বাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে নতুন ফসলকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের সূচনা, কালক্রমে সেটাই পরিণত হয়েছে নববর্ষ বরণ উৎসবে।
আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব কালক্রমে নতুন মাত্রা পেয়েছে। গ্রামীণ বা লোকজ সংস্কৃতি এখন নাগরিক সংস্কৃতি তথা সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসবের রূপ নিয়েছে। ফলে আদি উৎসবের নান্দনিকতা কিছুটা ক্ষুন্ন হলেও,কিছুটা নতুন নান্দনিকতাও যোগ করেছে। নগর জীবনে বৈশাখ যে ব্যাপক উৎসবের উপলক্ষ নিয়ে আসে গ্রামীণ জীবনে তার আমেজ ভিন্ন।
তবুও পহেলা বৈশাখীই আমাদের গ্রাম-শহরকে একসূত্রে বাঁধার কাজটা করেছে। পহেলা বৈশাখ যেন নৌকা থেকে গরুর গাড়ি চড়ে শহরে এসেছে, শহর থেকে ট্রেনে চড়ে রাজধানীতে এসেছে। আর রাজধানী থেকে উড়োজাহাজে চেপে নানা দূর দেশে-দেশে-প্রবাসে ছড়িয়ে পড়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার হোয়ারাং ন্যাশনাল পার্কও মুখরিত হয়ে উঠলো বাঙালিদের বৈশাখী উৎসবে।
কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের মিলনমেলায় পরিণত হলো হোয়ারাং ন্যাশনাল পার্ক।
গতকাল রবিবার, ঐতিহ্যবাহী 'বৈশাখী মেলা-১৪২০' অনুষ্ঠিত হলো দক্ষিণ কোরিয়ার আনসানে । কোরিয়াতে সরকারী ছুটির দিন থাকায় এইদিন সকাল থেকেই বাড়তে থাকে প্রবাসীদের স্বপরিবারে আগমন। বৈশাখী সাঁজে সেঁজে নারী-পুরুষ ও শিশুরা মেলায় অংশ নেয়। এই মেলা অন্যান্য ফেস্টিভ্যালের মত কোন অনুষ্ঠান শুধু নয়, কোরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা প্রবাসীদের উপচে পরা ভিড়ে পরিনত হয়েছিল মহোৎসবে। কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রানের মিলন মেলাখ্যাত এই ফেস্টিভ্যাল কে ঘিরে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে অন্য রকম বর্ষবরণ উৎসবের আমেজ ছিল।
আনসান বাংলাদেশ কমিউনিটির আয়োজনে এ মেলার অডিয়েন্স মাতিয়েছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যান্ড এলআরবি। বাংলাদেশ থেকে আগত শিল্পীদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় কোরিয়া প্রবাসীরাও। প্রবাসীদের উদ্দীপনা দেখে এলআরবির প্রধান আইয়ুব বাচ্চু বলেন, এটাই আমার প্রথম কোরিয়াতে আসা, আমার ধারনা ছিলনা যে এতো সংখ্যাক বাঙ্গালী আছে। আমার খুবই ভালো লাগলো, আমাকে যখনই ডাকবেন তখনই আসবো।
প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখ আমাদের মন প্রান বাঙালীত্বের আমেজে ভরে দেয়।
উপভোগ করি সবাই। সবারই ভাল লাগার অনুভূতি এনে দেয় এই বৈশাখী আবাহন। আর হাতছানি দেয় ফেলে আশা স্বদেশের পানে ছুটে যাওয়ার জন্য। এবারের বৈশাখী মেলায় বিভিন্ন স্টলের পাশাপাশি ছিল ফ্রি চিকিৎসা এবং ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা। মুড়ি, মুরকি, ছানা, সন্দেশ, দই, মিস্টিসহ নানান ধরনের মুখরোচক খাবারের গন্ধে অন্য রকমের আনন্দ অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল সকলের মধ্যে।
প্রবাসেও সেই অনুভূতির রোমন্থনে আমাদের রক্ত প্রবাহে জেগে ওঠে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির ধারক বাঙালীত্ব। যা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের স্মারক এবং শ্বাশত ও চিরন্তন গর্ব-অলংকারের আরেক রূপ। যেখানে যুক্তির শক্তি মুক্তির মন্ত্র। ধর্মান্ধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মুক্তমনা মানুষের মেলবন্ধন রচনার দিক দর্শনও এই বাঙালীত্ব। আর পহেলা বৈশাখ বাঙালী সংস্কৃতির প্রাণ প্রবাহে প্রতিবছরই সঞ্চারণ ঘটায় নতুন প্রাণ স্পন্দনের।
এই প্রাণ বাণই সকল অন্ধকার-কূপ মন্ডকতার বিরুদ্ধে সভ্যতার শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
প্রবাসে কর্মব্যস্ততা এবং জীবন সংগ্রামে সবাই হাঁপিয়ে ওঠেন। বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালি যখন হাবুডুবু খায় তখন নিজস্ব শেকড় সন্ধানের মধ্যে কিছুটা আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফেরে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য বড় মাধ্যম এই পহেলা বৈশাখ। ছেলে-মেয়েকে বলা হয়, এটা তোমার পিতৃপুরুষের আদি উৎসব।
এই তোমার আত্মপরিচয়। বিদেশে মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির প্রকাশও এক ধরণের অহংকার, গৌরব। কারণ, বিভূঁইয়ে তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম প্রজন্ম পর্যায়ক্রমে মিশ্র-সাংস্কৃতিক স্রোতে হারিয়ে ফেলে নিজ সংস্কৃতির অস্তিত্ব। সেজন্য শুধু স্বদেশ বা মাতৃভূমির স্বার্থেই নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির স্বার্থেই প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সংস্কৃতিকে চর্চার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত আবশ্যক।
লেখাটি গ্রামের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।