা গাছের ডালে কে জানে । স্কুলে যাওয়া হয়না কতদিন, এখনও কি তার প্রিয় বন্ধুরা পড়া না পেরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, এখনও কি তাদের নিতুনের কথা মনে পড়ে, জানা হয়না নিতুনের । কার পুতুল বেশি সুন্দর এই নিয়ে ঝগড়া হয়না নিঝুমের সাথে , আড়ি ছাড়াই কথাহীন কাটে দিনের পর দিন । বৃষ্টি এলে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে ও ।
কারও মিশতে ইচ্ছে করে না , ইচ্ছে করে না কারও সামনে যেতে অন্ধত্ব নিয়ে । নিতুনের জীবন থমকে থাকে ঠিক দুর্ঘটনার দিনটাতে ।
৪
অথচ সবাই এগিয়ে যায় । সেদিনও নিতুনের ছোট্ট ভাইটা আধো আধো বোলে কথা বলতো সেও এখন পরিষ্কার কথা বলে । কিন্তু এখনও আতা আতা ডাকটা ছাড়তে পারেনি ।
সবসময়ই আতা আতা ডাকে আর নিতুনকে খোঁজে মিতুন । কিন্তু তার আতা আর আগের মতো সাড়া দেয়না । আগের মতো আদর করে না । আগের মতো কোলে নিয়ে ছুটে বেড়ায় না এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত । লুকিয়ে লুকিয়ে মুখের ভিতরে পুরে দেয়না লজেন্স , আম্মুকে ফাঁকি দিয়ে ঝুলতে দেয়না বারান্দায় , মুখোশ পড়ে ভয় দেখায় না ।
বই বের করে পড়ে শোনায় না আশ্চর্য সব রাজপুত্র আর রাক্ষসের গল্প । মিতুন বুঝতে পারে না কেনও আতা এমন হয়ে গেলো । এটাও কি কোনও খেলা?? সেই খেলাটার মতো , মাঝে মাঝে নিতুন নাই হয়ে যেতো । মিতুন যখন খুঁজে খুঁজে হয়রান তখন কোত্থেকে নিতুন তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতো টুকি ! মিতুন বোঝে না, কেউ তাকে কিছু বলে না । বোঝে না বলেই এই ঘর ওই ঘর নিতুনকে সে খুঁজে বেড়ায় আর ভাঙ্গা গলায় ডাকে, টুকি ।
মিতুন জানে না, খেলা নয় নিতুন বেছে নিয়েছে সত্যিকারের আড়াল । বাইরের বারান্দায় গ্রিলের সাথে লেগে থাকা সবুজ লতানে গাছগুলো একটা পাশ অন্ধকার করে রেখেছে । মিতুন সেই অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকে । কোনও শব্দ কোনও মানুষ সেখানে পৌঁছায় না । হঠাৎ হঠাৎ মিতুন সেই জায়গাটা খুঁজে বের করে ফেলে ।
আতাকে খুশি করতে কখনও কখনও লজেন্স নিয়ে আসে কখনও নিয়ে আসে রুপকথার বই । নিতুনের নিস্প্রান চোখ ভিজে যায় । সবুজের ফাঁক গলে কোনও পথভোলা শেষ বিকেলের রোদ যদি বারান্দায় এসে পড়ে পড়ে তবে সেও থমকে যায় নিতুনের চোখের জলে । মিতুনের কষ্ট হয় নিতুনের চোখে চকচকে জল দেখে , অবুঝের মতো ডাকতে থাকে আতা আতা । শেষ বিকেলের রোদ চুপ থাকে, নয় বছরের একটা মেয়ের কষ্ট ধারণ করার ক্ষমতা ওই ক্ষুদ্র অশ্রুবিন্দুর নেই, এই জেনে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।