বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
ন গা মাগিলেও যা ছ গা মাগিলেও তা। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। ণ আর ন-ও মাসতুতো ভাই। তবে ণ, ন-এর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। কিন্তু দুইজনের কাজকর্মে ভারী মিল।
গাঁওয়ের লোকজন যাতে তাদের আলাদা করে চিনতে পারে, তাই তারা মাঝে মধ্যে নিজেদের মধ্যে লোক দেখানো ভানের নামে কিছু কিছু কলহ বিবাদ করে বটে। কিন্তু লোক চুর আড়াল হলেই তারা কিন্তু একসঙ্গে দুধ-কলা খায়। যাকে বলে মানিক জোড়। একবার বাংলা নববর্ষের বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা দুই মাসতুতো ভাই ণ আর ন-কে তাঁর রাজ দরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। অনুষ্ঠানে ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা বললেন- গোটা রাজ্যে তোমাদের নামে শুধু চুরির নালিশ শুনি।
ব্যাপারটা কী, এ্যা? তোমরা কী আমার রাজ্যের শান্তি নষ্ট করতে চাও? যার যা কিছু চোরে যায়, সবাই শুধু তোমাদের নাম কয়। চুরি না করে কী তোমরা বাঁচতে পারো না? রাজ দরবারে এসে সত্য স্বীকার না করলে আজ তোমাদের গর্দান যাবে। আমার ঙাপ্পি রাজ্যে আমি আর কোনো চুরির ঘটনা সহ্য করব না। ণ আর ন ভারী অসহায় ভঙ্গিতে পরম্পর চোখাচোখি করল। প্রণামের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপার সামনে মাথানত হয়ে তারা দাঁড়িয়ে।
ঙাপ্পি রাজার উন্মুক্ত রাজ দরবার তখন সৈন্য-সামান্ত, উজির-নাজির-লস্কর, পাইক-পেয়াদা আর সাধারণ জনতায় লোকারন্য। ণ আর ন-এর ভাগ্যে আজ কী ঘটে তাই নিয়ে সবার মধ্যেই ভারী উৎকণ্ঠা।
ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র প্রধান উপদেষ্টা চিরানন্দ চাপা রাজা মহাশয়ের কানে কানে কী যেনো বললেন। ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা ভারী মনযোগ দিয়ে তা শুনলেন। রাজা মহাশয়ের বামপাশে দাঁড়ানো রাজভোগ হাতে রাজ খানসামা অগুন্তি কাহেরি।
অগুন্তি কাহেরির ডালা থেকে একটা রসগোল্লা মুখে পুরতে পুরতে ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা আবার হুংকার দিলেন- কীরে নচ্ছার দল, বল, তোদের জন্যে আমি কী করতে পারি? ণ আর ন এক পা সামনে এগিয়ে সমস্বরে বলল- আমাদের মা করুন জাঁহাপনা। আপনার কাছে আমরা প্রাণ ভিা চাই। জবাবে ঙাপ্পা রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা বললেন- কেবল একটা শর্তে আমি তোমাদের প্রাণ ভিা দিতে পারি। আমার রাজ্যে আর কোনো দিন কোথাও চুরি হবে না। যদি আর কোনো চুরির ঘটনা ঘটে, তবে সেদিন তোমাদের রাজ দরবারের প্রকাশ্য মাচায় ঝুলিয়ে ফাঁসিতে হত্যা করা হবে।
বছরের প্রথম দিন আমি কোনো হত্যা দেখতে চাই না। কিন্তু নির্ভয়ে তোমরা তোমাদের চুরির সব ঘটনা আজ রাজ দরবারে প্রকাশ কর। ণ আর ন ঙাপ্পা রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র দু’পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আপনি মহান, জাঁহাপনা। আপনি আমাদের দেবতা।
ণ আর ন-এর থেকে পা ছাড়িয়ে ঙাপ্পা রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা সিংহাসনে বসলেন। রাজ দরবারের পদস্থ উজির-নাজির-লস্কর, সিপাহসালার আর গন্যমান্য লোকজন নিজ নিজ আসনে বসলেন। কেবল পাইক-পেয়াদা আর সৈন্য-সামান্ত ছাড়া বাকী সবাইকে ঙাপ্পা রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা ইসারায় বসার অনুরোধ করলেন। এখন ণ আর ন-এর সকল চুরির ঘটনা রাজ দরবারে প্রকাশ করার পালা। রাজ দরবারের পুরোহিত মিস্টার কৈবল্য ধাপ্পা এসে ণ আর ন-কে শপথ করালেন।
আমরা শপথ করিতেছি যে, অদ্য ঙাপ্পা রাজ দরবারের প্রকাশ্য আলালতে মহারাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র সামনে উপস্থিত হইয়া আমরা এই মর্মে ঘোষণা করিতেছি যে, যাহা সত্য তাহা বলিব। সত্য বই কোনো কিছুই মিথ্যা বলিব না। যদি আমাদের কোনো কথায় মিথ্যা বলিয়া প্রমানিত হয়, তাহলে মহারাজা’র ইচ্ছানুসারে আমাদের রাজদণ্ড হইবে। আর সেই রাজদণ্ডে আমাদের কোনো আপত্তি থাকিবে না। অদ্য নতুন বছরের প্রথম দিন হইতে আমরা ইহকালে আর কোনো দিন চুরি করিব না।
যদি কেহ পরবর্তীকালে আমাদের নামে চুরির অভিযোগ আনিয়া থাকে, আমরা তখনো মহারাজা’র সদয় শাস্তি মানিয়া লইতে বাধ্য থাকিব। ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা জয়তু। আমিন।
রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পা ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপাকে প্রণাম করে নিজ আসনে গিয়ে বসলেন। এবার ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা ণ-কে প্রথম স্বীকারোক্তি দিতে ডাকিলেন।
ণ উঠে সবাইকে প্রণাম দিল। ণ-এর স্বভাব হল- যখন কথা বলে সবকিছু কেমন যেনো একটু গুলিয়ে ফেলে। রাজা মহাশয়, আমি জীবনে কোনো দিন চুরি করতে চাইনি। ন আমারে চুরি পেশায় নিয়া আইছে। এখনো আমার চুরি করতি গেলি বুক ধরফর করে।
চুরির আগে তিনবার ভগবানের নাম নি। সাতবার আপনার নাম নি। আর মনে মনে অসুরকে ডাকি।
আসল ব্যাপার হল, তখন যুদ্ধের সময়। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হল।
বাবায়রে হরমুজরা মাইরা ফেলাইলো। মায় আমারে লইয়া আশ্রয় লইলো ন-গো বাড়ি। ন-এর বাবা তখন খুব প্রতাপশালী। মাকে ন-এর মা বোন ডাকলো। সেই থেকে ন আমার মাসতুত ভাই।
ন-গে বাড়ি আমি বড় হতি থাকলাম। আমার বয়স যখন এগারো তখন হঠাৎ মা মারা গেল। আমার আর কোথাও যাবার উপায় থাকলো না। ন-এর সাথে বনে বাদারে খাই দাই ঘুরি। ন যখন ইশকুলে যায় আমি তখন মাসির হেলপার হিসেবে কাজ করি।
ন ইশকুলতে ফিরলি আবার চলে আমাদের খেলাধুলা ঘোরাঘুরি। ন বলতো ইশকুল ওর ভালো লাগে না। ইনিয়ে বিনিয়ে নানা ফন্দি ফিকির করে ন ইশকুলে যাওয়া বন্ধ করলো। মাসি মা ঘোষণা দিলেন, ইশকুলে না গেলি তোর ভাত বন্ধ। ন বললো, ঠিক আছে।
মাসিমা দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘুম যেতেন। ন আমারে ডাইকে কানে কানে কলো, মা ঘুম গেলি আমার জন্যি তুই ভাত নিয়া আসফি। খবরদার, কাক পক্ষিও যেনো টের না পায়। মাসিমা ঘুম পড়লি ন-এর জন্যি ভাত আনলাম। ন ভাত খেলো।
মাসিমা ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে গেলেন। দেখলেন সব ঠিক ঠাক আছে। আমারে ডাইকে জিগালেন, ন কোই? কলাম, তাল ভিটায় বইসে আছে। মাসিমা একটা থালায় কিছু খাবার দিয়ে কলেন, এইডা নিয়া তাল ভিটায় যা। এভাবে ধীরে ধীরে ন-এর ইশকুলে যাওয়াও খতম হল।
তার মদ্দি ম্যালেরিয়ায় মেসো মারা গেল। ন আর আমি তখন সব কাজের শমসের।
পাড়ায় কখন যাত্রা নামাতি হবে, কখন বিয়াত্তো অবিয়াত্তো ফুটবল খেলা হবে, কখন পুতুল নাচ বসবে, কখন কার বিয়ায় কীভাবে বাড়ি সাজাতি হবে, কীভাবে হেমন্ত মেলা হবে- এইসব কাজে আমরা জড়িয়ে গেলাম। ন তখন সব কাজে নের্তৃত্ব দেয় আর আমি তার যোগ্য এসিসট্যান্ট। তার মদ্দি মাসিমা ন-এর বিয়া ঠিক করলো পরেশ ধাপ্পার মেয়ে বুচি’র সঙ্গে।
ন ঘোষণা দেলো- যে করেই হোক বিয়া ভাঙতি হবে। কারণ, পরেশ ধাপ্পা লোকটা বেশি সুবিধার না। দাঙ্গার সময় অনেকের মাল জিনিস লুটপাট করছে। পাড়ায় পাড়ায় রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পা’র নাম ভাঙ্গিয়ে পরেশ ধাপ্পা এখনো অনেক চাঁদাবাজি করে। বুচি যাতে এই বিয়াতে রাজী না হয় সেজন্নি ন একটা বুদ্ধি পাকালো আমার সাথে।
বুচিরে দেখাইয়ে আমরা একটা জিনিস চুরি করবো। যাতে ন সম্পর্কে বুচি’র মন খারাপ হয়। আর বিয়ে ভেঙ্গে যায়।
আমরা বুচিদের জারুল ভিটায় পরেশ ধাপ্পা’র মৌচাক থেকে মধু চুরি করলাম। মধু চুরি কইরে ফেরার সময় বুচি আমাদের দেখলো।
আমরা মধু দেখাইয়ে বুচিরে না দেখার ভান করলাম। বুচি যা বোঝার বুঝলো। বিয়া গেলো ভেঙ্গে। তারপর থেকে পরেশ ধাপ্পা আমাদের পিছনে লাগলো। পাড়ায় কিছু চুরি হলিই পরেশ ধাপ্পা আমাদের নাম রটানো শুরু করলো।
আমরাও পরেশ ধাপ্পা’র শয়তানির জবাব দেওয়ার জন্নি রেডি থাকলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, আজ পর্যন্ত আমরা কারোর একটা ফুটা পয়সাও চুরি করিনি। কেবল পরেশ ধাপ্পা’র শয়তানী বন্ধ করার জন্নি যা যা করছি, তার কিছু কলাম।
ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা ণ-কে এই পর্যায়ে থামিয়ে দিলেন। পরেশ ধাপ্পাকে রাজ সভামঞ্চে ডাকলেন।
জনতার ভিড় ঠেলে পরেশ ধাপ্পা সবাইকে প্রণাম করে ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা হুংকার দিলেন- ণ যা বললো, এসব কী সত্যি পরেশ? তুমি কী রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পা’র নাম ভাঙ্গিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চাঁদাবাজি করো? কী হচ্ছে এইসব আমার ঙাপ্পি রাজ্যে?
পরেশ ধাপ্পা অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন- মহারাজ, আমি আপনার রাজ্যের একজন অতি গরীব মধুচাষী। সারা বছর মৌচাক থেকে মধু আহরণেই আমার সময় কাটে। রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পা একজন মস্তবড় পণ্ডিৎ ব্যক্তি। আমি কেনো তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁন্দাবাজি করতে যাবো।
আমার তো সময় কাটে জারুল ভিটায় মৌমাছির সঙ্গে। আমাকে কেউ চাঁন্দা দিলে আপনার কাছে এসে যেনো সে এখন বিচার চায়। এর পিছনে ওদের হয়তো কোনো বদ মতলব আছে মহারাজ।
ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা ইসারায় রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পাকে কাছে ডাকলেন। রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পা ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র কাছে গিয়ে কিছু একটা কানাকানি করলেন।
তারপর রাজ পুরোহিত কৈবল্য ধাপ্পা নিজ আসনে গিয়ে বসলেন। ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র প্রধান উপদেষ্টা চিরানন্দ চাপা উঠে গিয়ে ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র কাছে কিছু একটা বললেন। কানাকানি শেষ করে সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে চিরানন্দ চাপা ঘোষণা দিলেন- এখন বিচার কাজে সাময়িক বিরতি। আমরা এখন নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে ফিরে যাচ্ছি। এবার আপনাদের সামনে ত্রিপুরা ভরতনাট্যম পরিবেশন করবেন কাঞ্চনজঙ্ঘা’র দল।
চিরানন্দ চাপা’র ঘোষণা শেষ হতেই ঙাপ্পি রাজা মঞ্চাপ্পি থাপা’র সভাস্থল করতালিতে মুখর হয়ে গেল। করতালি শেষ হলে চিরানন্দ চাপা বললেন- ণ আর ন-এর বিচারের বাকী অংশ শুরু হবে কাঞ্চনজঙ্ঘা’র ভরতনাট্যম পরিবশেনা শেষ হলে। সবাইকে কাঞ্চনজঙ্ঘা’র ভরতনাট্যম পরিবশেনা উপভোগের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিরানন্দ চাপা নিজের আসনে গিয়ে বসলেন।
.................................... চলবে..........................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।