চোখ মেলে দেখতে চাই কক্সবাজারে গিয়েছি অনেকবার। সাত থেকে আটবার। তবে কখোনো সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়া হয়নি। বেশিরভাগ সময় গিয়েছি শ্রমিক হিসেবে। তাই কাজ শেষে কক্সবাজার থেকে ফিরে আসতে হয়েছে।
তবে মাঝে মাঝে যে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার বাসনা করিনি তা নয়। তবে নানা কারণে যাওয়ার সামর্থ হয়নি। এই হয়তো বর্ষাকাল বা সেই হয়তো পকেট গড়ের মাঠ। শুনে এসেছি দারুচিনি দ্বীপ খ্যাত দেশের সবচেয়ে দক্ষিণের দ্বীপটি সৌন্দর্যের মহাপূর্ণিমাদর্শনাধার। কেবল দেশি টিভি চ্যানেলে ট্রাভেল শো'র কাট-আনকাট ট্রেইলার দেখে মন ভরেছি।
আমার রূমেমেট অনেক দিন ধরেই সেন্ট মার্টিন যাবার বায়না করে আসছিলেন। গত মার্চে একবার পরিকল্পনা করে পিছিয়ে যায় আমাদের সন্তানের জন্মদিন আয়োজনের কারণে। এরপর আর হয়নি। নভেম্বর মাস আসতেই। আবারো চাপ আসে।
সেন্ট মার্টিনের যাবার কথা শুনে অনেকেই যাত্রা সঙ্গী হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এবং বরাবরের মতোই এক এক জন করে পিছিয়ে যায়। এবার আমরা লক্ষ্যে স্থির থাকি। যাব তো যাবই। ইনশাআল্লাহ।
পকেট খসে যায় এমন যে কোন আয়োজনে বন্ধুবর মুহিব আহমেদ চরম উত্তেজনাময় উৎসাহ দেন। এবারো তা দিলেন। তিনি নিজে অনেকবার সেন্ট মার্টিন গিয়েছেন তাই আমাদের সাথে যেতে না চাইলেও ট্যুর অপরারেটরের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের আসন ও দ্বীপের হোটেল কক্ষ সংরক্ষণসহ যাবতীয় কাজ তিনি সমাধা করে দিলেন। আমরা কেবল উঠিতোবসিতোঘুরিতোউপভোগোফিরতং বেশে যাত্রা শুরু করিলেই পারি।
২৪ নভেম্বর রাতে যাত্রা শুরু হলো। ফকিরাপুল থেকে বাসে উঠতে হবে। আমাদের যাবার কথা ছিল মুহিব সাহেবের ভগ্নিপতি ফারুক ভাইয়ের মালিকানাধীন সিলভার লাইনে। ভাগ্যদোষ হওয়ায় ফারুক সাহেব নিজ উদ্যোগে সেন্টমার্টিন সার্ভিসে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। ২৫ নভেম্বর সকাল সাতটার দিকে আমরা টেকনাফ থেকে সাত কিলোমিটার আগে জালিয়াদ্বীপ ঘাটে পৌছালাম।
সেখান থেকেই জাহাজ ছাড়বে। আগেই আমাদের টিকিট করা ছিল। সকাল সাড়ে নটায় জাহাজ ছাড়ে। বাকী সময়টা নাস্তা করে সমুদ্রযাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
গেট খুলে দিতেই জাহাজের দিকে রওনা হলাম।
আমাদের জাহাজের নাম ছিল কুতুবদিয়া। জানিয়ে রাখি জাহাজে উঠতে রাস্তা আর জেটি মিলিয়ে প্রায় দেড়শ মিটার হাঁটতে হয়। ঠিক সময়ে জাহাজ ছাড়লো। আমরা নাফ নদী দিয়ে যাচ্ছি। এই নদীর একতীরে বাংলাদেশের টেকনাফ আরেক তীরে মায়ানমারের আকিয়াব উপকুল।
পূর্ব দিকে মায়ানমারের নাসাকা বাহিনীর পর্যবেক্ষন টাওয়ার ও কিছু প্যাগোডা (বৌদ্ধ মন্দির) দেখা গেল। পশ্চিম দিকে পাহাড়ের কোল ঘেষে টেকনাফ মহাসড়ক। চারিদিকে যেন পরম মমতায় অপূর্ব নৈসর্গিক উপহার ছড়ানো।
মূল টেকনাফ ঘাট থেকে সেন্ট মার্টিনের দূরত্ব ৯ নটিক্যাল মাইল। আমারা যেহেতু জালিয়াদ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করেছি, আমাদের পাড়ি দিতে হলো প্রায় ১৮ নটিক্যাল মাইল।
এতে দুই ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগলো। নাফ নদী পার হলে সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ যেতেই শুরু হলো টেউয়ের ঝাকুনি। পৌনে দুই ঘন্টার মাথায় আমরা জাহাজ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখতে পেলাম। একটু করে দ্বীপটি কাছে আসতে লাগলো। যখন দৃষ্টি সীমায় পরিস্কার দেখা গেল আমরা অভিভূত।
সবুজে ঢাকা নারিকেল বনের গ্রামের পাড়ে স্বর্নালী সৈকত, আকাশের সাদা মেঘ যেখনে মিলেছে সেখানে গাঢ় নীল জলরাশির মনজয়ীকামনানিপাস্য উত্তাল টেউ আমি এ জীবনে দেখিনি।
জেটি পেরিয়ে দ্বীপে পা রাখলাম। আমাদের জন্য মুহিব ভাই হোটেল অবকাশের একটি কক্ষ সংরক্ষণ করেছিলেন। গদিওলা ভ্যানে চড়ে ঘাট থেকে দ্বীপের অপর পাড়ে রওনা হলাম। যদিও হোটেলটি ভালো না লাগায় আমরা পার্শবর্তী লাবিবা বিলাসে গিয়ে উঠলাম।
পশ্চিম পাড়ের এই হোটেলগুলিও পশ্চিম দিকের সৈকত লাগোয়া। এই পাড়ে দ্বীপের দেখলাম তীর তৈরি করেছে প্রবালেরা পা ফেলে ফেলে। বিকেলে সেখানে সুর্যাস্ত দেখলাম।
রাতে খাবার জন্য ঘাটের কাছে বাজারে গেলাম। হোটেলের সামনের টেবিলে থরে থরে সামুদ্রিক মাছ সাজানো।
রূপচাঁদা, টেকচাঁদা, সুরমা, টোনা, সুন্দরী, কোরাল, লবস্টার, ছুরি নানা নামের মাছ। আমরা রূপচাঁদা ভাজা আর একটা কেজি সাইজের কোরাল বার-বি-কিউ করে দিতে বললাম। বলে রাখি, তিনদিনের সেন্টমার্টিন সফরে আমরা ভাতের সাথে বেশুমার মাছ খেয়েছি। মাংস ছুয়ে দেখিনি। প্রশ্নই ওঠেনা।
পরদিন দ্বীপের উত্তর অংশ হেটে ঘুরে ছবি তুলেছি। শত চেষ্টাতেও আমাদের দেড় বছরের মেয়েকে পানিতে নামাতে পারিনি। যত ঘুরেছি, দ্বীপের সৌন্দর্যে তত বেশি মুগ্ধ হয়েছি। আমার রূমমেটের আগ্রহে এদিন আবারো হোটেল পরিবর্তন করে দ্বীপের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল ব্লু মেরিনে গিয়ে উঠলাম। আর সারাদিন কক্ষ থেকেই সমুদ্রের গর্জন শুনতে থাকলাম।
আর এভাবেই দ্বীপটির প্রেমে পড়ে গেলাম।
২৭ নভেম্বর আমাদের ফেরার দিন। কিন্তু ছেড়াদ্বীপ না গেলে কি হয়। দক্ষিণে বাংলাদেশের সবচেয়ে শেষ সীমা ছেড়া দ্বীপ। ভাটায় দ্বীপটি সেন্ট মাটির্নের অংশ।
জোয়ারে আলাদা। জোয়ারে দ্বীপটির ৫০ শতাংশ ডুবে যায়। সেন্ট মার্টিন ঘাট থেকে সকাল আটটায় ট্রলার ছেড়াদ্বীপের ট্রলার ছাড়া শুরু হয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে। জনপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা ভাড়া নেয়।
বিকেল আড়াইটার জাহাজে আমাদের ফিরে যেতে হবে। হোটেল ছাড়তে হবে ১২টায়। তাই সকাল সকাল রওনা হলাম। ৪০ মিনিট মতো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌছালাম ছেড়া দ্বীপের কাছে। ছেড়া দ্বীপ প্রবাল সর্বস্ব।
কিছু দূরে ট্রলার রেখে ১০০ মিটারের মতো পথ নৌকায় পাড়ি দিতে হয়। সমুদ্রে নৌকা পাড়ি দেয়া যে কত ভয়ঙ্কর, তা হাতে নাতে টের পেলাম। অবশ্য ভাটার সময় হেটে ছেড়া দ্বীপে যাওয়া যায়। সেন্টমার্টিন ঘাট থেকে সৈকত ধরে হেঁটে যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘণ্টা।
ছেড়া দ্বীপে গিয়েও ভালো লাগলো।
আমরা ঘুরে ফিরে দেখলাম। দ্বীপটি সরু হওয়ায় এক জায়গা থেকেই সুর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দ্বীপটি দেখা হলো। তারপর ফিরে এলাম সেন্টমার্টিনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেকনাফ থেকে আসা জাহাজ ঘাটে ভিড়ল।
জাহাজগুলো সাড়ে এগারোটার দিকে সেন্টমার্টিন আসে। আবার আড়াইটার দিকে টেকনাফে ফিরে যায়। আমরা আবারো একই পথে প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে টেকনাফের জালিয়াদ্বীপের ঘাটে যখন পৌছালাম তখন শীতের সন্ধ্যা নেমেছে।
কিছু টিপস
১. সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকেই, কেয়ারীসহ বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে যেতে পারেন।
২. নভেম্বর থেকে মার্চ পযন্ত মাত্র ৪ মাস জাহাজ চলে।
অন্য সময় যেতে হলে ট্রলারে করে যেতে হবে।
৩. সেন্টমার্টিনে এখন অনেক হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ আছে তাই থাকার জায়গার অভাব হয় না।
৪. সাশ্রয়ী দামে থাকতে শুক্রবার-শনিবার দ্বীপে না যাওয়াই ভালো।
৫. দ্বীপে সবকিছু বাইরে থেকে যায়, তাই খাবার খরচ তুলনামূলক বেশি।
৬. তিনদিনে জনপ্রতি খরচ হবে ৫-৬ হাজার টাকা।
দলবল করে করে আরো কমে ৩-সাড়ে ৩ হাজার টাকায় ঘুরে আসা যায়।
সেন্টমার্টিনের কিছু হোটেল ও রিসোর্টের নাম ও টেলিফোন নম্বর
১. ব্লু মেরিন: ০১৮১৯০৬৩৪১৮, ০১৭২২৪৭৩৬১৩, ০১৮১৯০৬৩৪২৫, ০২৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১,৯৩৫৯২৩০ (ঢাকা থেকে বুকিং দিতে হবে)
২. প্যাসিফিক রিসর্ট: ০১৭৩২৪৩৪২৬৪ (সেন্টমার্টিন), ০১৭১২৬৪৩৬৯৪, ০১৭২০৯৩৯০৯০ (ঢাকা)
৩. হোটেল স্বপ্ন প্রবাল : ০১৮১৪২৭৪৪০৯, ০১৭২২৫৪৫৮৭২ (সেন্টমার্টিন) ০২৮৬১১৪২৮, ০১৭১১-১১০৯১৯ (ঢাকা)
৪. সমুদ্র বিলাস (হুমায়ুন আহমেদের): ০১৮১৩০১৯৮৩৯
৫. সীমানা পেরিয়ে : ০১৮১৯০১৮০২৭, ০১৮১৭০৪২০২০ (সেন্টমার্টিন ), ০১৮১৯৪৬৬০৫৯, ০১৮১৯৪৭৮৪৩৪, ০১৯১১১২১২৯২, ০১৭১১৩৪৪৪৫১ ( ঢাকা)
৬. নীল দিগন্তে রিসর্ট: ০১৭৩০০৫১০০৪ (সেন্টমার্টিন), ৮৬৫২৩৭৪, ০১৭৩০০৫১০০৫ (ঢাকা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।