আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি।
আমি বাঘের গল্প জানি! ওইযে বাঘ খাইয়া ফেলে সিংহ, সিংহের মা কান্নাকাটি কইরা অস্থির। ঘুমঘোরে পালাইয়া যায় হরিণ, শিয়ালের আত্নীয়রা সব বাসা বাঁধে সিংহের গুহায়। গল্পটা একটু জটিল কিসিমের। টানা এই কথাগুলো বলে কাদের থেমে গেল।
লোকটা অভিনেতা আবদুল কাদেরের মত না তবে কথা বার্তা অনেকটা সেরকম। একটু বিরক্তি ধরে গেছে আমার। দ্রুত কথা বলা মানুষগুলোকে বরাবরই আমার বিরক্ত লাগে। কাদের এসেছে আমার কাছে গল্প বিক্রি করতে। সে মুখে মুখে গল্প বলবে আমি সেটা লিখবো।
গত দু’মাস যাবত নিদারুন গল্প সংকটে ভুগছি। গতকাল সন্ধ্যায় চা দোকানে কাদেরকে দেখলাম লোকজনকে গল্প শুনিয়ে বেশ হাসাচ্ছে। কি গল্প ঠিক শুনতে পেলাম না। তবে কাদেরকে তার গল্প বলা শেষে আড়ালে ডেকে আমার কাছে আসতে বলেছিলাম। আজ সে অফিস ছুটি নিয়ে হাজির! কথাবার্তার মাঝখানে জানতে পারলাম সে আমার পাশের রুমের আজগর ভাইয়ের অফিসের পিয়ন।
ভাই আরেকটা গল্প আছে সাপের। সাপ সারাদিন ইন্দুর ধরবার জন্য গর্তে গর্তে ঘুরেফিরে কিন্তু ইন্দুর পায় না। আবার ইন্দুর ছোটছোট পোকা খুজে, পোকারা ধোঁকা দেয়। এই রকম আরকি। কাদের নিঃশ্বাস ফেলে আবার শুরু করে “আবার ধরেন গিয়ে “একটা বিড়াল আর শুকর ছানার অসামাজিক প্রেম, বিড়ালটা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়..”।
মাথাটা মোচড় দিয়ে উঠে আমার। বলেই ফেলি “এই বললেন শুকরছানা,তাহলে বিড়ালটা প্র্যাগন্যান্ট হয় কিভাবে?
-সেইটাইতো ভাই টারেজেডি।
না লোকটার এট্রাক্টিং পাওয়ার আছে। অনেক্ষন দেখে নিশ্চয় বুঝেছে আমি বিরক্ত হচ্ছি তাই এই গল্প ফেঁদেছে। ভাবছি এই পশুপাখী প্রিয় লোকটাকে কিভাবে বিদায় করা যায়।
“আচ্ছা আপনি পশুপাখীর বাইরে কোন গল্প জানেন না?
-ভাই জানেন না কথাটা ভুল কইলেন। বলবেন বানান না? আমি ভাই কারিগর, মুখস্ত কিছু কই না।
-আচ্ছা কারিগর সাহেব পশুপাখীর চিড়িয়াখানা না বানাইয়া একটা অন্যগল্প বানানতো দেখি।
কাদের ভাবনায় পড়ে গেল। আমি যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
কাদেরের মুখে ভাই শুনে আবার বিষন্ন হয়ে গেলাম। কাদের শুরু করলো “অতি সুন্দরী এক মেয়ে, তার জন্য মহল্লার সব যুবক পাগল। এই মাইয়ার একদিন বিয়া হইল এক গরীব লোকের লগে। পরে মাইয়া প্রেম শুরু করলো এক অজগর সাপের লগে”
“কাদের থামুন! আপনি আবার চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলছেন”
কি হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। কাদের হুড়মুড় করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
কি মুশকিল। কি করি এখন?
আমি কিছুটা নমনীয় হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কাদের সাহেব কি হয়েছে আপনার? নিরুত্তর কাদের কেঁদেই চলেছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রেমিকার অভিমান থামাতে পারিনি বলে চারটে প্রেম কেবল প্রেমেই থেমে গেল। আর কোথাকার কোন কাদেরের কান্না কিভাবে থামাই? যাক কান্না করুক।
আমি আমার মত সিগারেট জ্বালিয়েই যাচ্ছি। কাদেরের ব্যাপারটা বিরক্তিকর না আসলে বেশ ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে। লোকটা কি আগে চিড়িয়াখানার দারোয়ান ছিল নাকি? আজগর ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এছাড়া তার পশুপাখী প্রীতির কোন কারন দেখছি না। অথবা এমন হতে পারে লোকটা পূর্বজন্মে পশুপাখী ছিল? ছি ছি এসব ভাবা উচিত হচ্ছে না।
সস্তা লিখি আর যাই লিখি গল্পইতো লিখি। গল্পকারদের পূব জনম আগামি জনম বিশ্বাস করলে চলে না। আমি বুঝতে পারছি কাদের ভালো করে ঝেঁকে বসেছে মাথায়। ব্যাটার ক্ষমতা আছে বটে।
“দুক্ষিত ভাই” কাদেরের স্বরে কিছুটা চমকে উঠলাম।
-ঠিক হয়েছেন?
-জ্বি ভাই। একদম ঠিক।
-এখন তাহলে একটা গল্প বলুন। হোক পশুপাখীর। গন্ডার নিয়ে কিছু বলেননি মনে হয়
-থাউক ভাই আইজকা আর মুড নাই।
আমি যাইগা। পরে একদিন আইসা শুনাইয়া যামুনি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর যাই হোক একটা মানুষকেতো আর জোর করে গল্প বলানো যায় না। কাদের হ্যান্ডশেক করে চলে গেল।
হাতটা অত্যন্ত ঠান্ডা। কেঁপে উঠলাম। মনে হল একটি সাপ আমার হাত স্পর্শ করে গেছে।
কাদের চলে গেছে ঠিকই তবে আমার গল্প সংকটকে আরও বেহাল দশায় ফেলে গেছে। গল্প নিয়ে ভাবনারও সংকট দেখা দিল।
আমরা ভাবনাজুড়ে কাদের। আজগর ভাই অফিস থেকে ফেরার পর কাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আজগর ভাইয়ের ভাষ্যমতে “লোকটা পাগল কিসিমের,কিন্তু অত্যন্ত সহজ সরল। সরাসরি কাউকে কিছুই বলতে পারেন না। শুনেছি তার বৌ টা নাকি অতি সুন্দরী”
বেশ ইন্টারেষ্টিং! কাদেরতো কাঁপিয়ে দিল রীতিমত।
তবে তার বৌ সুন্দরী এর সাথে পশুপাখীর সম্পর্কটা ঠিক বের করতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত গল্পকার থেকে গোয়েন্দা হয়ে যাবো নাকি? আজগর ভাইয়ের কাছ থেকে আরও জানার চেষ্টা করেও লাভ হল না। তিনি তেমন কিছু জানেন না। তবে আজগর ভাই লোকটার মুখে পশুপাখীর গল্প ছাড়া একটা গল্পই শুনেছেন। সেটা অনেকটা রুপকথার গল্প টাইপের ছিল।
আজগর ভাই চাকরী করে খেটে খাওয়া প্রাণী। উনি গল্পটা বলতেই পারলেন না। অবশ্য বলতে পারলে কি আমাকে গল্পকার মনে করতেন নাকি?
তিন চারদিন পার হয়ে গেল। কাদেরে কোন খবর নেই। কাদেরকে ঘিরে প্রায় অলৌকিক একটা গল্প লেখা শুরু করে দিয়েছি ইতোমধ্যে।
গল্পটার শেষে দারুন টুইষ্ট থাকবে। পাঠক চমকে যাবে। শেষদিকে কাদেরকে সাপ কিংবা সিংহের প্রতিনিধি বানিয়ে দেয়ার ইচ্ছা আছে। ওই যে দ্বৈত সত্ত্বা আরকি। একাধারে মানুষ আবার সাপও।
এক সন্ধ্যা এক মগ চা হাতে গল্পের শেষটা লেখা শুরু করেছি। তখনই দরজায় ঠক!ঠক। কাদের!
আমার খুশীর মাত্রা আমি বুঝাতে পারবো না। রীতিমত প্রধানমন্ত্রী আদরে তাকে সম্ভাষন জানালাম। তাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেই চা বানিয়ে আনলাম।
“তারপর কাদের সাহেব বলুন, কেমন আছে আপনার পশু পাখীরা”
কাদেরের মুখ শুকনো। আগের দিন শুরু থেকে বাচাল ছিল। আজ তার উল্টো। কাদের বলা শুরু করল “ভাই আফনেরে আমার দারুন পছন্দ হইছে। আফনেরে একটা সত্যি গল্প বলুম।
সত্যি গল্প। আমি কাউরে কিছু কইতে পারিনা। আফনেরে কমু”
আমি বেজায় খুশী “আচ্ছা বল”
কাদের ঢোক গিলে শুরু করল। “ভাই আমি কোনমতে ইন্টার পাশ করছি, কইরাই পিয়নের চাকরী নিছি। এলাকার এই মাইয়ার সাথে আমার ভালা খাতির আছিলো।
নয়া চাকরী পাইয়া তারে বিয়ার কথা কইতেই রাজি হইয়া গেল। মাইয়া কিন্তুক বিরাট সুন্দরী” বলতে বলতে কাদেরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।
-মেয়েটার নাম কি?
-ভাই মেয়েটার নাম কমলা। গায়ের রঙ দুধে আলতা, ঠোঁট দুইটা একদম কমলা কালারের ভাই।
কাদেরের লাইনের মাঝখানে ভাই বলাটা গল্পের মনযোগ ব্যহত করছে বলে তাকে ভাই বলতে নিষেধ করলাম।
সে প্রতিবাদ জানালো “না ভাই, ভাই না বললে আমি গল্প কইতে পারতাম না।
-আচ্ছা ভাই বলেই বলেন
-তো ভাই কমলাতো বিরাট সুন্দরী! এলাকার পোলাপাইনের মাথা নষ্ট। আমি কি কি করি? এইদিকে ঘরে এইরকম আগুন রাইখাতো অফিস করনও যায় না। সব চিন্তা কইরা বাসাটা পাল্টাইয়া ফালাইলাম। সেইটা করলাম জীবনের সবচাইতে বড় ভুল”
-ভুল কেন?
-কইলেই বুঝবেন ভাই।
আমি নিজেরে সিংহ ভাবতাম। বনের রাজা, কিন্তু বাসা পাল্টানোর পর আমার অফিসের সুযোগে আমার বৌরে অজগর সাপে খাইয়া ফালাইছে?
-অজগর সাপে খেয়ে ফেলেছে মানে সাপে কেটেছে?
কাদের আবার কেঁদে ফেলল। সেদিনের সেই কান্নার মত। এবার আমি দ্বিগুন বিব্রত। সিগারেটও নাই।
থাক নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি বরং অপেক্ষা করি।
অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম মনে হয়। কাদেরের ভাই সম্বোধনে জেগে উঠলাম। “ভাই আমি যাইগা”।
আমি আৎকে উঠলাম সেকি! গল্পটাতো শেষ করুন। কাদের হো হো করে হেসে উঠলো “ভাই গল্পতো শ্যাস,ওইযে সুন্দরী এক মাইয়া আছিলো। সিংহ ফালাইয়া সে অজগর সাপের লগে প্রেম করে। পরে অজগর সাপ তাকে খাইয়া ফালাইয়া রাখে। যাইগা ভাই”।
দ্রুত কথা বলে কাদের চলে গেল। আমি ভাবনাতে পড়ে গেলাম। কমবুদ্ধির লোক হলে যা হয় আরকি। কাদের পুরো আমাকে নিয়ে খেলে গেল। ধুর!তবে অজগর সাপ ব্যাপারটি মাথায় ঘুরতে লাগলো।
রাত দশটায় আজগর ভাই বাসায় ফিরতেই জিজ্ঞেস করলাম “ভাই আপনি কি কমলা নামের কাউকে চিনেন?
আজগর ভাই আঁৎকে উঠলেন “কে কে কে বলল কমলার কথা?
ছবি : রিয়া ফারিহা।
টুকরো কথা: দেখতে দেখতে ব্লগে ২ বছর পার করে দিলাম। ২ বছরের ব্লগজীবনের জন্য সকল ব্লগারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।