বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... খান সারওয়ার মুরশিদের জীবনাবসান:
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ। শনিবার বিকালে (৮ ডিসেম্বর ২০১২) রাজধানীর অ্যাপোলে হাসপাতালে কোমায় থাকা অবস্থায় বিকাল ৫টার দিকে আরেকবার স্ট্রোক হয়। এরপরই চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে খান সারওয়ার মুরশিদের বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
একজন বর্ণাঢ্য শিক্ষাবিদ:
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক পাস করেন।
পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে নিজের সম্পাদনায় শুরু করেন `নিউ ভ্যালুজ' নামে একটি ইংরেজি ত্রৈমাসিক প্রকাশ করার কাজ। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ‘সংস্কৃতি সংসদ’প্রতিষ্ঠায় তিনি নের্তৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান লেখকসংঘের পূর্বাঞ্চলীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে খান সারওয়ার মুরর্শিদ ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ।
‘দ্য ইনফ্লুয়েন্স অফ টেগোর অন দ্য ওয়ার্কস অফ ডব্লিউ বি ইয়েটস, আলদোস হাক্সলি অ্যান্ড টিএস এলিয়ট’ বিষয়ে তিনি ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। দেশে ফিরে আবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রবল বাধার মুখে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনে খান সারওয়ার মুরর্শিদ নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
১৯৬৫ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত এই শিক্ষাবিদ পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব।
ওই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের জন্য প্রস্তাবনা ও অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন। খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন শেখ মুজিবের ছয় দফা' নীতিমালার অন্যতম নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাকারীদের একজন। উনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমেদের তিনি ছিলেন একজন অন্যতম সহযোগী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হওয়ার পর তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে তিনিও যোগ ছিয়েছিলেন। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন অন্যতম পরামর্শক।
স্বাধীনতার পর খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ‘ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ গঠন করে বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও গবেষককে তিনি বাংলাদেশে আনেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ফরাসি বুদ্ধিজীবী অঁদ্রে মালরোকে আমন্ত্রণ করে তাঁকে সম্মানজনক `ডি লিট' প্রদানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন খান সারওয়ার মুরশিদ।
একজন সফল কূটনৈতিক:
১৯৭৫ সালে শুরু হয় খান সারওয়ার মুরশিদের কূটনৈতিক জীবন।
বাংলাদেশ সরকারের একজন হাই-কমিশনার হিসেবে তিনি পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেকোশ্লোভাকিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৭৭ সালে কমনওয়েলথের সহকারী মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৮৩ সালে আবার তিনি দেশে ফেরেন। এবারও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে অবসর নিলেও সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন।
খান সারওয়ার মুরশিদের সরাসরি ছাত্র ছিলেন শামসুর রাহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। নাগরিক সমাজের পক্ষে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন, তিনি ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তিগত জীবন:
১৯২৪ সালের ১ জুলাই কুমিল্লা শহরে নানাবাড়িতে জন্ম হয় খান সারওয়ার মুরশিদের।
বাবা আলী আহমদ খান ছিলেন প্রথমে অবিভক্ত বাংলার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য। মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। তার সম্পাদনায় `পূর্ব বাংলা' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো।
বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রবেশিকা পাশ করার পর খান সারওয়ার মুরশিদ প্রথমে ফেনী সরকারী কলেজে ভর্তি হন এবং পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
১৯৪৮ সালের ১৪ অগাস্ট নূরজাহান বেগমের সঙ্গে খান সারওয়ার মুরশিদের বিয়ে হয়।
নূরজাহান মুরশিদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি শিক্ষকতা, সাহিত্যচর্চা ও নারী অধিকার আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। নূরজাহান মুরশিদ যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ থেকে দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন নূরজাহান মুরশিদ।
খান সারওয়ার মুরশিদের বড় ছেলে খান আহমেদ সাঈদ মুরশিদ বর্তমানে গবেষক হিসেবে উন্নয়ন গবেষণা একাডেমিতে কর্মরত। বড় মেয়ে তাজীন মুরশিদ বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।
ছোটো মেয়ে শারমীন মুরশিদ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ব্রতী’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ছোট ছেলে খান আহমেদ নূওয়ায়ীদ মুরশিদ হংল্যান্ডপ্রবাসী। তিনি পেশায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষক।
একাত্তরে সংগ্রামের দিনগুলোতে খান সারওয়ার মুরশিদের পুরো পরিবারই কোনো না কোনোভাবে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিল। বড় ছেলে সাঈদ মুরশিদ মুক্তিযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্রতে সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও সংবাদ-পাঠিকা ছিলেন বড় মেয়ে তাজীন মুরশিদ। আর সহশিল্পীদের সঙ্গে ‘মুক্তির গান’ গেয়ে যুদ্ধ ও ত্রাণ শিবিরগুলিতে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের উজ্জীবিত করতেন ছোট মেয়ে শারমীন মুরশিদ। আর ৯ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার মেজর জলিলের বাহিনীতে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন তার ছোটো ছেলে খান আহমেদ নূওয়ায়ীদ মুরশিদ।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশন খান সারওয়ার মুরশিদকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির একজন অন্যতম ফেলো।
প্রবন্ধ ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১১ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক (২০০৬) ও কণ্ঠশীলন পুরস্কার (২০০৮) পেয়েছেন।
প্রকাশিত বই:
কালের কথা (২০০১), Literature in Bangladesh: Contemporary Bengali Writing (Bangladesh Period, ১৯৯৬), Literature in Bangladesh: Contemporary Bengali Writing (Pre-Bangladesh Period, ১৯৯৬)। এছাড়া `নিউ ভ্যাল্যুজ' সম্পাদনার ১৭ বছরে সাহিত্য-সংস্কৃতি ছাড়াও সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি অনেক ইংরেজি প্রবন্ধ লিখেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।