আশা-আকাঙ্খা
আজ শুক্রবার, লঙ উইকেন্ডের শুরু। বাইরে অস্মভব সুন্দর একটা সকাল। কাল সারারাত বিছানায় শুয়েছিল রিহান। ঠিক ঘুম নয়, ঘুম আর তন্দ্রার মাঝামাঝিতে ছিল। তন্দ্রার ভাগ খানিকটা বেশি।
এটা কেন হল বলা মুশকিল।
সময়টা ডিসেম্বরের শেষ দিক। হাল্কা হাল্কা ঠাণ্ডা। বাইরে রোদ-বাতাসের ছড়াছড়ি। গাড়ির জানালা গলিয়ে বাতাসের মৃদু বা মাঝারি মিষ্টি ঝাপটা শরীরে এসে লাগছিল।
রিহান গত বিকেলে, অফিস থেকে এসেই, মুর্গি আর চিংড়ী মাছের তরকারি, রান্না করে রেখেছে। ঘরের কারপেট পরিষ্কার করেছে। লাল আর হলুদ গোলাপ ফুলদানিতে সাজিয়েছে। এত সাজসজ্জা, এক জনের জন্য, সে হল আমানা। আমানা আজ আসছে দেশ থেকে।
সিঙ্গাপুর এয়ার এ আসছে। আর মাত্র দুঘণ্টা বাকি। কিন্তু রিহানের কাছে যেন দুবছর।
এল এ এক্স এ পৌছুতে অতটা সময় লাগেনা। লস এঞ্জেলেসেই থাকে রিহান।
বোইং-এ সে ইঞ্জিনিয়ার। মাত্র আঠারো বছর বয়সে ঢাকা থেকে সে যখন আমেরিকাতে পরাশোনা করার, আর ভাগ্য ফেরানোর আশায় আসে, তখন সে ছিল ফরেন স্টুডেন্ট। ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত। যার আমেরিকার জীবন ছিল খুব কষ্টের, দিন রাত রেস্টুরেন্টে অড জব করেছ, ইউনিভারসিটির কম্পুটার লাইব্রেরিতে কাজ করেছে, বাবার কাছে অর্থনৈতিক কোন সাহায্য সে নেয়নি। অবশ্য এ জন্য শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না সে।
খেটেছে, অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়েছে শরীর থেকে। এত দিনে বলতেই হবে, সে নিজেকে সাকসেসফুল ভাবতে পারছে । ভালো চাকরি, বোইং-এ মত কোম্পানিতে। এখন রেন্টাল এপার্টমেন্টে আছে। বাড়ী কেনার কথাও ভাবছে।
বাড়ী সে আমানার সাথে পছন্দ করে কিনবে।
আমানা অসাধারণ একটি মেয়ে। রূপ লাবণ্য এর পাশা পাশই বুদ্ধির দীপ্তিতা। আমানাকে সে বিয়ে করেছে গত ডিসেম্বরে। কাগজ পত্র হতেই, এত দিন লেগে গেল।
বিয়ে করে ঢাকায় মাস খানেক ছিল রিহান। আমানাকে সে সম্পূর্ণ ভাবে ভালবাসে। পৃথিবীর সমস্ত সুখ শান্তি দিতে চায় সে তাকে। সে আমেরিকার সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখাবে আমানাকে। আগামীকাল পূর্ণিমার রাত।
রিহান ‘মালিবু মাউন্টেনের হোটেল’ বুকিং দিয়েছে। যেখান থেকে দুজনে মিলে উপভোগ করবে বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি প্যাসিফিক অসেন। প্যাসিফিকের ছোট বড় পাঁথরের উপর আছড়ে পরা টেউ। প্যাসিফিক কোস্ট হাই ওয়ে রুট ওয়ান ধরে চলে যাবে মাইল আর মাইল। এক পাশে নীল সমুদ্র আর অন্য পাশে বাদামী রঙের পাথর আর মাটির পাহাড় ।
আমানা নয়, বিয়ে করার কথা ছিল ফুফাতো বোন চামেলির বান্ধবী রুবিনা কে। কিছুতেই পরিবারের কাউকেই রাজি করাতে পারেনি রিহান, সামাজিক তারতম্যের জন্যে। রুবিনা হাল্কা পাতলা একহারা গড়নের মেয়ে। গায়ের রংটা হাল্কা শ্যামলা। তবে চোখ নাক ছবি কাটা কাটা।
রুবিনার সর্ব অবয়বে একটা আলগা দীপ্তিময় শ্রী আছে। রিহানের থেকে তিন বছরের ছোট সে। রুবিনারা থাকতো মফস্বল শহর মানিকপুরে।
রিহান তখনো টিন এজার, সবে মাত্র এ লেভেল শেষ করেছে। আমেরিকাতে আসার চেষ্টা চলছিল।
ফুপাতো ভাইএর বিয়েতে, বাবা মা যেতে পারবেন না বলে, রিহান কে একেলাই যেতে হয়ে ছিল। রুবিনার সাথে সেই প্রথম পরিচয় রিহানের।
সেই বয়সটা ছিল কোথাও কিছুতে খানিকটা মুগ্ধ হওয়ার, কিছু দেখলে দিওয়ানা হওয়ার বয়স। রুবিনাকে দেখে তেমনটাই হয়ে গিয়েছিল রিহানের। এক সপ্তাহের বেশি সময় থেকে ছিল রিহান মানিকপুরে, ফুপুর বাসায়।
সে চামেলিকে নিয়ে একবার চলে গিয়েছিল রুবিনাদের বাড়ি। রুবিনা হয়তো খুশিই হয়েছিল তাকে দেখে। সে রিহান ও চামেলিকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছিল মানিকপুরের থেকে দূরে গ্রামের বাঁশঝাড় ও হিন্দু জমিদার দালানবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। আর গিয়েছিল মেঘনা নদীর কাছে। নদীর সামনে তারা বেশ কিছুক্ষণ বসেছিল।
মেঘনার শোভা-সৌন্দর্যের ভেতর আরও ছিল কত হাজার বছরের বহমান জলধারা, বিকেলের সূর্য এর আলোয় ঝিকমিক করে উঠে ছিল যেন। এই শোভা-সৌন্দর্যের আনন্দ যেন ফুরনোর নয়।
রিহানের সঙ্গে রুবিনার দেখা হয়েছে, গত সাত বছরে মাত্র তিনবার। শেষ দেখা হয়েছিল গত বছরে, যখন রিহান দেশে গিয়েছিল, বাবা মার ঠিক করা মেয়ে আমানাকে বিয়ের করার জন্যে।
রুবিনা বি,এ পাশ করে চাকরী করছিল মানিকপুরের একটি এন জিওতে।
সে সময়, সে ঢাকাতে এসেছিল কোন কাজে। বুকের ভিতরে কেমন একটা কষ্ট, আবেগ, উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল রিহানের, রুবিনাকে শেষ বিদায় জানাতে। কান্নাকাটির মুখোমুখি হতে রিহানের খুব ভয়।
একটা, নীল তাতের শাড়ি, অলংকার হীন ভাবে এসেছিল রুবিনা, দেখা করতে বসুন্ধরা মলের একটি, রেস্তোরাতে। রুবিনা যেন, শান্তির দেবী।
স্নিগ্ধতা যেন ঘিরে ছিল তার চারপাশ।
ভিজা ভিজা চোখের পাতা টেনে, নিজেকে সংযত করে নিয়ে রুবিনা, রিহানের উদ্দেশে বলে-“আমার জন্যে ভেব না। তোমার পরিবার এবং তোমার জন্যে জা ভাল হয়, তাই কর”।
তাই করেছে রিহান। দেশে পউছে, মাত্র সাত দিনের মাথায় বিয়ে হয়েছে, আমানার সাথে।
আমানা, সুন্দরী, আদুরের দুলালী, বিজনেস মানের একটি মাত্র মেয়ে, সে কি করে সংসার করবে, আমেরিকাতে? তাই, রিহান বিয়ের আগে, আমেরিকার বাস্তব জীবন এবং রুবিনার সম্বন্ধে, খোলাখুলি আলাপ করে নিয়েছে। কোন আপত্তি নেই এসবে তার। আমানা, ইন্ডিয়া থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি করেছে। আমানা বলেছে, তার শিশুকাল থেকে একটা ই স্বপ্ন, আমেরিকাতে আসার। আমানা পি, ইচ, ডি করতে চায়, ইংরেজি সাহিত্যে।
কত আশা আকাঙ্ক্ষা। গ্রিন কার্ড, পেতেই লেগে গেল কত গুলো দিন। অবশেষে , আজ প্রতীক্ষার শেষে। আমানার সাথে রিহান শুরু করবে নূতন জীবন।
দেরঘন্টা হয়ে গেলো প্লেন ল্যান্ড করেছে ।
কিন্তু আমানা এ-লোনা কেন? কাউন্টারে গেলো রিহান। অস্থির হয়ে উঠেছে মন, তবে কি আমানা অন্য কোন গেটে হারিয়ে গেলো? অস্মভ কিছু নয়! লস এঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, আমেরিকার একটি অত্যন্ত ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। কাউন্টারের রিপ্রেজেন্টেটিভ, কম্পিউটারে চেক করেই জানালো যে, আমানা ঠিক সময় মতই ইমিগ্রেশন পাশ করেছে এবং গ্রিন কার্ড নিয়ে লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টে প্রবেশ করেছে।
চারঘন্টা ধরে এয়ারপোর্টে খোঁজা খোঁজই করে, কোথাও পেলনা আমানাকে, রিহান। দেশের বাসা থেকে ফোন আসছে বার বার।
তাছাড়া, কি জবাব দেবে সে আমানার পরিবার কে? আমানা কোথায়?
বাসায় এসে, রিহান ভাবতে থাকলো, কি করা যায়? আমানাকে কেউ ভুলিয়ে নিয়ে গেল না তো? যেমন, কোন ড্রাগ বা অপরাধী চক্র? কিন্তু আমানা ফোন করল না কেন? টেলিফোনে রিহান অনেক করে বলেছিল সে যেন কারো সেল ফোন থেকে, অন্তত একবার তার পৌঁছে যাবার খবরটা জানায়। এলোমেলো চিন্তা ভাবনা, রিহানকে অস্থির করে তুলল। না, আর এক মুহূর্তও সে অপেক্ষা করবে না। মিসিং পার্সনের জন্যে সে পুলিশের কাছে যাবে। এখনি, সে ফোন করবে পুলিশকে! ফোন করতে যাবে রিহান ওই মুহূর্তেই টেক্সট মেসেজ টা এলো।
মেসেজটাতে আছে, “আমি আমানা, আমি রবিনের কাছে এসেছি। রবিন আমার সবকিছু, তাকে চিনি ইন্ডিয়া থেকে। তাকে ভালবাসি অনেক বছর ধরে। কিন্তু সে কিছুতেই আমেরিকাতে আনতে পাড়ছিল না আমাকে। তাছারা আমার বাবা মা রাজী ছিল না।
তোমাকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন রাস্তা ছিল না আমার। সে জন্যে ধন্যবাদ তোমাকে...”
সিলভানা জেরিন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।