গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার। লেখাটি লিখেছিলাম ৩০ এপ্রিল তারিখে, মে দিবসের প্রাক্কালে। কিন্তু তখন সামুতে পোস্ট দেয়া সম্ভব হয়নি।
১৮৮৬ সালে নিউইয়র্কের শিকাগো শহরে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে গড়ে তোলা আন্দোলনের ফল হচ্ছে ১লা মে, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস। সারাবিশ্বে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের প্রতীক হিসেবে প্রতি বছর এ দিনটিকে পালন করা হয় যথাযথ মর্যাদায়।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আজ যখন এই লেখাটা লিখছি তখন বাংলাদেশের বাতাস গার্মেন্টস শ্রমিকদের গলিত লাশের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে। চারদিকে আহত-নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারিতে এক বেদনা বিদূর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা আহত-বিকলাঙ্গ শ্রমিকদের দিকে তাকালে মানুষের বিবেকের রুদ্ধ কপাট প্রবল আক্রোশে ভেঙ্গে পড়তে চায়। সবকিছু মিলিয়ে সভ্যতার কাঠগড়ায় বিরাট একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ১লা মে, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবসের আগমন ঘটেছে বাংলাদেশে।
অথচ এমনটি কেউ ভাবেনি। ১লা মে দিনটি বরাবরের মতে গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতায় পালন করা হবে বাংলাদেশে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাধ সাধলো সেখানে নিয়তি।
তবে নিয়তিকে শুধু দোষ দিলে চলবে না। এই নিয়তি তৈরী করেছে শ্রমিকদের ঘাম আর রক্তের পয়সায় উদর পূর্ণ করা কিছু সংখ্যক মালিক শ্রেণী।
তাদের লোভাতুর মনের চাহিদার সাথে তাল রাখতে না পেরে গত ২৪ এপ্রিলে হাজার হাজার কর্মরত শ্রমিকদের চাপা দিয়ে ভেঙে পড়েছে সাভারের রানা প্লাজা। ছয় তলা ভিত্তির উপর তৈরী করা আট তলা এই ভবনটিতে ছিল ৪টি পোশাক কারখানা। ফাটলের কারণে স্থানীয় প্রশাসন আগের দিনই ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেও সে নির্দেশ মানেনি ভবন মালিক ও গার্মেন্টস মালিকগণ। বেতন কর্তন কিংবা চাকুরী হারাবার ভয় দেখিয়ে পরের দিন অর্থাৎ ২৪ এপ্রিলে শ্রমিকদেরকে কাজে আসতে বাধ্য করে তারা। অসহায় শ্রমিকরা মালিকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করবে এমন সাহস বা সুযোগ কোথায় তাদের ? হাতেগোণা কয়টা টাকায় দড়ি টানাটানির সংসারে বেতনকাটা বা চাকুরী চলে যাওয়া কোনটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তাদের কাছে।
এর সামনে জীবনের মায়া তুচ্ছ হয়ে যেতে বাধ্য। মানুষ নামক অর্থলোভী দানবেরা এতে পুলকিত হলেও এর ভার সহ্য করতে পারেনি ভবনটি। প্রচন্ড আ ক্রোশে মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে সেটি। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত দেবে যায় মাটির নিচে। চাপা পড়ে হাজার হাজার শ্রমিক।
পৃথিবীর ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের নজির তৈরি হয় সাভারে।
এরপর শুধু লাশ গোণার পালা। তাৎক্ষণিকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সরকারের সর্বোচ্চ শক্তি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ধারকাজ শুরু করে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় এখনও চলমান উদ্ধার অভিযান এর মাধ্যমে উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৫০০ মৃতদেহ এবং ২৫০০ এর কাছাকাছি জীবিত শ্রমিককে। জীবিতদের বেশীরভাগই মারাত্মকভাবে আহত এবং বিকলাঙ্গ।
এদের বেঁচে থাকা এখন শুধুই অন্ধকারের সাথে ঠিকানাবিহীন লড়াই চালিয়ে যাওয়া। শরীরের রক্ত পানি করা চেষ্টায় যারা পৌঁছুতে চেয়েছিল সুখের ঠিকানায়, তাদের সে স্বপ্ন মুহূর্তেই দুঃস্বপ্ন হয়ে তাদেকে বেঁধে ফেলেছে ব্যর্থতার কাঠগড়ায়। এখন কি করবে ওরা ? যে দানবেরা তাদেরকে শুধুই টাকা বানাবার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাদের বিচার হোক বা না হোক, মৃত শ্রমিকদের স্বজনেরা আর কোনদিন ফিরে পাবে না তাদের আদরের সন্তানকে, ভাই বোনকে কিংবা স্বামী স্ত্রীকে। বিকলাঙ্গ শ্রমিকদের কর্মট হাতগুলো আর সচল হবে না দেশের অর্থনীতির চাকায় তেল সঞ্চালনের জন্য।
এমনি পরিস্থিতিতে অর্থাৎ গার্মেন্টস শ্রমিকদের গলিত-বিকৃত লাশের বোঝা যখন বাংলাদেশের কাঁধে, তখন আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবসে শ্রমিকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব মিলাবার চেষ্টা করা পরিহাস ছাড়া আর কি হতে পারে ? ১৮৮৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে শ্রমিকদের ভাগ্যের চাকা কতটা সামনের দিকে ঘুরেছে সে নিয়ে যথেষ্ট ভাববার অবকাশ রয়েছে।
১৮৮৬ সালে শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছিল ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে। সেখান থেকে তাদের উত্তরণ যদিওবা কিছুটা হয়েছে, কিন্তু মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বাতাবরণে কোন উন্নতি কি হযেছে ? আমি বলব না।
তাহলে ১৮৮৬ সাল থেকে ২০১৩ সালে এসে আমাদের উত্তরণ কোথায় ?
রক্তচোষা জীবের মতো আজও মালিকরা শ্রমিকদের রক্ত চুষে চুষে টাকার সৌধ বানাচ্ছে একটার পর একটা। বিনিময়ে শ্রমিকরা তাদের জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু পাচ্ছে না। মৃত্যুর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে শ্রমিকরা অহরহ যুদ্ধ করছে জীবন বাঁচার লাড়াইয়ে।
এর সামান্য দায়ও যদি মালিক শ্রেণী নিতো তাহলে এমন ভয়ংকর ২৪ এপ্রিল আমাদেরকে দেখতে হতো না। স্মরণকালের ভয়াবহতম এই দুর্ঘটনা শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ভিতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আরেকবার। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।