বারান্দায় টবের ছোট্ট গাছটিতে টুনটুনির বাসাটা এখন ফাঁকা। নেই কোন কিচির-মিচির টুনটুন শব্দ। নিথর ঘরটা দেখলে ভিতরটায় কেমন যেন খাঁ খাঁ করে। কয়েক মাস আগের কথা। সকালটা ছিল অন্যান্য দিনের মতই।
নিশাচর প্রাণীর মত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। তবে অন্যান্য দিনের মত ততটা দেরিও করি নি। কারণ, একই দিনে কিছু কাজ পরে গেছে একসাথে। সেগুলো শেষ করতেই হবে। আর কোন উপায় ছিল না।
তাই সেদিন বনানী গিয়েছিলাম ছোট খালার বাড়িতে। কাজ বলতে- কাজের কাজ, কাজ খোঁজার কাজ। কোন আজাইরা কাজ না। গ্রাজুয়েশন শেষ। এবার একটু কাজের ধান্দা না করলে কি চলে? না হলে এই বেকার ছেলেকে মেয়ে দিবে কে? আসছে নতুন বছরের প্রথম প্রহরটা আর একা পালনের কোন শখ নেই।
তাই যত তাড়াহুড়ো।
তা যাই হোক, দুপুরের বেশ আগেই খেয়ে-দেয়েই বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। প্রথমেই যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, কনভোকেশন গাউন সংগ্রহ করতে। আজ যাই, কাল যাই করে আলসেমিতে আর যাওয়া হয় নি। কিন্তু আজ আর না গেলেই নয়।
কারণ, আজই শেষ দিন। আজ সংগ্রহ না করলে এবার আর কনভোকেশন নেয়া হবে না আমার। এদিকে ছোট খালু গত রাতেই ডেকে বসলেন যে আজ তার বাসায় যেতেই হবে আর তা ওয়ার্কিং আওয়ারের মধ্যেই। কারণ, খালু একটা প্রাইভেট ব্যাংকে শিফট করতে চাচ্ছেন। আর এক্ষেত্রে পুরোনো মান্ধাত্বা আমলের মত হাতে করে সিভি জমা দিলে হবে না।
তাদের কাছে আবেদন পৌছুতে হবে অনলাইনের মাধ্যমে। কিন্তু ছোট খালু বুড়ো মানুষ (অত বেশি না ) উনি তো আর অনলাইন-অফলাইন বিষয়গুলো বুঝেন না। তাই দেশে থাকা তার এই একমাত্র ওরাকল ১০জি এক্সপার্ট (তাদের ভাষায় ) ভাগ্নেকে জরুরী ভিত্তিতে ডেকে পাঠানো। কি আর করা!!! আজ যেমন আমার কনভোকেশন গাউন সংগ্রহের শেষ দিন, তেমনি খালুর অ্যাপ্লাই করারও শেষ দিন।
এদিকে আবার পুরো সিভি টাইপ করে ফিল-আপ করতে হবে অনলাইনে।
সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই দুপুরের দিকেই ভার্সিটির কাজটা শেষ করে চলে গেলাম খালার বাসায়। বিকেল চারটার আগেই কাজ শেষ। এরপর সিভি সাবমিট করতে আর তেমন একটা সময়ও নিল না অনলাইনে। এদিকে খালুর সাথে কম্পিটিশন দিয়ে আমিও আমার লগিন থেকে সাবমিট বাটনে একটা ক্লিক দিয়ে এসেছি।
এখন দেখা যাক, কে কার বস হয়!
কাজ সময় মত শেষ হলেও খালু আর আসতে দিলেন না। আমাকে নাকি খালা-খালু অনেকদিন দেখেন না। না দেখে চেহারাই ভুলে গেছেন। তাই খালু মাকে ফোন দিয়ে বললেন, "আপা, ওকে রাতে না খাইয়ে ছাড়ছি না। একটু রাত হলে টেনশন করবেন না।
" এখন আর আমাকে পায় কে? বাসায় গেলে তো আর এখন জী-বাংলার যন্ত্রণায় রিমোট ধরা যাবে না। আর অন্যদিকে মোবাইলে টাকা রিচার্জের নামে কতবার সিগারেট ধরাতে বের হওয়া যায় বাসা থেকে? এদিকে খালার বাসায় পুরো ছাদ খালি। পড়ন্ত রোদ, সাথে পারমানেন্ট গার্লফ্রেন্ড, ছাদ আমার, আকাশ আমার। আজ সারা বিকেল আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।
সারা বিকাল আনন্দে কাটিয়ে সন্ধ্যায় নেমে এলাম ছাদ থেকে।
এরপর খালুকে আরেকবার দেখিয়ে দিলাম যে কিভাবে উনি তার আপডেট দেখতে পারেন। কিন্তু খালুর মায়াভরা মুখটা দেখে বুঝতে একদমই বাকি ছিল না যে এই কাজটার জন্যও আমাকে আবারও আসতে হবে। তবুও কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করলাম। তারপর ছোট্ট খালাতো বোনটার সাথে কিছুক্ষণ খেলে রাতে খেয়েই বের হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা।
কিছুদূর আসতেই বনানী ১১ নং সড়কে পেছন থেকে একজন কর্তব্যরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান সদস্য ডেকে বসলেন। প্রথমে খেয়াল করিনি। কয়েকবার ডাকার পর খেয়াল করলাম। ফিরে দেখি কর্তার রুক্ষমূর্তি।
> "হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাকেই ডাকছি।
"
> "জ্বী, বলেন। " (কাছে গিয়ে)
> "ব্যাগে কি? দেখি। "
> "ভার্সিটির কনভোকেশন গাউন। "
(কনভোকেশন গাউন কালো কাপড়ের হওয়াতে মনে হয় সন্দেহ খানিকটা বেড়ে গেল। )
> "কি করেন?"
> "জ্বী, আমি স্টুডেন্ট।
আইসিএমএবি-এর স্টুডেন্ট। " (ইচ্ছা করেই প্রথমে এটা বললাম)
> "এইটা কি? কোথায়?"
> "ইন্সস্টিটিউশন অব কস্ট & ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস। এটা নীলক্ষেতে। "
> "কি করে এইখানে? মানে কি শিখায়?"
> "এটা একটা প্রোফেশনাল ডিগ্রি। গ্রাজুয়েশনের পর এখানে ভর্তি হলাম উচ্চতর শিক্ষার জন্য।
"
মনে মনে বলছি, ব্যাগে কনভোকেশন গাউনের কালো কাপড় দেখাতেই যত জ্বালা। এখন তাকে কি দিয়ে বুঝাই যে আইসিএমএবি কি জিনিস আর এখানে কি করে। কিন্তু একটু পরেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্যাগ চেক করতে করতে হঠাৎ আমার ভার্সিটির আইডি তার নজরে আসে। এরপর কয়েকবার ঢোক গিলতে গিলতে বলেন,
> "আপনি নর্থ-সাউথে পড়েন?"
> "জ্বী, আমি নর্থ-সাউথে মাস্টার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
"
> "তাহলে যে কোথায় জানি পড়েন বললেন?"
> "জ্বী, সেটা আমার প্রোফেশনাল ডিগ্রি। আর মাস্টার্স করছি নর্থ-সাউথ থেকে। "
আর কিছু বলতে হল না। বেচারা আমার ব্যাগ ঘোচাতে শুরু করলেন। আমি উল্টো যতই আমি ব্যাগের আরও কয়েকটা পকেট আর চেইন দেখিয়ে দিতে চাইছি, উনি ব্যাগের সেই চেইন কিছুতেই খুলতে দিবেন না।
অতিসত্তর উনি আমাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। তার গলা শুকিয়ে যাওয়া হাঁপানো কন্ঠস্বর আর কপালে ঘাম ঝরানো দৃশ্যটা দেখবার মত ছিল। নির্জন জায়গা, আশে-পাশে কেউ নেই, একা একটা বেচারা পুলিশ এক নর্থ-সাউথের ছাত্রের সামনে পরে জান বাঁচাতে ব্যস্ত। এখন কি হবে?
শুনেছি সাম্প্রতিক একটা হত্যাকান্ডে নর্থ-সাউথের ছাত্রদের সম্পৃক্ততা থাকাতে পুলিশও নাকি এখন নর্থ-সাউথের ছাত্রদের ভয় পায়। বিশ্বাস করি নি।
কিন্তু এবার নিজেই প্রমাণ পেলাম। অবাক হই যে, এই একটা ঘটনা একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করে দিল সবার কাছে। অথচ রাস্তায় এক নিরোপরাধ বিশ্বজিত-কে এভাবে মেরে ফেলার পরও শুধুমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে তাদের নিয়ে কেউ কিছু বলে না। ভাল-খারাপ সব জায়গাতেই আছে। এখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ জানেন না, তারিক মাসুদ কে? আর যারা জানেন, তারা এটা জানেন না যে তারিক মাসুদ একজন মাদ্রাসা ছাত্র।
অথচ উনি কিন্তু সন্ত্রাসী ছিলেন না। তেমনি নর্থ-সাউথের সব ছাত্রই হিজবুল তাহরীর না। কিন্তু কে বুঝবে আর কবে বুঝবে? তারপরও বেশ মজা পেয়েছি ঘটনাটিতে। আমাকেও কেউ তাহলে সমীহ করে, সেটা ভাবতেই ভাল লাগছিল।
ভাবতে ভাবতেই একটা সিএনজি করে বাসায় চলে এলাম।
বাসায় ফিরতেই ঠোঁটের কোণায় এক ঝলক বিজয়ের হাসি দেখে মা জিজ্ঞাসা করলেন, "কি বাবা? এত খুশি কেন? খালুর বাসায় গেলি, তাতেই চাকরি হয়ে গেছে?"
> "পুলিশ ধরছিল। কইছি নর্থ-সাউথে পড়ি। " ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।