বাংলা ভাষায় মজার কিছু শব্দ আছে যাদের স্থান কোনোদিন ব্যাকরন বইতে হয় নাই কিংবা হবার কুনু চান্স নাইক্কা। যেমনঃ এয়া। আমাদের অঞ্চলে ‘এয়া’ শব্দটা খুব প্রচলিত। কথার মাইঝখানে ঢুকে শব্দ অর্থাৎ কথাকে শক্তিশালী-দুর্বল-অবোধ্য করে। শব্দটা আসলে হইলো শুদ্ধভাবে ‘ইয়ে’।
কেউ বলে ‘ইয়ে’ কেউ বলে ‘এয়া’ আবার কেউ বলে ‘গ্যায়া’। ‘গ্যায়া’ হলো চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষেরা ব্যবহার করে। আবার হিন্দিতে ‘গ্যায়া’ হলো মারাত্মক শব্দ। মানে হলো চইলা গেলো। আবার কিছু পাইলেও কয় গ্যায়া! কুই মিল গ্যায়া! আজব শব্দ।
হাফ ইয়ার্লী পরীক্ষা চলতাছে। অংক পরীক্ষা। ক্লাশ সেভেনে পড়ি। দশটায় পরীক্ষা শুরু হইছে। উতপাদক করতাছি ধুমাইয়া।
এমন সময় কিরিং কইরা দুলাল সিনেমা হলের বেল বাইঝা উঠলো। স্যার স্কুলের বারান্দায় পাশের রুমের স্যারের সাথে আলাপে মশগুল। হঠাত মুন্না খাড়াইয়া কইলো-চল সিনেমা দেখতে যাই। সাথে সাথে সবাই ভাঙ্গা জানালা দিয়া লাফ। প্রায় দশ-পনেরো জন নাই।
চইল্লা গেলাম সিনেমা দেখতে। রিয়ার ষ্টলে বইসা দেখালাম-‘দোস্ত-দুশমন’। মোটকা জসীম হা হা করে পর্দা কাঁপাচ্ছে।
-কতোজন ছিলোরে কালিয়া?
-উস্তাদ দুইজন।
-তোরা কয়জন ছিলি?
একটু পরেই শাবানা আর ওয়াশিম গান গাইতাছে।
একটা টাঙ্গা ঘোড়ায় কইরা শাবানা একখান চাবুক উড়াইয়া যাইতাছে আর পিছে পিছে ওয়াশিম-
চুমকি চলেছে একাপথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
হার মেনেছে দিনের আলো
রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো।
পরেরদিন ছিলো খুব সম্ভবতঃ আরেকটা পরীক্ষা। সেদিন গনধোলাই!যাইহোক আমরা সবাই গনুঅনুপস্থিত থেকে মহা সমারোহে দেখেছিলাম সেই বিখ্যাত কুখ্যাত সিনেমা। আর খুরশীদ পিডায় আর জিগায় কই গেছিলি?
সবাই নিরুত্তর! শুধু বুক কামাল কয়ঃ স্যার ‘এয়া’ দেখতে গেছিলাম!
-এয়া কিরে?
-স্যার এয়া হইলো এয়া।
আবার বেতের মাইর আর স্যার কয়ঃ এয়া দেখতে গেছস ভালা কথা এখন ‘এয়া’র মাইর খা।
তবে ভাই যাই কইবেন-তখন ছিলো দিন। সকাল হইলেই মাইক বাইর হইয়া পড়তো আর সুরে সুরে মাইকিং- চলিতেছে ঝুমুর সিনেমা হলে দ্য ব্লাক সামুরাই কিংবা আরেক রিক্সায় কইতাছে-চলিতেছে পলাশ সিনেমা হলে শাবানা-মাহমুদ কলি অভিনীত ‘বাদল’। সে আরেক শিল্প। আমার শৈশবের একজন হিরো তার নাম লিটন। সে মাইকিং করতো সিনেমার-একদিন দেখা লিটন ভাইয়ের সাথে।
আমার খুব শখ ছিলো বড় হয়ে সিনেমা হলের মাইকিং করবো। তখন মনে হয় ক্লাশ সেভেনে পড়ি।
-লিটন ভাই মাইকিং শিখাইবা?
-কি মাইকিং?
-আরে তোমার মতো মাইকিং?
-ধুর এইডা শিখনের কাম হইলো? তোমরা পড়ালেখা কইরা কতো বড় হইবা?
তবুও মন পড়ে থাকতো মাইকিংএর রিক্সার দিকে। শহর ঘুরে ঘুরে লিটন ভাই বলে যাচ্ছে-দ্য লাষ্ট সামুরাই।
আমি অনেক চিন্তায় পইড়া গেলাম-বড়োই তো হইতাছিনা।
যাই হোক গত বছর দুয়েক আগে আমাদের সেই শহরে গেছি। এখন আমাদের সেই ছোট-খাটো শহর আর ছোট কিছু নাই। সব বড়-বড়। শুধু পরিচিত দেখলামঃ জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডার। ঢুকে পড়লাম!সন্ধ্যের মুখে।
কাউকেই চিনিনা। মিষ্টি খেয়ে চা খাওয়ার কোনো মজা নাই। ভাবতেছি হাল্কা চা খেয়ে একটা বিড়ি ধরাই। চা’র অর্ডার দিতে একজন বয় ডাকলামঃ
-ভাই একটা চা দেন-চিনি কম করে দিয়েন।
নিয়ে আসলো গরম গরম মিষ্টি।
ভদ্রলোক এসে বল্লেনঃ শুধু চা খাবেন বিকেল বেলায়? আর আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসলেন।
-আপনি কোথায় থাকেন? আমারে জিজ্ঞেস করলেন।
-জ্বী ঢাকায়। আমি কিছুটা বিরক্ত আজাইরা আলাপে।
-আপনার আব্বা আছেন? দেখিনা অনেকদিন!
-না মারা গেছেন- ছয় বছর হয়ে গেছে।
-হা এর লাইগ্যাই দেখিনা-এখানে এসে বিকেলে চা খেয়ে যেতেন-শহীদ ডাক্তারসহ।
-আপনি আমারে চিনেন?
-হা আপনি বাবু না?
-জ্বী-আপনি?
-আমি লিটন!
আমার মনে পড়ে গেলো। দ্য ব্ল্যাক সামুরাই!লিটন ভাই। প্লাষ্টিকের স্যান্ডেল-ময়লা চাদর-চোখের কোনে ময়লা। হাত পা কাঁপছে! এত তাড়া তাড়ি মানুষ বুড়ো হয়ে যায়!আহা! আমার শৈশবের শহরহিরো লিটন ভাই চা-দোকানের বয়।
শিউরে উঠেছিলাম। আমি তো লিটন ভাইয়ের মতো হতে চেয়েছিলাম! আমাদের শহর বুড়ো হয়ে গেছে? আমাদের দেশ? না সেতো চিরযৌবনা। আমার স্বপ্নের শহর!আমার স্বপ্নের দেশ!
চিটাগাংএ পড়তে গিয়ে প্রথম যে শব্দটা আমার খুব মনে দাগ কেটেছিলো তা হলো ‘গেয়া’। কথার মাঝেখানে বলতো-‘গেয়া’। অর্থাৎ আমাদের সেই ‘এয়া’।
এখানে এসে হয়ে গেলো ‘গেয়া’। আর একটা শব্দ শিখলাম ‘হদ্দে’। মানে হলো ‘বলতেছে’ বা ‘বলতেছি’। চট্টগ্রামে থাকাকালিন রিক্সা দিয়ে ঘুরতে খুব বেশী মজা পেতামনা। পাহাড়ী এলাকা!হয় চড়াই না হয় উতরাই! হয় রিক্সাওয়ালা টেনে টেনে নিচ্ছে না হয় তুফান মেইল।
একদিন আগ্রাবাদ দিয়ে রিক্সায় যাচ্ছি। খুব রশিক রিক্সাওয়ালা গান গাইতেছে-
হদ্দে চুমকি চলেছে হদ্দে একা পথে
হদ্দে সঙ্গী হলে হদ্দে দোষ কি তাতে,
হদ্দে হার মেনেছে হদ্দে দিনের আলো
হদ্দে লাগলে তোমায় লাগে হদ্দে আরো ভালো।
(চট্টগ্রামে র শব্দ খুব কম উচ্চারিত হয়-রেল গাড়ীকে বলা হয়-লেল গাড়ী)
এভাবে আমরা অনেক শব্দকে শুধু শুধু ভালোবেসে ব্যবহার করি। ব্যাকরনবিদ্গন তাদেরকে কোনো পাত্তা দেননা। তাদের কোনো ভদ্র (অর্থাৎ পোষাকী কাজে ব্যবহার নেই)লোকের দরকার নাই।
তবে ভদ্রলোক মনে হয় ‘ইয়ে’টা ব্যবহার করেন। মানে বেশীরভাগ সময় সুশীল মানুষ অপ্রস্তুত হয়ে বলেন-‘ইয়ে আর কি’!
কাওরানবাজারে বাজার করতে গেছি। আন্ডারপাস ক্রস করে আসতেছি। এক মোটকা ভদ্রলোক দিলেন এক থাপ্পড়-একটা ছোটো ছেলেকে। ছেলেটা মিন্তি! মিন্তি হইলো কুলি- যারা বাজার পৌঁছাইয়া দেয় রিক্সা পর্যন্ত! ছেলেটার অপরাধ তার অপুষ্ট শরীর দেড়-দুই মন ওজনের বাজার সদাই মাথায় করে আনতে পারে নাই।
পারার কথাও না।
মোটকারে কইলামঃ আপনি কিছু আইটেম হাতে নিলে কি হইতো?
-হেরে টেকা দিমু কেন তাইলে?
-তা ঠিক কিন্তু আট-দশ বছরের ছেলে এতো ওজন সইতে পারে!
-ইয়ে মানে………………………!!
এই হলো ইয়ে……মাঝে মাঝে মনে হয়-এই সমাজের মুখে ‘ইয়ে’ করে দেই।
শালার সব ইয়ে। লেখার কোনো অর্থ নেই-পুরাটাই ‘ইয়ে’। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।