আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চার বন্ধু স্বপ্নের আমেরিকায়।

বোরহান উদ্দিন আহমেদ (মাসুম) পিন্টু দ্রুত দৌড়াচ্ছে। তাকে যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড়াতে হবে। কারন সে ম্যানহাট্‌নে ফুড ডেলিভারীর কাজ করে। যত বেশী ডেলিভারী দিতে পারবে, তত বেশী টিপস্‌। টিপস্‌ হল ডেলিভারী চাকুরীর প্রধান আয়।

আর এই আয়ের জন্যই সোনার হরিণের এই দেশে আসা ও সবাইকে নিজ দেশে ফেলে এখানে পড়ে থাকা। পিন্টু আমেরিকায় এসেছে প্রায় বছর চারেক হল। আসার পরই ডেলিভারী কাজে ঢুকেছে। তারপর অনেক কাজ বদল করেছে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত আবার ডেলিভারী কাজেই ফিরে এসেছে।

আমেরিকায় সব রকম অড্‌জবের মধ্যে ডেলিভারী ও ইয়োলো ক্যাব চালানোতে সবচেয়ে বেশী ইন্‌কাম। পিন্টুর দরকার টাকা। তাই সে এটাই করছে। ডেলিভারী কাজে বেতন খুব কম হলেও টিপ্‌স থেকে প্রচূর আয় হয়। প্রথম দিকে টিপ্‌স নিতে খুব খারাপ লাগত কারন সে ছিল বাংলাদেশে রসায়নে স্নাতোকোত্তর।

এখানে এসে চেষ্টা করেছিল নিজ পেশায় কিছু করতে। সার্টিফিকেট মূল্যায়নও করেছিল। কিন্ত কাজ হল না। তার তো সিভিল বা ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মত টেকনিক্যাল কোন ডিগ্রী নাই। কম্পিউটার বিদ্যাও টাইপিং পর্যন্তই।

তাই কিছু হল না। তাকে আবার একটা উচ্চতর ডিগ্রী নিতে হবে যেখানে দরকার প্রচূর অর্থের এবং সময়ের। তার কাছে তখন সেই সময় বা অর্থ কোনটাই ছিল না বা এখনও নাই। তাকে বরং দেশে অর্থ পাঠাতে হয় সংসার চালানোর জন্য। দেশে আছে ছোট দুই ভাই ও দু’বোন।

, এক বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বাকী সবাই পড়াশোনায় আছে, বাবা গত হয়েছে বছর দুই হল, তাই সংসারের দায়িত্বটা এখন তার উপর। পিন্টু কাজটা এখন ভালই উপভোগ করে। ডেলিভারী নিয়ে সুন্দর, সুন্দর আফিসে ঢুকে, ভেতরটা দেখতে পারে, মাঝে মাঝে অত্যধিক রকমের ভালো কিছু আমেরিকানের প্রশংসা বাক্য শুনে। মাঝে মাঝে পিন্টুর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় যখন কোন ডেলিভারীতে তাকে আলাদা সার্ভিস পথ দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার মাঝে মাঝে এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে, যদি এই অফিসে একদিন চাকুরী করতে পারতাম।

পিন্টুর ভালো অফিসিয়ালী একটা চাকুরী করার কথা ছিল। দেশে থাকলে তাই হত কারন তার পরীক্ষার ফলাফল বরাবর ভালোই ছিল। কিন্ত তা হয়নি। ভাগ্যের কাছে সে বন্দী হয়ে অনেক উপার্জন করছে ঠিকই কিন্ত মানসিক শান্তি পাচ্ছে না। সাতটা প্যাকেট ডেলিভারী দেবার পর রেষ্টুরেন্টে ফিরছে আরে এসব ভাবছে।

নাহ্‌, আজ আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। আজ সে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাবে। ২ --পিন্টু, কি অইলো তোর আজ? তুই তো কখোনো এত মাল টানিস না ! সফিক একবার সবার দিকে ও পরে পিন্টুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। সফিকের কথাটা শুনেই পিন্টুর মেজাজটা খিচ্‌ড়ে গেল। পিন্টু, সফিক, আলতাফ ও নাশির – ওরা চার বন্ধু।

বন্ধুত্ব হয়েছে আমেরিকায় আসার পর। এর মধ্যে আলতাফ তার রুমমেট্‌। বাকী দুজন এসেছে পার্টিতে যোগদান করতে। --শালা, আমার ইচ্ছে হইসে আমি মাল টানি। তাতে কার বাপের কী? আমি আরো মাল টানমু আজ।

কথাগুলো বলেই পিন্টু বাড্‌উইজার-এর আরেকটি বোতল খুলে ফেল্‌ল। ওরা চারজন অনেক রকম দুষ্টামী করে, নিজেরা তুই-তোকারী করে কথা বলে, আবার গালাগালিও করে। কিন্ত পিণ্টুর মেজাজটা আজ একটু খারাপ। আলতাফ টাকিলার আরো চারটা শর্ট রেডী করে পিন্টুর পক্ষে বলল, --ঠিক কইছস্‌ পিন্টু, আজ মন ভইরা মাল টান্‌মু। দরকার পড়লে হুকারও কল্‌ করমু।

এতগুলি বছর হইল এই ফাকেন্‌ দেশে পইড়া আছি কিন্ত কোন মজা নাই। খালি কামলা খাটতাছি আর পয়সা কামাইতেছি। ---ডু হোয়াটএভার ইউ ফাকেন গাইস্‌ ওয়ানা ডু , ম্যান। উই ডোন্ট কেয়ার এনি ফাকেন থিংস্‌ --বলেই নাশির টাকিলার শর্টটা শেষ করল। -- কাম ডাউন গাইস, কাম ডাউন – বলে পিন্টু পরিবেশটা আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা করল।

সারারাত ধরে মদ্যপান করে ভোর ৪টার দিকে এক এক করে ঘুমিয়ে পড়ল। ৩ কাকডাকা ভোরে উঠে সফিক কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। কাকডাকা বললে ভুল হবে কারন নিউইয়র্ক সিটিতে কাক দেখা যায় না। ভোর ৬ টার মধ্যে তাকে কাজে পৌছাতে হবে। এস্টোরিয়া থেকে ব্রুকলীন যেতে সময় লাগে ১ ঘন্টা।

প্রতিদিন ট্রেন-এ এইসময়টা সে ঘুমিয়ে নেয়। আজ ঘুম আসছে না। গত রাতের আগের রাতে মদ্যপানের রেশ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। তাই ট্রেন-এ বসে সফিক বিগত দিনগুলির ভাবনায় চলে গেল। দেশে থাকতে কখনো দশটা’র আগে ঘুম থেকে উঠেনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ফেলেছে কিন্ত স্কুল জীবনের পর থেকে তার প্রতিদিনের নির্ধারিত ঘুম ছিল সকাল দশটা পর্যন্ত। দেশে তাদের অবস্থা অনেক ভালো না থাকলেও অসচ্ছল ছিল না। একদিন ডাকপিয়নের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত একটি চিঠি (ডিভি)-র হাত ধরে তার আমেরিকায় আগমন। তারপর ৬টি বছর কেটে গিয়েছে এখানে। এর মধ্যে একবার দেশে গিয়েছিল ।

এখানে একটি রেস্টুরেন্টে সে কাজ করে। রেস্টুরেন্টে কাজের শিফ্‌ট গুলোকে বিভিন্ন বেলার খাবার নামে ডাকা হয়। সপ্তাহে ৩দিন সে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ করে আর বাকী ৩দিন ডাবল্‌ মানে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, এবং ডিনার্‌। সফিক এই রেস্টুরেন্টে বাস বয় হিসেবে ঢুকেছিল। আমেরিকায় আসার পর বাঙ্গালী বড় ভাইয়েরা উপদেশ দিয়েছিল রেস্টুরেন্ট অথবা ইয়োলো ক্যাব-এ ঢুকার জন্য।

এখানেই নাকি সব পয়সা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না, তাই রেস্টুরেন্টে বাস বয় হিসেবে তার আমেরিকায় কর্ম জীবনের শুরু। এভাবে তিনটি বছর কেটে গিয়েছে পরবর্তী এক বছর ফুড্‌ রানার-এ পদোন্নতি, তারপর ওয়েটার। হায়রে আমেরিকা ! ব্যাংক বা কোন কর্পোরেট অফিসে পদোন্নতি নয়, রেস্টুরেন্টে পদোন্নতি। খারাপ নয়, কী-ই বা তার করার ছিল।

ম্যানেজমেন্ট-এ ডিগ্রী দিয়ে এই দেশে কী করবে? টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকলে না হয় অন্য কিছু ভাবত। ঘোষিকার সুরেলা কন্ঠে চার্চ এভিনিউতে আসার উচ্চারনে বাস্তব জগতে ফিরে আসল সফিক। আরো একটি কামলা দিনের শুরু। ৪ সারাদিন ঘুমিয়ে ৩ টার দিকে নাশির বাসায় চলে গেল। কারন রাতের শিফ্‌টে সে ইয়োলো ক্যাব চালায়।

তার পার্টনার চালায় দিনের শিফ্‌টে। নাশির আমেরিকায় এসেছে অনেক বছর হয়ে গিয়েছে। দেশে থাকাকালীন পাসপোর্টে অনেক গুলি দেশে ভ্রমনের সীল্‌ লাগানোর পর সে আমেরিকার এম্ব্যাসীতে দাড়িয়েছিল টুরিস্ট ভিসার জন্য। ভাগ্যক্রমে সে ভিসা পেয়ে যায়। সে প্রায় বছর দশেক আগের কথা ।

তারপর জীবনের অনেকগুলি বছর আমেরিকায় কেটে গেল। দেশে ফেরার কথা ভেবেছে অনেক বার। রাজনৈতিক আশ্রয়ে গ্রীন কার্ড পাবার আগে তার দেশে যাবার উপায় ছিল না কারন দেশে ফিরে গেলে আর আসার সুযোগ নাই। আর গ্রীন কার্ড হবার পর দেশে ফেরার আগ্রহ চলে গেল। বলা হয় আমেরিকা নাকি ওয়ান-ওয়ে কান্ট্রি।

এই ওয়ান-ওয়ে কান্ট্রি কথাটি নাশিরের জীবনে সত্যি হয়ে গেল। ক্যাব চালিয়ে তার আয়-রোজগার বেশ ভালো। বন্ধুরা তাকে ক্ষেপায়, ইয়োলো ক্যাবের চাকা ঘুরলেই নাকি পয়সা। আয় ভালো হলেও কাজটি কিন্ত মোটেই সহজ নয়। অমনোযোগী হলেই “চাও” মানে মৃত্যু অবধারিত।

মাঝে মাঝে তাকে প্যাসেঞ্জারের ব্যাগ এপার্টমেন্টে তুলে দিতে হয়। কাজটি বাধ্যতামুলক নয় , তবুও তাকে মাঝে মাঝে এটা করতে হয়। বন্ধুরা যে বলে ইয়োলো ক্যাব হলো আমেরিকায় রিক্সা চালানো—কথাটি মিথ্যা নয়। ঢাকা সিটি কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করার পর নাশিরের ইচ্ছা ছিল “কস্ট এক্যাউন্টেন্ট” হওয়া। এজন্য সে আইসিএমএ-তে ভর্তিও হয়েছিল।

কিন্ত আমেরিকায় আসার ভুত মাথায় চেপে যাবার পর সব বাদ দিয়ে সোনার হরিণের দেশ আমেরিকায় চলে এল। সে এখন একজন ক্যাবী। তার “কস্ট একাউন্টেন্ট” হবার স্বাদ হারিয়ে গেল, তাকে এখন সবাই বলে ক্যাবী। ৫ আমাদের গল্পের শেষ নায়ক আলতাফ। আলতাফ ছিল খুবই ভাগ্যবান।

কারন সে আমেরিকায় এসেছিল পূর্ণতা নিয়ে অর্থাৎ সে এসেছিল তার স্ত্রী শিলাকে সাথে নিয়ে। দেশে পড়াশুনা শেষ করেই সে একটি বায়িং হাউসে চাকুরী পেয়ে যায়। আর চাকুরী পাবার বছর দুই পরেই শিলার সাথে বিয়ে। বিয়েটা ছিল বাবা-মায়ের পছন্দে। শিলা ছিল রূপবতী, শিক্ষিতা একটি মেয়ে।

তাই আলতাফ সুখেই ছিল। তার সুখ আরো বৃদ্ধি পেল যখন বিয়ের দ্বিতীয় বছরের মাথায় ডিভি পেয়ে গেল। আত্মীয় স্বজন সবাই বলল, আলতাফের বউ ভাগ্য নাকি খুবই ভালো। শিলাকে সাথে নিয়ে আলতাফ যথাসময়ে নিউইয়র্ক এল। উঠেছিল দুরের সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায়।

তারপর যথারীতি কাজ খোজা। একটা সিকিউরিটি জব পেয়েও গেল। কিন্ত কাজটি ছিল সপ্তাহে তিন্ দিন নাইট শিফ্‌ট আর বাকী তিন দিন ডে শিফ্‌ট। দুজনে একটা এক বেডরুমের বাসাও নিল সানিসাইডে। কিন্ত শুধুমাত্র আলতাফের আয়ে বাসা ভাড়া , ইউটিলিটি বিল, খাওয়া ও অন্যান্য খরচ চালানো খুবই কস্টের।

তাই বাধ্য হয়ে শিলাকেও একটি চাকুরী নিতে হল। নিউইয়র্কে তারা একটা ছোটখাট ছিমছাম সংসার শুরু হলেও বেশি দূর এগুতে পারলো না। চাকুরীতে অতৃপ্তি, পরস্পরকে সময় না দেয়ার অভিযোগ, বাসার কাজে শিলাকে সাহায্য না করার অভিযোগ – এসব খুটিনাটি ঝগড়া ওদের মধ্যে লেগেই থাকত। মাঝে মাঝে ঝগড়াটা বড় পর্যায়ে চলে যেত। ধীরে ধীরে অপূর্ন স্বাদগুলিও ঝগড়ায় স্থান পেতে লাগল যেমন তাদের একটা গাড়ী না থাকা, কিংবা বাসায় পর্যাপ্ত আসবাপপত্র না থাকা, কিংবা আদৌ তাদের একটা বাড়ী কখনো কেনা হবে কিনা! তিক্ততা থেকে দুরত্ব, দুরত্ব থেকে অন্য কোনদিকে আকর্ষণ।

আমেরিকায় আসার দেড় বছরের মাথায় আলতাফ শিলাকে হারিয়ে ফেলল। আরো বেশি কিছু বিলাসিতা, একটি নিরাপদ জীবন ও আলতাফের প্রতি হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে নুতন করে খুজে পাবার আসায় শিলা একদিন ফুয়াদের হাত ধরে চলে গেল। জীবন কখনো থেমে থাকে না। আলতাফের জীবনও থেমে নেই। বন্ধুদের সাথে আড্ডার পরে আরো একটি কর্মব্যস্ত দিনের শুরু।

এই হল চার বন্ধু। প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং ডিগ্রীধারী। দেশের অনিশ্চিত, অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশ ত্যাগ করে আমেরিকা চলে এসেছে নিজেদের চমৎকার ভবিষ্যত গঠনের আশায়। এদের মত আরো অনেকেই এসেছে। কারো এখানে থাকা এবং কাজ করার বৈধ কাগজ আছে, কারো নাই।

কিন্তু কারো জীবন থেমে নেই ! এর আগে আমার এই সাইটে প্রকাশিত।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।