রোকেয়া ইসলাম কোন এক পরির কাহিনী তবে গল্প নয় একেবারে সত্যি।
পরিকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন তার বয়স ১০ কি ১১। গ্রাম থেকে শহরে এসেছে কাজের জন্য। পাশের বাড়ির শায়লাদের ওখানে উঠেছে। বড়বড় চোখ, রুক্ষ চুল, গায়ের রঙ শ্যামলা।
খুবি মায়াময় একটা চেহারা।
শায়লার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতার কারনেই ওদের ওখানে আমার যাতায়াত। অল্প দিনেই পরি ওদের বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। আপন করে নিয়েছিল আমাকেও। আমি যখনি ও বাড়ি যেতাম তখনি হাতে করে কিছু নিয়ে যেতাম।
কখনো চুলের ফিতা কখনো ছোট্ট কানের দুল কখনো চকলেট। কেমন একটা মায়া পরে গিয়েছিল মেয়েটার প্রতি। আমাকে দেখলেই দৌড়ে আসতো ও।
শায়লারা ৩ ভাই বোন। শায়লা, শান্ত, শামিম।
শায়লা ইংলিশে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রি। শান্ত ও পড়ে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে। আমার খুব ভালো লাগতো যখন দেখতাম ও খুব আদরে আছে। দেখতে দেখতে কেটে যায় প্রায় ২ বছর। পরি এখন বেশ বড় হয়ে গেছে।
অনেক সুন্দর হয়েছে দেখতে। কার কি লাগবে, কি করতে হবে, সারাদিন ব্যস্ততায় দিন কাটে ওর। কোন ক্লান্তি নেই হাসি যেন মুখে লেগেই থাকে।
বেশ কিছুদিন আমার ঐ বাড়ি যাওয়া হয়না। দেখা হয়না পরির সাথেও।
একদিন ওখানে গিয়ে পরিকে দেখে চমকে উঠি আমি।
বললাম একি অবস্থা হয়েছে তোর পরি? কিরে তোর অসুখ করেছে নাকি?
পরি কোন জবাব না দিয়ে আস্তে করে চলে গেল।
শায়লাকে জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না।
শুধু এইটুকু বললো “কদিন থেকে এই একটু জ্বর এসেছে। কিছু খেতে পারছেনা তাই হয়তো একটু রোগা রোগা লাগছে”।
আমি লক্ষ করলাম শায়লাও যেন কিছু একটা লুকাতে চাচ্ছে। কিন্তু কি তা আমি বুঝতে পারছিনা। তারপর আরও কয়েকদিন ও বাড়ি গেলাম কিন্তু পরিকে দেখতে পেলাম না। ওর কথা জিজ্ঞেস করতেই এড়িয়ে যাচ্ছে সবাই। বুঝলাম আমি ওর কথা জানতে চাই তা ওরা পছন্দ করছেনা।
এমন কি আমার সাথে ওকে দেখা করতেও দিচ্ছে না। কেন সবার এই পরিবর্তন আমি বুঝতে পারলাম না।
কয়েক মাস পরের ঘটনা। শায়লাদের বাড়িতে খুব হইচই। অনেক পুলিশ এসেছে।
দেখলাম শান্তকে হাত কড়া পরিয়ে তোলা হচ্ছে গাড়িতে। বারান্দায় দাড়িয়ে সব দেখছিলাম। ওর মা খুব কান্না করছিল। পরিস্থিতি শান্ত হতেই আমি গেলাম শায়লাদের ওখানে। তারপর যা শুনলাম তা নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
পরি হাসপাতালে এক পুত্র সন্তানের মা হয়েছে। শান্তর বাবা হাসপাতালের ডক্টর আর নার্সদের সাথে যোগসাজশে বাচ্চাটাকে সরিয়ে ফেলার চক্রান্ত করছিল। ঠিক সেই সময় হাতে নাতে ধরা পরে পুলিশের কাছে। যেভাবেই হোক পরির মা হওয়ার কথা জানতে পারে পরির বাবা এবং এমন একটা কিছু হতে পারে ভেবে আগে থেকেই খবর দিয়ে রেখেছিল থানায়। ঘটনাচক্রে সেই সময়ই তদন্ত করতে হাসপাতালে আসে পুলিশ এবং হাতানাতে ধরা পরে শান্তর বাবা জামিল সাহেব।
পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায় এবং বাচ্চাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
জামিল সাহেব থানায় সব কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। যার ফলশ্রুতিতে শান্তকে বাসা থেকে এরেস্ট করে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। অল্প বয়স আর অপুষ্টি জনিত কারনে মা হওয়ায় মা ও বাচ্চা দুজনই অসুস্থ। দুজনেরি ভাল ভাবে চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দেন থানা কতৃপক্ষ।
শায়লা যখন কেঁদে কেঁদে এসব কথা আমাকে বলছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি বলা উচিৎ বা কি করা উচিৎ। আমার মনটা অস্থির লাগছিল পরিকে দেখার জন্য।
পরির বাবা বাদি হয়ে থানায় মামলা করল। জামিল সাহেবকে ছেড়ে দিয়ে শান্তকে পাঠিয়ে দেয়া হল জেলে।
৬/৭ দিন পরের ঘটনা।
পরির বাবা, শান্তর পরিবার এবং পুলিশ প্রশাসন এই তিন এর সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হল শান্তর সাথে বিয়ে দেয়া হবে পরির। এর সাক্ষি থাকবে থানার দারোগা। লিখিত ভাবে পরিকে স্ত্রী আর পরির সন্তানের পিতৃত্ব দিতে রাজি হওয়ায় থানায় ওদের বিয়ে হয়ে যায় এবং ছেড়ে দেয়া হয় শান্তকে। পরিকে নিয়ে আসা হয় শান্তদের বাসায়।
কাহিনীটা এখানে শেষ হলেই হয়তো ভালো হতো।
কিন্তু এর পরের ঘটনা আরও করুন। শান্তর মুক্তির জন্য এই বিয়ের নাটক সাজানো হলেও পরিকে তাদের পরিবারের কেউই মেনে নিতে পারেনি। পরিকে দেখে এখন আর কারো বোঝার উপায় নেই এই সেই চঞ্চলা, চপলা, উচ্ছল পরি। পরি ও তার বাচ্চার স্থান হয় রান্না ঘরের মেঝেতে। অপুস্টি আর অযত্নের কারনে মা ও বাচ্চা দুজনি খুব অসুস্থ।
জন্ম থেকেই রোগা বাচ্চাটার জন্ডিস। গায়েও অনেক জ্বর। লোক দেখানো ডাক্তার দেখানো হয়েছে বাচ্চাটার জন্য। ক্ষুদার কারনে বাচ্চাটা সারাদিন কেঁদেই চলেছে। তাছাড়া পরি নিজেই একটা বাচ্চা মেয়ে সে কি করে বুঝবে কি ভাবে একটা বাচ্চার যত্ন নিতে হয়।
এই ভাবেই বেঁচে থেকে ২২ দিনের মাথায় জন্ডিস এবং জ্বরের কারনে মারা যায় পরির ছেলেটি।
কয়েকদিন কান্নাকাটির পর শান্ত হয়ে যায় পরি। যেখানে মাতৃত্বের স্বাদ বোঝার মত বয়সই তার হয়নি এবং যেখানে তার নিজেরই বেঁচে থাকা অনিশ্চিত সেখানে জন্ম থেকে রোগা একটা বাচ্চার মৃত্যু শোক খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠে সে।
আর ২ মাস পরের ঘটনা। এক রাতে এ্যাম্বুলেন্সের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার।
তাড়াতাড়ি বারান্দায় এসে দাড়াতেই দেখি ট্রেচারে করে এনে এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে পরিকে। এ্যাম্বুলেন্সটা তাকে নিয়ে চলে গেল।
কি হল কিছুই বুঝতে পারছিনা। অপেক্ষা করতে লাগলাম ভোরের। চোখের সামনে ভেসে উঠছে শান্ত, স্নিগ্ধ মায়ায় ভরা একটা মুখ।
নিস্পাপ হাসি। আমার দুচোখ বেয়ে নেমে আসলো কান্নার বন্যা। নিজেকে খুবই অপরাধি মনে হচ্ছে। অথচ কিইবা করার ছিল আমার। যেখানে ওর বাবা, পুলিশ প্রশাসন এবং তার মালিক সবাই জড়িত সেখানে আমি বা আমার কথা কখনোই কোন গ্রহন যোগ্যতা পেত না।
পরদিন দুপুর ১ টায় এ্যাম্বুলেন্সে করে আবার ফিরে এলো পরি তবে সেই চঞ্চলা, চপলা জীবন্ত পরি নয় চির নিদ্রায় শায়িত পরি। ডাক্তারের ভাষ্য মতে অতিরিক্ত জন্ডিস আর লিভার সিরোসিসে মারা যায় পরি।
কল্পকাহিনীর কল্পলোকের পরি নয় মাটির ধরার এক সত্যি পরির কাহিনী এভাবেই শেষ হয়। এই সমাজে এমন হাজার পরি আছে যারা ভদ্র বেশি মানুশ রূপী পশুর হাতে প্রতিনিয়ত প্রান দিচ্ছে আমরা তার কতজনেরই বা খবর জানি। এই পরিরা তো আমাদেরই কারো মেয়ে, কারো বোন তবে কেন পরিরা এমন করে গল্প হয়ে যায়? কেন পরিরা আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত বাঁচতে পারেনা? জানি এর উত্তর হয়তো আমারি মত কারো জানা নাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।