পূর্ণ হতে চাইনি তাই পূর্ণতার খোঁজ করি, অপূর্ণতাই থেকেছে পাশে তাই অপূর্ণতার কাছে ঋণী পূর্বকথাঃ স্বল্প পরিসরের এই গল্পটি আমি নাটিকা আকারে প্রকাশ করছি যার মূল বিষয়ের আলোকপাত করতে গিয়ে আমি সহায়তা নিয়েছি কিছু শিল্প-সাহিত্যকর্মের। এগুলো হলো- লোক নাট্যদলের মঞ্চায়িত নাটক 'শিল্পী', Paulo Coelho এর 'The Alchemist' এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর 'মনের মানুষ' অবলম্বনে নির্মিত ছবি 'মনের মানুষ'।
কিছু নিতে গিয়ে আমি হুবহু এগুলোর অনুকরণ না করে খেয়াল রেখেছি নিজের সৃষ্টিশীলতায়। কয়েকটি সংলাপ হুবহু অনুসৃত। এর শুরু, ক্রমধারা এবং সমাপ্তি- সবই সংলাপের মাধ্যমে।
এই গল্পের মূল চাওয়াটিকে ফুটিয়ে তুলতে অনেক উপমার আস্রয় নিতে হয়েছে। আশা করি সেগুলোকে শাব্দিক অর্থে না নিয়ে পাঠকগণ এর ভাবার্থ বুঝতে চেষ্টা করবেন। ধন্যবাদ।
(সুন্দরের গ্রাস)
(সবাই সাধারণ। সৃষ্টির আদিম থেকে শেষ যুগ পর্যন্ত যে চাওয়া, যে প্রয়োজন মানুষের ছিল-আছে, তা-ই থাকবে।
মানুষের পথ না হয় ভিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু মূল গন্তব্যকে আর কীভাবে ভিন্ন করা যায়? সংস্কার বা সংস্করণ, সেটা তো কেবল পথেরই হয়। গন্তব্য যে হাজার কোটি দিনের পুরনো! কিছু মানুষ থাকতে হয় এই সাধারণের মাঝে, যারা সাধারণের গল্পকে গতানুগতিক ধারার একটু বাইরে নিয়ে অসাধারণভাবে প্রকাশ করবে। তার চোখেও অন্যান্য জনের মতই থাকবে হতাশা। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে, চোখের সেই হতাশার গহীনেও আছে পরম লালিত আশা! সেইরকম একজন মানুষ, বিভু। বৈভব থেকে বিভু।
ও ছবি আঁকে। কখনও মনের সুখ বাইরে বেড়িয়ে এলে গান গায় মাঝির সুরে। আনমনে দু'এক চরণ শাদা পাতায় বিছিয়ে দিলে, লোকে ডাকে কবি। বিভু শুনে হাসে। তার যে খেয়াল নেই নাম-ধামে! সে শুধু মনকে শোনে- মন কী বলে, মন কী খোঁজে!? বিভুর বিয়ে হয়েছে সরবী_র সাথে।
মনে মনের ভাললাগা থেকে তারা দু'জন মনের ঘর বাঁধার ইচ্ছা রেখেছিল। কিন্তু সে ঘর শুধু চাহিদার ঘর হয়ে উঠতে থাকে, মনন-স্বপ্নের ঘর নয়। বিভু বুঝতে পারে সরবী যেন আগে শিল্পী বিভুকেই ভালবেসেছিল, মানুষ বিভুকে নয়। ঘর করতে গিয়ে এখন সে শুধু মানুষ বিভুকে চায়, শিল্পী বিভুকে নয়। বড় অস্থির লাগে ওর! দু'টি মানুষই যে ওর মাঝে সমান সমান বিদ্যমান।
একটিকে ছেড়ে দিলে অন্যটি যে কোনোভাবেই বাঁচবে না! সরবী যেন এখন চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করতে শিখেছে। মন-আত্মার পথে হাঁটতে শিখিয়েছে বিভু সরবীকে কিন্তু কখনও তো পথ চলতে কী পেল-না পেল, তার হিসেব করতে শেখায়নি। যা অচিরেই আসবে-যাবে তার আবার হিসেব কেন?! মানুষের লক্ষ্য যে একটাই, লক্ষ্যের প্রয়োজনেই কিছু আসবে-কিছু যাবে। কিন্তু সরবী লক্ষ্যভ্রষ্ট। ওর মনেও দুঃখ।
স্বপ্নবিধাতার দেখানো পথে হাঁটতে ও ভুলে গেছে। থমকে দাঁড়িয়ে আছে হাতে থাকা ফুলের একটি পাপড়ি ছিঁড়ে গেছে বলে!)
'মনের গহ্বরে যে সরবী থাকতো সেও কি সমাজের বাকি মানুষগুলোর মতই পাল্টে গেল! সেও কি বুঝলো না!'... -কত শত প্রশ্নই না এসে জমা হয় বিভুর মনের উঠোনে...
(সরবী) = ওগো, কই গেলে? এই দ্যাখো, তোমার জন্য কী এনেছি! শিউলিমালা!
(বিভু) ≅ খুব সুন্দর ফুলগুলো! কিন্তু ওগুলো এভাবে ছিঁড়ে আনলে কেন!
= বাঃরে! তোমায় যে মালা পড়াবো। তোমার কি মালা পড়বার শখ নেই? তুমি কি ফুল ভালবাসনা?!
≅ ফুল ভালবাসি। বৃক্ষ থেকে অবলীলায় ফুল ঝরে পড়লে তা মানা যায়। কিন্তু জোর করে কেউ ফুল ছিঁড়ে এর দেহে সুঁই ঢুকিয়ে মালা গাঁথবে- এ দৃশ্য যে আমি সইতে পারবো না! আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়! মালা আমার জন্য নয়।
= তোমার কি কামনা নেই?! মনের ভালবাসা নেই?!
≅ আছে......অনেক আছে। আমি তো তোমাকে সবসময় ভালবাসি। প্রতিটি নিশির আঁধারে তোমার মায়ামুখ আমার রঙ-তুলিতে ভেসে ওঠে। প্রতিদিনের সূর্যে আমি তোমার চাঞ্চল্যের আলো দেখতে পাই! সেই তোমাকে কী করে কামনায় রাখি? তুমি তো আমারই আছো। নতুন করে কী আর কামনা জাগবে? দেহ-ভোগে কি তোমায় পাওয়া যাবে?!
= তোমরা যে পুরুষ, তোমরা যে সৌন্দর্য-পূজারী!
≅ না, না! সৌন্দর্যকে যে এভাবে পূজা করা যায় না! আমি যে তোমাকে দেবীর আসনে বসিয়েছি সরবী...! শরীর জাগে শরীরের তাগিদে।
কিন্তু মন না জাগলে......!? শুধু স্বামী অধিকারে তোমাকে আমি ভোগ করতে চাইনি!
= হা হা হা! তোমরা তো পুরুষ! যখন ইচ্ছে হলো সংসারত্যাগী, ইচ্ছে হলেই খুব আদর.....কখনো আবার খুব আবেগ! তোমাদের ভারী কথা, ভারী আলাপ আমার সহ্য হয় না। তোমরা হুট করেই তেজ করো, যুদ্ধ ডাকো! তোমরা যা খুশি তা-ই করতে পারো।
শুধু পারে না যে সে নারী। পারে না সংসারবিমুখ হতে, পারে না সন্তান ফেলে দিয়ে বিবাগী হতে! পারলে যে পাপ হয়! নারীধর্ম আর পুরুষধর্ম যে সমাজ আলাদা করে দিয়েছে...হা হা হা!
≅ আমি তো যুদ্ধ চাইনি, আমি তো আলাদা করিনি কিছুই! আমি তোমাকে সত্য পথ দেখাতে চেয়েছি- যে পথ বিধাতা দিয়েছেন, সমাজ নয়! সরবী, এই চেয়ে দ্যাখো! ছুঁয়ে দ্যাখো, আমরা সমান! আমরা আলাদা নই!
= (উদাসিনভাবে তাকিয়ে) আমি যদি মরে যাই! তুমি কাঁদবে না?
≅ না। বিশ্বাস করো, আমি একটুও কাঁদবো না।
যাকে সবসময় মন দিয়ে ছুঁয়েছি, যার আত্মাকে অনুভব করেছি নিজ আত্মার সান্নিধ্যে সে যদি তার আস্রয়-দেহে আর না বাস করে তাতে আমার দুঃখ কী? আমি যে তোমাকে আমার আত্মায় অনুভব করি...সেখানেই তুমি বেঁধে!
= তুমি যেন পার্থিব নও! তুমি এক অদৃশ্য মাত্রা!
≅ যদি বলো, তাহলে তা-ই। তুমি কি আমাকে পার্থিব দেখেছো?
= হ্যাঁ, এই তো তুমি সামনে দাঁড়িয়ে!
≅ নাহ, ভুল! তুমি একটি শরীর, একটি অবয়ব দেখতে পাচ্ছো। আমাকে তুমি দেখতে পাচ্ছো না।
= দেখতে পাচ্ছি, তোমার ছায়াও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!
≅ শরীরের অস্তিত্ব বজায় রাখতে আঁধারে ছায়ার সৃষ্টি হয়। শরীরের ছায়াকে প্রয়োজন।
আমার ছায়ার প্রয়োজন হয় না।
= কী বলছো এসব?!
≅ সত্যি বলছি সরবী! জানো, আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে মিহি গুড়োর মাঝে। অথবা কোনো শুভ্র ধোঁয়ার সুরে! মাঝে মাঝেই গুড়ো বালু হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। জমে থাকা অস্তিত্বকে বালুর মাঝে মুক্তি দিতে ইচ্ছে করে। বালু যে খুব সুন্দর! এর লুকোনো সুগন্ধটা কি তুমি পাও? আমি লুকিয়ে যাবো বালুর মাঝে।
আমাকে গ্রাস করে নিতে চায় সে তার মাঝে অনন্তকালের জন্য!
= তোমার কি কষ্ট হবে না? তুমি যে শ্বাস নিতে পারবে না!
≅ কষ্ট হবে। কিন্তু সেটা তো শরীরের হবে। আত্মার কি প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে হয়! আত্মা তো সীমাবদ্ধ নয় কোনোকিছুতে! আত্মার জন্যই শরীর, শরীরের জন্য আত্মা নয়।
= দুটোরই কি সমান প্রয়োজনীয়তা নেই?! আমি মানিনা তোমার কথা। তুমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছো, তোমার চেহারায় তার ছাপ স্পষ্ট! তুমি ভাল নেই...
≅ আমি ভাল আছি।
আমার অসুখ নেই। বরং তোমার অসুখই চাপাতে চাইছো আমার আত্মার উল্লাসে! অসুখ তোমাদের মধ্যেই- তোমাদের চোখে, শ্বাস-প্রশ্বাশ আর স্পর্শে, সবকিছুতে অসুখ।
(কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে) তোমরা সুন্দর দ্যাখো, দেখে বাহবা দাও। কিন্তু অবলোকন করো না, কেন সে সুন্দর!? তোমরা একটি রুপ-সত্তা খুঁজে, আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চাও। সর্বসত্তা তোমাদের গায়ে যেন কাঁটা দেয়।
তোমরা ক্ষুদ্র হয়ে বাঁচতে চাও......বিশালতায় তোমাদের হারানোর ভয় থাকে। না পারো ক্ষুদ্রকে তোমরা সংগঠিত করতে, না পারো বিশালতাকে নেতৃত্ব দিতে। তোমরা কিছুই পারো না। তোমরা মধ্যমপন্থী, দুই নৌকায় পা রাখা ভারসাম্যহীন ভোক্তা। অবিবেচক তোমরা, তোমাদের যে মুক্তি নেই!
= তোমার মুক্তি আছে?!
≅ আমি তো মুক্তই।
আমাকে তো তোমরাই বন্দী করে রাখতে চাও পরিসীম শরীরে, একটি নষ্ট মমিতে! কিন্তু আমি বুঝে গেছি। তোমাদের মধ্যে ফাগুন আসে না। কারণ শীতকে তোমরা ছাড়তে পারো না! এতো আয়োজন আর সুদীর্ঘ পরিকল্পনায় জীবনকে তোমরা ভারী করে তোলো, শীতে জড়সড় করে ফেলো যে ফাগুনের স্বল্প উষ্ণ-সজীবতাকে তোমরা উপভোগ করতে পারো না! তোমরা বাছো, বেছে বেছে সুন্দর নির্বাচন করো। হায়! বিধাতা যে সবকিছুর মাঝেই সুন্দরকে গড়ে দিয়েছেন। প্রয়োজন একটু আগ্রহের।
কিন্তু তা তোমরা, সমাজের তথাকথিত নীতিধারীরা বিশ্বাস করতে চাও না। তাই তোমরা সুন্দরের গ্রাস বোঝো না।
ঝড়ের কবলে পড়া নৌকা-জাহাজের ডুবে যাওয়া দ্যাখো তোমরা। হিসেব করো ক্ষয়-ক্ষতি, হারানো বস্তু আর মানুষের লাশ গুণে। কিন্তু জল আর জলের ওপরে ভাসা নৌকার প্রেম দ্যাখো না।
বোঝো না তাদের প্রেমের সহস্র বছরের পরিণামের ব্যাখ্যা! নৌকার প্রতি জল আবেদন করে, তার মঝে বিলীন হওয়ার ...আর জলের চিরসাথী হতে নৌকাও সায় দেয়। দু'জনের আকুল আবেদনে সাড়া পেয়ে সমস্ত জল-আকাশ-মেঘ-বাতাস ডেকে আনে প্রলয়! বজ্র তাদের যুগান্তকারী মিলনে গর্জে উঠে সানাই বাজায়...... কিন্তু প্রলয়ের ভয়ঙ্করী রুপে তোমরা সে সানাই শুনতে পাও না। আহ! কত ছোট তোমাদের পরিসর!
(সরবী কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকে...তারপর)
= আমি কী করবো বিভু!? আমায় তুমি তাহলে মেরে ফেরে ফেলো! আমায় মুক্তি দাও...(কান্নায় ভেঙে পড়ে)
≅ ওঠো। এভাবে মুক্তি মেলে না সরবী।
= বাঁচলেও যে আমার মুক্তি নেই!
≅ মুক্তির স্বাদ নিতে চাও, তবে আত্মাকে অনুভব করো।
আত্মা সুন্দর, আত্মা নিজের কথা বলে। আত্মার কথা শোনো।
ইকারাসও আত্মার কথা শুনেছিলো! তাঁর বাবা ডিডেলস তাঁকে পাখা বানিয়ে দেয়ার সময় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যেন সে সূর্যের খুব কাছ দিয়ে না ওড়ে। কিন্তু ইকারাস পালিয়েছিল! সে জানতো ক্রীটীতে বসে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তাঁর স্বপ্ন- সূর্যকে ছোঁয়া, স্বর্ণালি সূর্যকে যদি একেবারে ধরে ফেলা যায়! কিন্তু সূর্যকে ইকারাস ধরতে পারেনি।
উড়তে উড়তে যখন সূর্যের খুব কাছে চলে যেতে থাকে তখন পাখায় ব্যবহৃত ওয়াক্স গলে সে নিচে সমুদ্রে পড়ে যায়। ইতিহাসের চোখে সে মৃত হলেও আসলে তাঁর সুন্দর একটি স্বপ্ন তাঁকে অন্য সুন্দরের মাঝে গ্রাস করে নিয়েছিল। যেখানে সে এখনও বেঁচে- ইকারাস শেষ অবধি নিজ আত্মাকে অনুসরণ করেছিল!
এই সৃষ্টিলোকের সবকিছুতে ছড়িয়ে আছে অগণিত-অসীম সৌন্দর্য। সুন্দরের ধর্মই গ্রাস করা! সেই সুন্দরের মাঝে তাই হারিয়ে যাও...
তোমার এই দেহও নিছক নয়। দেহেরও প্রয়োজন আছে।
তবে মনে রেখো প্রিয়, দেহ ক্ষণিকের। কিন্তু আত্মা চিরন্তন, আত্মার মৃত্যু নেই।
= হ্যাঁ, আমি বাঁচবো। আমি বাঁচতে চাই!
≅ তাহলে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র ভাললাগার ডাকে সাড়া দাও! তাদেরকে অবলীলায় বরণ করলে, তারাও তোমাকে ভুলবে না। তোমায় মরতে দেবে না! জানো তো, এক সুন্দর অপর সুন্দরের প্রতিবিম্ব।
তারা একে অপরের প্রতিফলিত রুপ। জল-আকাশ-মাটি যেখানেই যাও, তাদের সৌন্দর্যের মাঝে তুমি নিজের ছায়া দেখতে পাবে। আর পারস্পরিক এই প্রতিফলনই একটি চিরন্তন ভালবাসার পটভূমি তৈরি করে!
-------- **সুন্দরকে খোঁজো, অবলোকন করো, মুক্ত হও** --------
- পেন আর্নার
শুভ্র ধোঁয়ার সুর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।