বিধাতা দিয়াছেন জান, তাই বাঁচাতে এখন আমার উষ্ঠাগত প্রাণ। এই গত কয় বছরে আমার মনে হয়না, ভালো মানুষ যতটা না মিডিয়াতে আসছে তার চেয়ে বহুগুন বেশী টিভি চ্যানেল এই দেশে চালু হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের একটা টিভি চ্যানেল ও আমাদের দেশের দর্শকদের মন ভরাতে পারে নাই। বিষয়টা রহস্যজনক। এখন কী বলবো....টিভির যে অনুষ্ঠান তা কী মানসম্মত না....নাকি টিভির দর্শক হিসাবে আমরা রুচিশীল না? তবে দর্শক-এর রুচি নিয়েই আমার যত সন্দেহ।
আসেন বিষয়টা একটু পরিষ্কার করি।
গেল বাংলাদেশ-ওয়েষ্ট ইন্ডিজ-এর শেষ ওয়ানডে ম্যাচে চোখ ছিলনা এমন মানুষ বোধকরি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঠিক ঐদিন খেলার মাঝখানে আমি আশা নিয়া টিভি রুমে প্রবেশ করি। সাধারণত টিভি দেখা হয় না, অনলাইনে ভাতের ব্যবস্থায় ব্যস্ত থাকার কারণে। দর্শক মা, কুমিল্লা থেকে আসা ছোট বোন আর আমার প্রাণপ্রিয় সহধর্মীনি।
সবার চোখ টিভির স্ক্রিনে। আমার চোখ তাদের অনুসরণ করে যখন টিভিতে তখন মেজাজের চৌদ্দগুষ্ঠির সাথে দফারফা অবস্থা। রাতুল মাস্টার পায়েল সেনের কথপোকথন। আমার খুব একটা জরুরী মনে হয়নাই বিধায় রিমোর্টের একচাপে টাপুর টুপুর থেকে টাইগারদের ব্যাটিংয়ে। সাথে উপস্থিত দর্শকদের ব্যাপারে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, খেলায় মগ্ন।
কিছুক্ষণ পর দেখি ময়দান খালি। বোন আর বউ গালে টেইনিস বল ঢুকিয়ে পাশের ঘরে প্রস্থান। মা রক্ত চোখে আমার দিকে, আমি তো থতমত...কী ব্যাপার?
শুরু হলো মা’র ঘেনঘেনানী। ঘরের মেয়েরা নাকি সারাদিন কাজকর্মে ব্যাস্ত থাকার কারণে টিভির সামনে আসতে পারে না, যাও একটু সন্ধ্যার পর আসে আমার জ্বালায় নাকি তাও দেখতে পারে না। আমি তো থ! কোন ভাষা নেই।
বুঝতে সময় নিলো...কিসের জন্য এই বেদনা। দেরী না করে স্টার জলসা চ্যানেল এর জন্য বাটন টিপছি কিন্তু কত নম্বর চ্যানেল না জানার কারণে পাওয়ার অফ করে পুনরায় কম্পউটার এর সামনে। এসে বসতে না বসতেই এই ঘর থেকেই টিভির রুম থেকে ভেসে আসা গানের কলি ‘নাগর আমার নিঠুর বড়, মন বোঝে না..’।
কী বুঝলেন পাঠকরা। এই শুধু আমার পরিবারের দৃশ্য নয়...বাংলার ঘরে ঘরে একই চিত্র।
কী শহর, আর কী গ্রাম।
মূলতঃ আমাদের দেশে বেশীর ভাগ টিভির দর্শক মহিলারা। আর তাদের দখলেই থাকে টিভির রিমোর্ট। যাক, এই দখলদারিত্ব নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই, আপত্তি যত এই সব চ্যানেলে দেখানো নাটকের মান নিয়ে। কি এমন কাহিনী থাকে যার জন্য আমাদের দেশের চ্যানেল গুলোতে কোথায় হুমায়ন আহম্মেদ আর কোথায় সালাউদ্দিন লাভলু, তার কোন পাত্তাই নেই এই সব দর্শকদের কাছে।
যেমন ধরুন, স্টার জলসার এক নাটক ভালবাসা.কম, এইটার নাম যদি এক স্বমীর তিন বধূ হতো তাহলে নামের স্বার্থকতা আরো বেশী হতো। নায়ক একজন স্ত্রী তিনজন। একজন ভালবেসে বিয়ে করে, দ্বিতীয়জন বন্দুক ধরে আর তৃতীয়জন প্রথম জনের সহযোগীতায় হাসপাতালে অজ্ঞান নায়কের হাত দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দিব্যি ঘরণী হয়ে গেলেন।
তারপর আরেকটি নাকি জনপ্রিয় সিরিয়াল তোমায় ছাড়া ঘুম আসে না মা হৃদয়বিদারক সংগীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া ‘মা’।
এইখানে আরেক উদ্ভট কাহিনী, মা নাকি এখনও নিজের মেয়ে পরীকে চিনতে পারে না....সে যে কতো আধিখ্যাতা।
এখানেও নায়কের বিয়ের জীবনে দুই স্ত্রী ভূমিকা...বিয়ে করে ফুলকি আর বিয়ে না করে ঝিলিক। অর্থাৎ, ইন্ডিয়ান সিরিয়াল গুলোতে স্বামী একজনই কিন্তু স্ত্রী একের অধিক না হলে চলে না। পরকীয়াও কম যায় না।
যেমন, বাহা বলে খ্যাত ইষ্টি কটুম। নাটকের ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন নায়ক অর্চি বাবুর সাথে পরিচালক একই ঘরের দুই মেয়েরে বিয়ে করিয়ে দেন।
ভাবুন কি ধরণের নোংরা মানসিকতার পরিচালক। আবার বিয়ে করা দুই বোনের একই বাবার ও বিয়ের আগে ইটিস পিটিস কাহিনী। দেখলে মনে হয় লাথি মেরে টিভিটাই ভেঙ্গে ফেলি।
আবার পুরোদস্তুর বিয়ে করা বউ স্বামীর সামনে দিয়েই পরপুরুষের সাথে পার্টিতে...আর স্বামী বেচারা স্ত্রীর সম্ভ্রম বাঁচাতে স্ত্রীর পিছু পিছু। এই হলো আরো একটি মা-বোনদের চোখ না ফেলানো সিরিয়াল টাপুর টুপুর।
এতো গেলো বাংলা ।
এক মরাতে বাঁচি না এর সাথে হিন্দি চ্যানেল- স্টার প্লাস। এখানে চলে ফ্যাশন আর কানাই বাবার মতো দেবতাদের অদৃশ্য ক্ষমতা। বিভোর হয়ে দেখতে থাকে গোপীকে। আরে এতো সোনার বউ।
যদি বলে মারি বলে মারেন, যদি বলে খাবো তবে বলে খান। এতো মান্নিগণ্যি ঘরের লক্ষি! আবিার দিব্যি শিক্ষিত মেয়ে হালুয়া অলার ঘরে এসে পুরোদস্তুর বাধ্য বউ।
এইরকম প্রতি আধা ঘন্টার সিরিয়ালে ১৫ মিনিটের বিজ্ঞাপন বাদ দিলে বাকী ১৫ মিনিটের নাটকের জন্য আমাদের দেশের নারীরা খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ভুলে যায়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বাংলা সিরিয়াল গুলোতে যত সব নোংরামী আর উদ্ভট কাহিনীতে ভরা। হিন্দী গুলি অবশ্য এতো অশালীন না হলেও গরীবের ঘরের বউয়েরও মাথা থেকে পা পর্যন্ত গয়না পড়া থাকে।
যেখানে নাটকের প্রতিপাদ্য হলো মানুষ, সমাজ-এর বাস্তব চিত্র, সেখানে ইন্ডিয়ান এই চ্যানেলগুলিতে যত সব গাঁজাখুরি কাহিনী।
আরো লজ্জার বিষয় ইন্ডিয়াতে আমাদের চ্যানেল গুলো সে দেশের ক্যাবল অপারেটর গুলি চালায় না। আর আমরা তাদের চ্যানেল গুলি না দেখলে ত্রাহি অবস্থা।
আজ প্রতিটি ঘরে সন্ধ্যা নামলে রাত ১১টা পর্যন্ত একটানা ইন্ডিয়ান চ্যানেল গুলি নিয়ে ব্যাস্ত থাকে আমাদের শহর-গ্রামের মহিলারা। কিন্তু তাদের যেকোন চ্যানেলের অনুষ্ঠানের চেয়ে আমাদের দেশের চ্যানেলের নাটকগুলো অনেক উন্নত।
এ অবস্থা থেকে আমাদের স্ব উদ্দ্যোগে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চ্যানেল মালিকরা নিজেদের চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে ইন্ডিয়া থেকে চ্যানেলের ডিলার শিপ আনবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।