নিঃস্ব হবো জেনেও, দর্শনার্থী আমি। বাইরে বোধয় রাত এখন। এখানে কবরের অন্ধকার। চারদিকে লাশের পচা-বোটকা একটা গন্ধ। দম নেওয়াই দুষ্কর।
মাঝে মাঝে দম বন্ধ করে রাখছি। মনে হচ্ছে, বেশি দম নিলে বাতাস ফুরিয়ে যাবে। বিল্ডিংটা যখন প্রথম ধসে পড়ে,আমি মনে হয়, কয়েক দিনের জন্য অজ্ঞান ছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম আমার বাম পা খানা একটা পিলারের নিচে বিচ্ছিরি রকম ভাবে আটকে আছে। মাথাটা সম্ভবত ফেটেছে।
ঘাম-রক্ত আর ধুলায় মেশানো কোন এক নোনতা তরল পদার্থ গাল বেয়ে নেমে ঠোঁটের কোনায় ঝুলছে। জমে শক্ত হয়ে গেছে। তবে, সবচে আশ্চর্যের বিষয় মাথায়একটা চাপা ব্যাথা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করছি না।
মনে হয়, তিন চার দিন যাবৎ আটকে আছি এখানে। দিনের বেলা হালকা একটা আলোর রেখা আসে।
তখন সেই ঝাপসা আলোতে চারপাশ কিছুটা দেখা যায় । আলেয়া অনেকক্ষণ চিৎকার করেছে- আল্লাহকে ডেকেছে-গারমেন্টসের মালিক গুলোকে গালাগাল করেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ। এখন বোধয় আর বেঁচে নেই। আহা ! মেয়েটা বড্ড ভালো ছিলো।
পাশপাশি মেশিনে কাজ করতাম আমরা। কত্ত কথা যে বলতে পারতো মেয়েটা- শুধু হাসতো। আর এখনচুপ। একদম চুপ । বড্ড ক্লান্ত লাগছিল আমার ।
কখন যে অচেতনহয়ে গেছিলাম বুঝতেই পারি নি। এত নিচে আটকেআছি কেউ যে বাঁচাবে তার আশাও নেই।
কোথায় যেন একটা মেশিনের শব্দ হচ্ছে। আমার হাতা-শেলাই করার মেশিনটাই কি ? আরে ধুর কি ফালতু ভাবছি। খুব ক্ষীণ একটা শব্দ কানে ভেসে আসছে ।
মনে হচ্ছে বহু দূর থেকে ভেসে আসছে –
“ এখানে কেউ আছেন .....কথা বলেন .... কেউ আছেন এখানে ...???”
ওই তো কেউ হয়তো এলো। আমাকে বাঁচাতে আসছে কেউ ! ইচ্ছে করছে সাত আসমানকাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠি-
“আমি আছি !! আমি বেঁচে আছি !! আমাকে বাঁচান ভাই !! আমাকেবাঁচান !! আমাকে আপনার বাঁচাতেই হবে। আমি ছাড়া আমার পরিবারের যে, আর কেউ নেই। ”
কিন্তু কি আশ্চর্য আমারগলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না !! আমি কি করবো ? আমাকে যে বাঁচতেই হবে !! আমি না বাঁচলে আমার ছোট্ট বাবু টার কি হবে ? রুনার কি ভালো বিয়ে হবে ? আমার অন্ধ মায়ের কি হবে ?
নিজেকে বার বার এসব প্রশ্ন করতে করতে জরি আবারও মূর্ছা গেলো।
হঠাৎ তার মুখে একটাটর্চের আলো পড়লো।
কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলো এখানে একজন বেঁচে আছে !! কেউ অক্সিজেন আনো !! একটু ফাস্ট এইড !!!
শেষ কথাঃ বাস্তবে যে জরি রানা প্লাজার ভাঙ্গা পিলারের নিচে গত তিনদিন অন্ধকারের মধ্যে পড়ে ছিল- সে বেঁচেনেই। কিন্তু, আমার জরি বেঁচে আছে । আমার জরিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে। কারণ,আমি ট্রাজিডি লিখতে বসি নি। আমার জরিকে বাঁচিয়েরাখতে হয়েছে- কারণ, একটা দুধের বাচ্চার মুখে দুধের বাট তুলে দেওয়ার মা কে আমি মেরে ফেলতে পারি না।
আমার জরিকে বাঁচিয়ে রাখতেহয়েছে- কারণ, জরি মরে গেলে- বস্তিতে বেড়ে ওঠা রুনাকে, উপর-তলার নষ্ট মহলের ভুখাকুকুর গুলো থেকে আগলে রাখার কেউ থাকতো না। আমি জরিকে মেরে ফেলতে পারি নি কারণ –জরি মরে গেলে, দারিদ্র আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কোন এক বৃদ্ধাকে জীবনের কাছে আবারও পরাজিত হতে হতো। আমি পারিনি- জরির সাথে সাথে একটা গোটা পরিবার কেমেরে ফেলতে; একটা গোটা সমাজকে মেরেফেলতে।
তুমি যেখানেই থাকো ভালো থাকো, জরি।
আমার শুধু এটুকুই সান্তনা মারা যাওয়ার আগে রানাপ্লাজার কাঁচের চুরি পড়া জরি নামের মেয়েটা বুঝতে পেরেছিল যে তার চারপাশের পৃথিবীটাতে এখনও কিছু মানুষ বেঁচে আছে।
কেউ একজন চাইছিলো সে বেঁচে থাকুক। তার জন্যই ডাকছিল - “ এখানে কেউ আছেন .....কথা বলেন .... কেউ আছেন এখানে ...???” ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।