আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য গডফাদার অব ওয়ার্ল্ড মিউজিক রবি শংকর আর নেই ।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... বিশ্ব সঙ্গীতের গ্লোবাল এ্যাম্বাসিডর রবি শংকর আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার (১১ ডিসেম্বর ২০১২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়াগো শহরের স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে (Scripps Memorial Hospital) চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অকৃত্রিম বন্ধু ও উপমহাদেশের সুরসম্রাট পণ্ডিত রবি শংকর। মৃত্যুকালে রবি শংকরের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। শ্বাসপ্রশ্বাসের জটিলতা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেতার-সুরের এই মহান স্রষ্টা গত এক সপ্তাহ ধরে সেখানে চিকিত্সাধীন ছিলেন।

তাঁর স্ত্রী সুকন্যা এবং মেয়ে আনুস্কা শংকর জানান, গত গত ৬ ডিসেম্বর তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচারও করা হয়। ডাক্তাররা তাঁর প্রতি খুব নজর রেখেছেন। কিন্তু অপারেশানের পর তিনি আর রিকভার করতে পারেন নি। গতকাল তিনি বিকাল সাড়ে চারটায় পরলোক গমন করেন। সে সময় আমরা তাঁর পাশে ছিলাম।

রবি শংকরের মেয়ে আনুস্কা শংকরও একজন সেতার বাদক। রবি শংকরের অপর মেয়ে নোরা জোন্স একজন অস্কার উইনার পপ-গায়িকা। ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতের বারানসিতে জন্মগ্রহণ করেন রবিন্দ্র শংকর চৌধুরী। `পন্ডিৎ রবি শংকর’ নামেই যিনি বিশ্বে সুপরিচিত। তবে তার আদি পৈত্রিক নিবাস নড়াইলের কালিয়ায়।

১৯৯৮ সালে সড়ক ও গ্রোথ সেন্টার উন্নয়ন সংক্রান্ত এক গবেষণার কাজে আমি গোটা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোতে ছয় মাস অবস্থানকালে পন্ডিৎ রবি শংকরের কালিয়ার বাড়িতে তিন রাত অবস্থান করেছিলাম। ওই বাড়িটি এখন থানা ডাক বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শৈশবে ভাই উদয় শংকরের নাচের দলে কাজ করেছেন। ১৯৩৮ সালে নাচ ছেড়ে দিয়ে সংগীতজ্ঞ আলাউদ্দিন খানের কাছে সেতার শেখা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সংগীত পরিচালক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্যজিতৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ (১৯৫৫), ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯) ছবির সংগীত পরিচালনা করে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হন। ১৯৫৬ সাল থেকে বেশ কয়েকটি সফরের মাধ্যমে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত জনপ্রিয় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন গুণী এই শিল্পী। ষাটের দশকে তিনি কয়েকটি দেশে শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এসব কাজ করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন এবং প্রখ্যাত মার্কিন বেহালা বাদক মেনুহিনের।

পরবর্তী সময়ে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই সেতারশিল্পী। বিটলস ব্যান্ডের সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে রবি শংকর আয়োজন করেছিলেন সাড়া জাগানো ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি রবিশঙ্করকে সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্নে’ ভূষিত হন তিনি।

এছাড়া তিনি তিনটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। রবি শংকর ছিলেন সাত ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। বাবা শ্যাম শংকর চৌধুরী ছিলেন ঝালাওয়ারের দেওয়ান এবং মন্দিরের পুরোহিত। পরে তিনি লল্ডনে চলে যান আইনপেশায় কাজ করতে। লন্ডনে যাবার আগে বিয়ে করেন হেমাঙ্গিনী দেবীকে।

হেমাঙ্গিনী দেবী'র কোলে রবি শংকরের জন্ম হবার প্রায় আট বছর পর বাবা শ্যাম শংকর প্রথম রবিন্দ্রকে দেখতে পান। তখন তিনি ছোট ছেলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন রবি শংকর। মাত্র দশ বছর বয়সে রবি শংকর বড় ভাই উদয় শংকরের নাচের দলের সঙ্গে প‌্যারিস ভ্রমণ করেন। তেরো বছর বয়সে তিনি উদয় শংকরের নাচের দলে একজন সদস্য হিসেবে নাম লেখান। গোটা ত্রিশের দশকে উদয় শংকরের নাচের দলের সঙ্গে রবি শংকর ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ করেন।

তখন তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত, নাচ, চলচ্চিত্র বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক, জ্যাজ এবং সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হন। তখন তিনি ওয়েস্টার্ন কসটিউমে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৪ সালে রবি শংকরের সঙ্গে পরিচয় হয় বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সঙ্গে। কলকাতায় একটি মিউজিক কনসার্টে মাইহারের মহারাজ প্রযোজনার সময় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান রবি শংকরকে সঙ্গীত প্রশিক্ষণ দেন। তারপর থেকেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে তিনি সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে রবি শংকর সেতার ও সুরবাহার শেখেন। পরে শেখেন ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের রাঘা পর্বের ধ্রুপদ, ধামার ও খেয়াল। পরবর্তীতে তিনি ইনস্ট্রুমেন্টাল সঙ্গীতে রুদ্রবীণা, রুবাব ও সুরসিংগার শেখেন। তখন তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ছেলে আলী আকবর খান ও মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী'র সঙ্গে একসঙ্গে সঙ্গীতে কাজ করতেন। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রবি শংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান প্রথম পাবলিক কনসার্ট করেন `যুগলবন্দী' নামে।

অনুষ্ঠানে রবি শংকর বাজান সেতার আর আলী আকবর খান বাজান সারোদ। ১৯৪৪ সালে তিনি সঙ্গীত প্রশিক্ষণ শেষ করে মুম্বাই শহরে চলে যান। সেখানে তিনি ভারতীয় পিপলস থিয়েটার এ্যাসোসিয়েশানে যোগ দেন। তখন তিনি কম্পোজ করেন ব্যালেটস। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি কম্পোজ করেন বিখ্যাত গান `সারে জাহান সে আচ্ছা'।

তখন থেকেই তিনি এইচএমভিতে গান রেকর্ড করা শুরু করেন। এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও'র মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই সাত বছর তিনি নয়া দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া রেডিও'র মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। ওই সময় তিনি ভারতের জাতীয় ওরচেষ্ট্রা প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় রবি শংকর সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজি ‘পথের পাঁচালি’ (১৯৫৫), ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)-তে মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮২ সালে তিনি `গান্ধী' ছবির গানের জন্যে এ্যাকাডেমী এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রবি শংকর `কাবুলিওয়ালা' ছবির গানের জন্যে সিলভার পদক লাভ করেন। ১৯৬২ সালে পান সঙ্গীত নাটক একাডেমী পদক। ১৯৬৭ সালে রবি শংকর লাভ করেন ভারতের বেসামরিক পদক `পদ্মভূষণ', ১৯৮১ সালে পান `পদ্মবিভূষণ' পদক। আর ১৯৯৯ সালে অর্জন করেন `ভারত রত্ন' পদক।

১৯৪১ সালে রবি শংকর বিয়ে করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মেয়ে অন্নাপূর্ণা দেবীকে। তাঁদের এক ছেলে শুভেন্দ্র শংকরের জন্ম ১৯৪২ সালে। এরপর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ওই সময় রবি শংকরের সঙ্গে প্রেম ছিল বিখ্যাত ড্যান্সার কমলা শাস্ত্রী'র সঙ্গে। এরপর রবি শংকরের সঙ্গে প্রেম হয় নিউ ইয়র্কের কনসার্ট প্রডিউসার স্যু জোন্সের সঙ্গে।

স্যু জোন্সের সঙ্গে রবি শংকরের আরেক মেয়ে নোরা জোন্সের জন্ম হয় ১৯৭৯ সালে। কমলা শাস্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রবি শংকর ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত স্যু জোন্সের সঙ্গে কাটান। ১৯৭০ সালে রবি শংকরের সঙ্গে পরিচয় হয় সৃকন্যা রাজনের সঙ্গে। ১৯৮১ সালে সুকন্যার রাজনের গর্ভে জন্ম নেয় আনুস্কা শংকর। ১৯৮৯ সালে সুকন্যা রাজনকে রবি শংকর বিয়ে করেন।

রবি শংকর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার এনসিনিটাসে স্ত্রী সুকন্যা রাজন ও মেয়ে আনুস্কা শংকরকে নিয়ে বসবাস করতেন। ২০১৩ সালের গ্রামি এ্যাওয়ার্ডের জন্য রবি শংকর এবং আনুস্কা শংকর আলাদা এ্যালবামে নির্বাচিত হয়েছেন। রবি শংকর ৬ ডিসেম্বর ২০১২ আমেরিকার সানদিয়াগোর লা জোল্লা'র স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে শ্বাস কষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন। ১১ ডিসেম্বর ২০১২ বিকাল সাড়ে চারটায় তিনি সেখানে পরলোক গমন করেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।