আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুধে-ভাতে সংসার

ষাটের দশকে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার খোলাশ গ্রামে কারও ঘরে দুই বেলা ভাত ছিল না। সামর্থ্য ছিল না মাটির ঘরে খড়ের ছাউনি তোলার। জনপদ ছিল প্রায় কর্মহীন। দিনমজুর কুরানু মোল্লা, আবুল হোসেন আর সুলতান ফকির কাজের খোঁজে গেলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরে। কাজ জুটল বিহারিদের মালিকানাধীন খেলনা কারখানায়।

অল্প দিনেই বনে গেলেন পাকা কারিগর।
গ্রামে ফিরে নিজেরাই শুরু করলেন খেলনা তৈরির কাজ। বাঁশের কাঠি, পশুর চামড়া আর মাটির খুড়ি দিয়ে তৈরি করলেন খেলনা টমটম গাড়ি। গ্রামীণ মেলা, উৎসব-তিথি-পার্বণে শিশুদের কাছে এ খেলনা কদর পেল। দ্রুত বদলে যেতে থাকল দারিদ্র্যপীড়িত এ নিভৃতপল্লিটির দৃশ্যপট।

ঢাকাসহ খোলাশের খেলনার বাজার ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। বদলে গেল গ্রামবাসীর ভাগ্য।
যে গ্রামে একসময় কাজ ছিল না, সেই গ্রামে দিন-রাত এখন ভেসে বেড়ায় খেলনা তৈরির খটখট শব্দ। বাড়ির নারী ও কিশোরীদের কাঠিতে রং লাগানো ও কাগজে আলপনা আঁকার হইচই আর বৈদ্যুতিক মোটর চলার একটানা গুঞ্জন। বাড়ির উঠানে, খুলি-আঙ্গিনায় চলছে কাঠ, বাঁশ আর কাগজ দিয়ে শিশুদের রংবেরঙের টমটম গাড়ি বা টরটরি গাড়ি, কাঠের গাড়ি, কাঠের চরকা, কাঠের পাখি, বেহালা, সারিন্দা, ঘিন্নিসহ হরেক খেলনা তৈরির ধুম।


প্রতিবছর বৈশাখী উৎসব ঘিরে বেড়ে যায় এখানকার কারিগরদের ব্যস্ততা। বর্তমানে সাতটি কারখানাসহ খোলাশের প্রায় দুই শ ঘরে তৈরি হচ্ছে শিশুদের খেলনা। টমটম গাড়ির মাটির খুড়ি ও চাতকি তৈরি হচ্ছে পাশের চেঙ্গাপালপাড়া গ্রামে। সব মিলিয়ে খেলনা তৈরির এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
যেভাবে শুরু: ষাটের দশকে তিন কারিগরের হাত ধরে খোলাশ গ্রামে খেলনা তৈরির যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, সেই কারিগরেরা একসময় নিজেরাই সারা দেশের আনাচে-কানাচে এ পণ্য ছড়িয়ে দিতেন।

নারীরা বাড়িতে খেলনা তৈরি করতেন আর পুরুষেরা তা নিয়ে ছুটতেন বড় বড় মেলায়। ঢাকার আজিমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের লালদীঘি জব্বারের মেলা, সান্যাল ফকিরের মেলা, দোহারের নুরুল্যাপুর মেলা, কুষ্টিয়ার লালনের মেলা, ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া মেলা, দিনাজপুরের চরকাই এবং বগুড়ার পোড়াদহ মেলায় প্রচুর খেলনা বিক্রি হতো। বর্তমানে এসব মেলার পাশাপাশি রমনার বটমূলের মেলাসহ বৈশাখী মেলাগুলোতে এসব খেলনার প্রচুর কদর। পাইকারেরা এসেও এখান থেকে খেলনা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
খেলনাপল্লির খোঁজে: বগুড়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদর।

সেখান থেকে কাঁচা-পাকা মেঠোপথ ধরে চার কিলোমিটার দূরে খোলাশ গ্রাম। ৯ এপ্রিল খোলাশ গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, কেউ খেলনা হাতলের জন্য আনা কাঠ ও বাঁশের কাঠিতে রং লাগাচ্ছেন, কেউ রংবেরঙের কাঠি রোদে শুকাচ্ছেন, কেউ বাঁশ দিয়ে টমটম গাড়ির চাতকি বানাচ্ছেন, কেউ চাতকিতে রং লাগাচ্ছেন, কেউ সিমেন্টের মোটা কাগজ কাটছেন, নারী ও শিশু কারিগরেরা সেসব কাগজে আলপনা আঁকছেন, কেউ তৈরি শেষে খেলনা টমটম গাড়ি বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখছেন।
নারী কারিগরদের কর্মযজ্ঞে সারা বছর মুখর থাকে এ গ্রাম। খাতেমন বিবি বলেন, ‘মাত্র ৮০ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেছি। এখন একসঙ্গে কয়েক হাজার টমটম গাড়ি তৈরির পুঁজি খাটে ব্যবসায়।


কারিগরেরা জানান, মাটির খুড়ি দিয়ে তৈরি টমটম গাড়ি এবং প্লাস্টিকের পাখি-ফুল সব খেলনাতেই কাঠের হাতল লাগে। আগে হাতে তৈরি করলেও এখন করাতকল থেকে এসব হাতল কেটে এনে রং লাগান তাঁরা। এরপর মাটির খুড়ি, চাতকি, চাকা ও মোটা কাগজ, বাঁশের কাঠি, সুতলি দিয়ে তৈরি করা হয় টমটম গাড়ি। আর টিনের পাতি, প্লাস্টিকের তৈরি চাকা, পাখি ও ফুলের আদলে কাঠামোর সঙ্গে হাতল লাগিয়ে তৈরি করা হয় প্লাস্টিকের খেলনা।
বাড়ির খুলিতে তপ্ত রোদে কাঠের কাঠিতে রং লাগাচ্ছিলেন কারিগর রমজান আলী (৫০)।

কলেজপড়ুয়া মেয়ে ফাতেমা-তুজ-জোহরা তাঁকে সাহায্য করছিলেন। গা থেকে তরতর করে ঘাম ঝরছিল রমজান আলীর। রমজান বলেন, ‘দম ফ্যালাবার টাইম নাই, কয়দিন পর বৈশাখী মেলা, মালের ম্যালা চাহিদা পাচ্চি, দিনরাত-সমান করে খেলনা বানাচ্চি, মাল লিয়ে ঢাকার (রমনা) বৈশাখী ম্যালাত যামো, রোদত রং না লাগালে শুকাবি না, তাই রোদত বসেই কাজ করিচ্চি। এক একটা কাঠিত তিনবার করি রং লাগাতে হবি। ’
প্রবীণ কারিগর আফজাল হোসেন ফকির (৭৫) বলেন, ‘কুড়ি বছর বয়স থেকে খেলনা তৈরি করছি।

জীবনের ৫৫টি বছর এ পেশায় কেটে গেছে। এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক সুখ-দুঃখের গল্প। এ জন্য নিজের হাতে তৈরি একেকটি খেলনাকে মনে হয় একেকটি সন্তান। ’
তিনি বলেন, আগে একটি টমটমে এক পয়সারও কম খরচ লাগত। এখন টমটম গাড়িতে গড়ে চার টাকা এবং প্লাস্টিকের পাখির খেলনায় গড়ে পাঁচ টাকা খরচ পড়ে।

খুচরা বিক্রি হয় যথাক্রমে ১৫ ও ২০ টাকায়।
ভাগ্যবদলের উপাখ্যান: খোলাশ গ্রামের হানিফ মোল্লার অতীত জীবনটা কষ্টের, হতাশার। বাবার এক শতক জমিও ছিল না। দিনমজুরির উপার্জনে সংসার চলত। ছোটবেলায় জড়িয়ে পড়েন খেলনার ব্যবসায়।

গ্রামের কারিগরদের সঙ্গে প্রথমে বিভিন্ন মেলায় খেলনা বিক্রির জন্য যেতেন। মেলা শেষে হাতে পাঁচ-দশ টাকা ধরিয়ে দিতেন কারিগর-ব্যবসায়ীরা। একসময় নিজেই খেলনা তৈরি ও বিক্রির পেশায় জড়িয়ে পড়েন হানিফ। বনে যান খেলনা তৈরির পাকা কারিগর। ব্যবসার কৌশলেও জেনে যান।

এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। হানিফ মোল্লা এখন শহরের পাকাবাড়িতে থাকেন। চড়েন মোটরসাইকেলে। গ্রামে আবাদি জমি কিনেছেন তিন বিঘা। গ্রামে দিয়েছেন প্লাস্টিকের খেলনা তৈরির কারখানা।


হানিফ মোল্লা বলেন, ‘খুব কষ্টে দিন কেটেছে। বহুদিন অনাহারে থাকতে হয়েছে। দুই চাকার খেলনা টমটম গাড়ি একসময় ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন গাড়ি, বাড়ি, জমিজমা, কারখানা সবই আছে। দুধে-ভাতে সংসার আমার।


দৃষ্টান্ত: দুপচাঁচিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, চেষ্টা, পরিশ্রম আর একতা দিয়ে যে দারিদ্র্য জয় করা যায়, তা খোলাশ গ্রামের লোকজন দেখিয়ে দিয়েছেন। মাটির দুই চাকার খেলনা তৈরির মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে তাঁরা গ্রাম থেকে অভাব তাড়িয়ে এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।