আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগা নষ্টালজিক গোড়া নষ্টালজিক [তিন]

salehin.arshady@gmail.com :::মোস্তফা::: তখন আমি পড়ি নারায়নগঞ্জ এর বিখ্যাত প্রিপারেটরী স্কুলের ক্লাস টু তে। সবে মাত্র স্কুলে একা আসা যাওয়া করা শুরু করেছি। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময়ে প্রতিদিনই নিত্যনতুন এডভেঞ্চার হত। আজকে এই গলিতে এক্সপিডিশন তো কালকে মেইন রোড ঘুরে উলটা দিক দিয়ে বাসা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। একদিন ক্লাসের দুষ্ট ছেলে হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আমার বন্ধু ইমন কানে ফিসফিস করে বলল, “দোস্ত এক আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?” সেইদিন থেকেই মোস্তফার সাথে আমার পরিচয়।

স্কুলের পর ইমন আমাকে নিয়ে আসলো খাজা সুপার মার্কেটের নীচ তলার কালো মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা অন্ধকার ছোট্ট একটা খুপরির মত ঘরে। প্রথম দিকে একটু ভয় ভয় আর অস্বস্তি লাগলেও কোন এক নিষিদ্ধ উত্তেজনার টানে আমিও পর্দার আড়ালের এই নিষিদ্ধ পল্লীতে ঢুকে গেলাম। কালো রঙের গোল জয়স্টিক আর লাল-হলুদ সুইচ গুলায় হাত পাঁকাতে খুব বেশী দিন লাগল না। স্কুল ছুটি হলেই দুজন দৌড়ে চলে আসতাম। হান্না আর মোস্তফার জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত।

পরে ঠিক করলাম একদিন আমি হান্না নিয়ে খেলব (মেটাফরিক্যালি) আরেকদিন ইমন খেলবে-অল মিচুয়াল। এরপর তো এক নেশার মত হয়ে গেল। মোস্তফা, হান্না, জেক আর মোটকা মেস আমার আপনজন হয়ে গেল। জয়স্টিক টা ধরলেই নিজেকে সুপার হিরো মনে হত। গায়ে চলে আসত অসুরের মত শক্তি।

খেলতে খেলতে উত্তেজনায় একসময় সেই ডায়নোসরদের জগতেই চলে যেতাম। ইমন মার মার, পাঞ্চ মার, আরও জোরে মার, এদিক এদিক, কিক মার কিক মার, গ্রেনেড নে, লাফ দে লাফ দে, আপারকাট মার মার চিৎকার করতে করতে গলার রগ ফুলে উঠত। তবুও চিৎকার থামত না, জয়স্টিক বন বন করে ঘুরানো আর সেই সাথে তালে তালে বোর্ডের উপর বাড়ি। পৃথিবীর উপর সব আক্রোশ সেই কনসোল গুলোর উপর দিয়েই মিটিয়ে নিতাম বোধ হয়। প্রতিদিন টিফিন কেনার টাকা গুলো মনির এর খুপরি দোকানে চলে যেত।

দুই টাকায় এক কয়েন আর পাঁচ টাকার তিন কয়েন। প্রথম বস কে মারার পর কি যে খুশি হয়েছিলাম বলে বুঝাতে পারব না। বস মারার পর হান্না’র সেই মন কেড়ে নেয়া ডায়লগ- “হোয়াট আ উইম্প” শুনে যেভাবে শিহরিত হতাম, ঈদের চাঁদ দেখলেও এত খুশি লাগত না মনে হয়। সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল কসাই বস। আর স্লাইসার তো ছিল ভয়ংকর।

কসাই কে মারার উপায় খুঁজতে গিয়ে কত টাকা যে খরচ করেছি সেটার হিসাব বের করলে আজকে মনে আবার নেপাল চলে যেতে পারতাম। কিন্তু সেই সময় নেপাল এর শ্বেত শুভ্র পাহাড় এর রোমান্টিকতা থেকে মোস্তফার কিক এর থ্রিল বেশী প্রয়োজনীয় ছিল। বাস্তবে মারামারি করার সময় তো এখনও তাদের কিক আর পাঞ্চ এর মুভ গুলাই অন্ধের মত ব্যবহার করি। খুপে মোস্তফা খেলব আর ধরা খাব না সেটা কি হয়?? একদিন পাগলের মত খেলছি, মনে মনেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি- যেভাবেই হোক আজকে শেষ করবোই। দিন দুনিয়া সব কিছু ভুলে গেছি তখন, কোন ফাঁকে যে সূর্য ডুবে গেছে খেয়ালই করি নাই।

হঠাৎ কে যেন আমাকে টান দিয়ে ঘুড়িয়ে কান পট্টিতে একটা কষিয়ে থাপ্পর মারল। থাপ্পর খেয়ে বোধ বুদ্ধি সব চলে গেল, তাকিয়ে দেখি ছোট চাচা যমের মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে আর থরথর করে কাঁপছে। এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে মুখ দিয়ে কান্নার আওয়াজ ও বের হচ্ছিল না, চোখ দিয়ে টপটপ করে শুধু পানি পরছিল। এরপর হিরহির করে টানতে টানতে আমাকে বাসায় নিয়ে গেল।

সেখানে বসল আমার বিচার। বাসার সবার থমথমে মুখ দেখে আবার ফোঁপানি শুরু করতেই আব্বুর হাতে আর একটা রাম থাপ্পর এর দাগ বসে গেল গালে। এরপর মাথা নীচু করে শুধুই শুনে গেলাম, বড় হইয়া তুই গুন্ডা হবি, ভাদাইম্মা হবি, তোরে দিয়া আর লেখাপড়া হবে না, বস্তির পোলাপান এর মত টোকাই হবি তুই, সাথে ছিল আব্বুর সর্বশেষ অস্ত্র...তোরে ছাগল নাইয়ায় পাঠায়া দিব (ছাগল নাইয়া আমার কাছে তখন এক আতঙ্কের নাম ছিল। ঐখানে এক কুখ্যাত মাদ্রাসায় কিভাবে ছেলেদের লেংটা করে পিটায় সেই গল্প শুনলেই আমি কাবু হয়ে যেতাম) এইদিনের পর থেকেই আমার হোস্টেলে যাওয়া মোটামোটি কনফার্ম হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি হোস্টেলে চলে গেলাম।

মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগত। কিন্তু একসময় মোস্তফার কথা ভুলেও গেলাম। ছুটিতে বাসায় আসলে কখনো কখনো ঢুকে যেতাম পর্দার পিছনে। কিন্তু আগের মত আর আকর্ষন করত না লাস্যময়ী হান্না। এরপর বাসায় কম্পিউটার চলে আসল।

ধুমধাম করে বড় হয়ে গেলাম। শুরু হল এক নতুন যুগ। এক নতুন নেশা। যত যাই বলি না কেন, মোস্তফা ছোটবেলার এমন এক অধ্যায় যা আমাকে আজও রোমাঞ্চিত করে। খেলতে বসলে এখন আর তেমন উত্তেজিত হই না-আর সেটাই তো স্বাভাবিক, অনেক বড় হয়ে গেছি যে ! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।