বার বার মনে পড়ে সোনালী সেই দিন গুলো...
রাত ১২টা ২৫ মিনিট। বাস চলছে, বান্দর বানের উদ্যেশে। রাতের মধ্য প্রহরে মহাসড়কগুলোতে জনজীবনের অস্থিত্ব খুব একটা চোখে পড়ে না। সবুজের চোখে তন্দ্রা চেপেছে। বার বার হাই উঠছে।
ঘুমের রাজ্য হাতছানি দিচ্ছে তাকে। তার পাশের সিটের সিট পার্টনার গাড়ীতে উঠেই চুম বন্ধ করে আছে। দেখে মনে হচ্ছে পরিতৃপ্তীর সাথে ঘুমাচ্ছে সে। এদিক সেদিক তাকিয়ে সিটে হেলান দিল সবুজ। সারাদিন কাজ করার পর কিছুটা ক্লান্ত সে।
বাসের সিটে বসে ঘুম আসছে না তবু ক্লান্ত চোখ দু’টোকে খুলতে পারছেনা সে। সজুজের আপ্রান চেষ্টা গুমানোর। চেষ্টায় সফল হলো সে। নড়া চড়া বন্ধ হয়েছে, অবশেষে ঘুমের রাজ্য প্রবেশের অনুমতি মিলেছে তার।
নীলগিরি পাহাড়ে উঠেছে সবুজ।
এটা তার কাজের অংশ নয়। তবু উঠেছে। তার ও একটা কারন আছে। কারনটা হলো নিলগিরিতে পাহাড় এবং আকাশ এক সাথে মিশে যায়। অর্থাৎ পাহাড়ের চুড়ায় দাড়ালে আকাশের ভেসে বেড়ানো মেঘগুলো মানব গা ছুয়ে যায়।
আজ আকাশে রোদ তুলনামূলক কম। কারন আকাশের মন খানিকটা খারাপ। আর তাই আজ আকাশে বেশি মেঘ উড়ছে। যে কোন সময় আকাশের ভেসে বেড়ানো মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে পারে। সবুজ মেঘ ছোয়ার নেষায় পাহাড়ের পথ হেটে বেড়াচ্ছে।
এর মধ্যে বড় একটা মেঘের খন্ড ভেসে এলো সবুজের দিকে। সে হাত বাড়িয়ে দিল মেঘের স্পর্র্শ পাবার জন্য। বড় দাত সমেত একটা মুখ বেড়িয়ে এলো মেঘের সে ভেলা থেকে। সবুজ বিদ্যুত গতিতে হাত সরিয়ে নিল। দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করলো সেই মুখটা।
সবুজ মাটিতে বসে পড়ল। কিন্তু না লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সময়ের সাথে মুখের ছবিটা ভয়ংকর হতে লাগলো। ভয়ে সবুজের কলিজা গলে যাওয়ার উপক্রম। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে সে।
কোথাও কেউ নেই। চিৎকার করার চেষ্টা করছে। কোন লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। গলা থেকে কোন প্রকার আওয়াজ বের হচ্ছে না । এই অশরীরির হাত থেকে রক্ষা পেতে পিছনে ফিরতে থাকে সবুজ।
পেছনে আর জায়গা না থাকায় পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যায় সে। সবুজ এখন শূন্যে ভাসছে। এর মধ্যে একটি হাত ধরে ফেলে তাকে। লম্বা একটি হাত। কার হাত তা দেখতে পারছেনা সবুজ।
হাতটি খানিক পিচ্ছিল। রক্ত মাখা হাতে কেউ একজন ধরে আছে সবুজকে। তার চিৎকারে হাতটি ছেড়ে দেয় তাকে। আকাশ থেকে মাটিতে পড়তে লালগ সবুজ। মাটিতে পড়ার আগে লাফিয়ে উঠে সে।
ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। না, পাহাড় কোথায়। এখনো তো বসা বাসে। তার পাশের লোকটি এখনো ঘুমাচ্ছে।
রাত ৩ টা বেজে ১৭ মিনিট।
চোখ বন্ধ করে আছে সবুজ। বাস চলছে পাহাড়ি পথ ধরে। চলন্ত বাসে এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সে ভাবে এর অর্থ কি ? কোন বিপদ আপদ সামনে অপেক্ষা করছে না তো। নানান ভাবনা তার মাথায় খেলা করছে। কিছু একটা গন্ধ ভেসে আসছে সবুজের নাকে।
গন্ধটা অপরিচিত। কিসের গন্ধ ঠিক বুঝতে পারছেনা। কাউকে জিগ্যের করে মনের কৌতুহল দূর করতে তার উপায় নেই। কারন সবাই গভীর ঘুমে। এই মূহর্তে পুরো বাসে পিনপতন নিরবতা।
গাড়ীর ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। চালক এক মনে গাড়ী চালাচ্ছে।
ঘুমন্ত লোকটি একটু পর পর হেলে পড়ছে সবুজের কাধে। বেশ কয়েকবার সরিয়ে দিতে হাত বাড়াতেই আপনা আপনি সরে গেছে লোকটি। কিন্তু না এবার আর সরলো না।
সবুজ ঠেলে কাধ থেকে সরানোর চেষ্ট করছে ঘুমন্ত লোকটির মাথাটাকে। মনে হচ্ছে সরাতে পারছেনা। হয় অনেক ওজন মুন্ডটার অথবা সবুজের শক্তি লোপ পেয়েছে। শক্তি সঞ্চার করার চেষ্ট করছে সবুজ, ঠেলে সরানোর প্রচেষ্ট এবারও ব্যর্থ হলো তার। কিন্তু এবার নতুন একটা বিষয় আবিস্কার করলো সবুজ।
লোকটার মুন্ডুটা প্রচন্ড ঠান্ডা। মনে হচ্ছে ডিপ ফ্রিজ থেকে এই মাত্র বের করা হয়েছে। চমকে উঠে সবুজ একি ! তার পাশে লোককে দেখেছিল সে এটা সে লোক না, অন্য কেউ। নাক মুখ কেমন চ্যাপ্টা, চোখ নাই। চিৎকার করার চেষ্টা করছে সবুজ।
এবারও তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। সিট ছেড়ে সরে যেতে চাইছে। কিন্তু না, কাজ হচ্ছে না। মনে হয় শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। এক ফোটা শক্তি পাচ্ছে না সে।
অথচ এই উদ্ভট মানবটা তাকে ধরে রাখেনি। সবুজ হাত বাড়িয়ে সামনের সিটের যাত্রীকে ডেকে তোলার চেষ্ঠা করে। এই যাত্রায় সফল হতে পারে না সে। কারন সামনের সিটে কোন যাত্রী নেই। পাশের সিটেও কাউকে দেখা যায় না।
এবার পেছনের সিটে হাত দিয়ে দেখে সে সিটেও কেউ নেই। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় সবুজ। ব্যাপার কি আশপাশের সিটের লোকজন কই গেল, নাকি তার পাশে যাত্রী উঠেনি তা মনে করতে পারছেনা সে।
মৃদু হাসে উদ্ভট মানবটা। ঠিক বুঝা যাচেছনা সে ভুত নাকি অন্য কিছু।
সবুজের হাতটা টেনে ধরে এবার সে। সবুজ ভয় পাচ্ছে কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। প্রথানুযায়ী, বাসে রাতে লাইট নেভানো থাকে। সেই নিয়মে বাসের লাইট অফ। কেউ দেখছেনা কাউকে।
শুধু হেড লাইটের আলোয় পথ দেখছে চালক। হাসির আওয়াজনা অস্বাবিক। কিঁঁকঁ কিঁকঁ কেঁকঁ কেঁকঁ, উদ্ভট আওয়াজ আওয়াজ করে হাসছে সে। পাশাপাশি বসে আছে তারা দু’জন। রহস্য মানবটার শরীর এতই ঠান্ডা যথারীতি শীত ধরে গেছে সবুজের।
মনে হচ্ছে তার গায়ে এক ফোটা রক্ত নেই। তার রক্তের প্রয়োজন। আসলেই রক্তের প্রয়োজন এই ভুতের। এবার সে নিজেই স্বীকার করলো। শোন, আমার শরীরের রক্ত ফুরিয়ে গেছে।
রক্ত না হলে আমি মরে যাবো। আমি মরতে চাইনা। আমার রক্ত চাই। তোকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তোর রক্ত পান করবো।
এমন অদ্ভুত কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে যায় সবুজ। কাটাতারে বেড়া ছিড়ে যেতে পারেনা কেউ, সেও পারেনা। ড্রাকুলার মতো মাড়ির দু’পাশে বড় দাত এই ভুতের। হা করা মুখটা এগিয়ে আসে সবুজের ঘারের কাছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করার চেষ্ট করে সে।
গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরের লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে চালক। সবুজকে অক্টোপাসের মতো আটকে ধরা হাতগুলো েেকন্ডর মধ্যে মিলিয়ে গেলো শূন্যে। কোন চিহ্ন নেই এখন। সবুজ শুকনো কাশি দিয়ে দাড়িয়ে পড়লো।
ধীরে সরে পড়লো নিদিষ্ট আসন ছেড়ে। চালকের দিকে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো গাড়ীর সমস্যার বিষয়ে। গাড়ীতে এখনো যাত্রীরা ঘুমে। আরো কোন সাড়া নেই। চালক এবং তার সহকর্মীরা নেমে গাড়ীর ত্রুটি সাড়ে।
ভোর ৫ টা। অন্ধকার কেটে গেছে । গাড়ী চলছে। কিছুক্ষনের মধ্যে গন্তব্য। এর মধ্যে নিজের সিটে যায়নি সবুজ।
চালকের আসনের পাশে ইঞ্জিনের ঢাকনার উপর বসে আছে সে। অজুহাত দেখিয়েছে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য সিট ছেড়ে এইখানে বসেছে।
সাডে ৬টা বাজে। কিছুক্ষন আগে সূর্য উঠেছে। গ্রামে সূর্য উঠা মানে পুরো সকাল।
বান্দবানে এখন পূর্ন সকাল। বাস থেকে নেমেছে সবুজ। কাধে একটা ব্যাগ। একটা এনজিওতে কাজ করে সে। পাহাড়ীদের জীবন মান নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কাজে এসেছে সে।
রাস্তার দু’পাশে পাহাড়ীদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পাহাড়ী পোশাক নারীদের গাড়ে জড়ানো। তবে এই মূহর্তে একটু বিশ্রামের দরকার সবুজের। এমনিতেই লম্বা জার্নি তার উপর একটা দুঃস্বপ্ন তবে পরের ঘটনাটাকে সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটাকি স্বপ্ন নাকি সত্যি।
একটা স্বপ্ন একটা সত্য নাকি দুটোই স্বপ্ন। তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সে।
রাত ১০টা। সারাদিন এনজিওর কাজ করেছে। এসাইনমেন্ট কমপ্লিট।
রাতের আহার শেষ করে হোটেলে ফিরেছে সবুজ। তার ইচ্ছে পরদিন নীলগিরি আর চিম্বুক বেড়াতে যাবে। কারন স্বর্ন মন্দির এবং মেঘলা আগের বার এসে বেড়িয়েছে। নীলগিরির যাওয়ার প্লান থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা যাবে কি যাবেনা। কারন রাতের কথা মনে পড়ে যায়।
যদি সত্যি সত্যি কিছু হয়ে যায়। পাহাড় পর্ততের বিশ্বাস নেই। সেই ধরনের ঘটনা না ঘটে অন্য কোন দূর্ঘটনাও ঘটতে পারে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম চেপে যায়। মনে হচ্ছে কেউ তার চোখ জোড় করে বন্ধ করে দিচ্ছে।
রাত ৩ টা ২৩। আগের রাতে বাসের সেই গন্ধটা আবার ভেসে আসে সবুজের নাকে। ঘুম ভাঙ্গে তার। গন্ধটার সন্ধানে এদিক সেদিক তাকায় সে। কোথাও কেউ নেই।
হোটেল কক্ষে মৃদু আলো আছে। আবারো চোখ বন্ধ করে ঘোমানোর চেষ্টা করছে সবুজ। আবার গন্ধটা নাকে লাগে তার। কিঁকঁ কিঁকঁ করে আবার হাসির সেই আওয়াজটা তার কানে ভাসে। চোখ খোলে উঠে বসে পড়ে সে।
এবার সেই রহস্য মানব সামনে তার। তবে আজ তার প্রিপারেশন ভিন্ন। বড় কালো কোর্তা পড়া চুল বড় বড়। হাতের নখগুলো কাটা চামচের মতো। ভয়ংকর কিছু একটা করার প্রস্তুতি তার।
মিটিমিটি হাসছে কিঁককিঁক করে। লাইট জ্বালাতে চায় সবুজ কিন্তু সুইচ বোর্ডটার সামনে বাকা হয়ে দাড়ানো এই প্রণিটা। সবুজ জানতে চায় কি চান ? প্রতিউত্তরে সে বলে আমি রক্ত চাই। গতকাল রাতে তোর রক্ত খেতে চেয়েছিলাম, বেঁচে গেছিস। কিন্তু আজ কি করে রক্ষাপাবি বল।
সবুজ দোয়া পড়ার চেষ্টা করছে কোন দোয়া মনে পড়ছেনা তার। চিকিৎকার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কক্ষ জুড়ে লাফালাফি করতে তারা। সবুজকে ধরার চেষ্টা করছে ভুতটা। আর সবুজ চেষ্টা করছে রুমটার দরজাটা কোন মতে খুলতে পারলে বাঁচা যাবে।
দু’জনরে ভিন্ন দু উদ্দেশ্যে লম্ফ জম্ফ চলছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।