শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীর ভীতরে বসেও কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট বুঝতে পারছি। ড্রাইভার কে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বললাম, এ সি টা আর একটু বাড়িয়ে দাও, রকি।
ড্রাইভারের ভাবলেশ উত্তর, এর বেশি বাড়ালে ইঞ্জিন ওভার হিট হয়ে যেতে পারে, ইঞ্জিনের অবস্থাতো ভালো না স্যার, আর এ সির গ্যাস কমে গেছে বোধ হয়।
মুখে কোন কথা না বল্লেও, মনে মনে বলি, এ সির আবার গ্যাস কোথায় পাইলি রে গাধা, বল রেফ্রিজারেন্ট।
বনানী অফিস থেকে যাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মহাখালীর জ্যাম ঠেলে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে আর ঠেলে ঠুলে এগুতে পারছি না। ট্র্যাফিক কোন অবস্থাতেই সিগন্যাল দিচ্ছে না। বোধ হয় কোন ভিভিআইপি !
হঠাৎ ফোনের রিংটোনে উত্তেজনা বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
---হ্যালো, কোথায় তুই এখন?
--একটু ওয়েট কর দোস্ত, জ্যামে আটকে আছিরে।
ফোনটা কেটে দিয়ে কল্পনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি।
আজ প্রায় একযুগ পর শাওনের সাথে দেখা হতে যাচ্ছে, ফেসবুকের কল্যাণে। গাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই, পিতলে বাঁধাই করে লেখা “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়” লেখাটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই মুহূর্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের সব অপরাধ ভুলে গিয়ে, একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে, ডিজিটাল (এই মুহূর্তে আমার কাছে ডিজিটাল মানে ফেসবুক) শব্দটাকে এতটা নাগালে নিয়ে আসার জন্য।
শাওন, আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত এক সাথে পড়েছি, তারপর ওর বাবার Transfer হয়ে যাবার পর আর কোন যোগাযোগ রাখতে পারি নাই।
ফেসবুকে হাজারবার ওর নাম লিখে সার্চ দিয়েছি, হাজার শাওনের ভিড়ে আমার ছেলেবেলার বন্ধু শাওনকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে গত পরশু পেয়েছি। তারপর থেকে অনেক বেশি উত্তেজিত আমি, এতদিনে শাওন কেমন হয়েছে?
টি এস সিতে তিনটার সময় পৌঁছানোর কথা থাকলেও, পৌঁছুলাম বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। শাওনের সাথে ফোনালাপ করে জেনে নিলাম, ও শহীদ মিনারে বসে আছে।
শহীদ মিনারের ডান পাশে যেয়ে বসলাম দুইজন।
এতগুলো বছর পেরিয়ে গিয়েছে, গল্প কি আর কম জমেছে! একে একে অনেক কথায় হল।
শহীদ মিনারের লাল বৃত্তটিকে অস্তমিত সূর্যের মত টুকটুকে লাল মনে হচ্ছে। শহীদ মিনার থেকে চোখ সরিয়ে, শাওন কে জিজ্ঞাস করিঃ তোর কি মনে আছে, তুই প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারির সময় ফজরের আজানের আগে আমাদের বাসায় এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতি? তারপর দুই জন বের হতাম জেরিন আপুদের ফুলের বাগান থেকে ফুল চুরি করতে!
---মনে থাকবে না কেন? ঐ ফুলগুলো দিয়ে মালা গেথে, প্রায় তিন মাইল পথ খালী পায়ে হেটে প্রভাত ফেরীতে যেতাম শহীদ মিনারে, ফুল দিতে। আর একবার তো, শহীদ মিনারে যেয়ে জেরিন আপুর হাতে ধরা খেলাম। আমার এখনো লজ্জা লাগেরে!
---জানিস, জেরিন আপু বাচ্চা প্রসব করতে যেয়ে মারা গিয়েছেন।
---কি বলিস? ইশ, অনেক ভালো মানুষ ছিল। বাবা যেইবার transfer হলেন সেবার, উনি কথা দিয়েছিলেন, পাড়ায় শহীদ মিনার বানালে যত ফুল লাগবে তা তিনি ওনার বাগান থেকে তুলে দিবেন।
---হুম, তোরা চলে যাবার পর, আমরা সবাই মিলে শহীদ মিনার বানিয়েছিলাম। ওই খানে এখন বেশ বড়সড় একটা শহীদ মিনার উঠেছে, “শপ্ত গ্রাম নারী স্বনির্ভর পরিষদ” নামের একটা এনজিও এর অর্থায়নে। আচ্ছা ভালো কথা, তোর তো এতদিনে মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবার কথা? আর কোন সাবজেক্ট এ পড়ছিস, কিছুই তো জানা হল না!
আমার প্রশ্নে শাওনের চোখ মুখের স্পষ্ট পরিবর্তন দেখতে পেলাম।
ও এদিক সেদিক বলে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলঃ এইটা কি তোর নিজের গাড়ি?
---হাহাহাহা! কি বলিস, গাড়ি কেনার টাকা পাব কোথায়? অফিসের গাড়ি। আমার প্রশ্নের জবাব দিলিনা শাওন? কোন সাবজেক্ট এ মাস্টার্স করছিস?
শাওন আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে, শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে বল্লঃ উর্দু। উর্দু সাহিত্য!!!
---মজা করছিস? উর্দু নামের কোন সাবজেক্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটেই থাকতে পারে না।
---তোর সাথে মজা নেব কেন মামুন, আমি আসলেই উর্দুতে পড়ি। আমার মত প্রতি বছর অসংখ্য ছাত্র উর্দুতে মাস্টার্স করে বের হয়।
“ কোন সাবজেক্ট এ পড়?” এই প্রস্ন করলে আমার মত প্রায় সকলেই হয় মিথ্যে করে আর্টসের কোন সাবজেক্টের নাম বলে না হয় বলে “ ভাষা ভিজ্ঞান”।
এই কথা শোনার পর কি বলতে হবে, আমার মাথায় আসছে না। যেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দুর বদলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীর বীজ বোপিত হয়েছিল, সেইখানে কিনা এখনো উর্দু ডাল পালা মেলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে? এতগুলো প্রভাত ফেরি গেলো, এতগুলো ২১শে ফেব্রুয়ারি, এতগুলো তাজা প্রাণ, সারা পৃথিবী যাকে(বাংলা) আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দিতে যেয়ে উর্দুর কথা স্মরণ করে একটিবারের জন্যও থুথু ফেলেছে, আমরা সেই থুথু এখনো চেটে পুটে খাচ্ছি?
আমি শাওন কে প্রশ্ন করিঃ তুই জেনে শুনে কেন উর্দুতে ভর্তি হলি?
---দেখ! বাবা মা চাইছিল, যেকন ভাবে হোক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে(উর্দুতে) চান্স হবার পর, আমার কোন কথায় শুনতে চাইলো না। এক প্রকার ইচ্ছের বাইরে যেয়ে ভর্তি হলাম।
আর আমি নিজেও জানতাম, বাবা কেন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে এতটা আগ্রহী ছিলেন, কারণ প্রাইভেটে পড়ানোর মত টাকা তার নাই।
আমি একে একে প্রশ্নবাণে শাওনকে জর্জরিত করলামঃ কেমন লাগে উর্দু পড়তে?
--গাধা যেমন মুলার লোভে বন্ধুর পথ অতি আনন্দ নিয়ে পাড়ি দেয়, আমারও একই আনন্দ লাগে। মুলা তো পাব!!! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা !!!!
শাওনের সাথে আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। পরের সপ্তাহে আবার দেখা হবে, এই কথা বলে।
বাসায় এসে, INTERNET এর কল্যাণে “উর্দু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারলাম।
এতটা অবাক সর্বশেষ কবে হয়েছি, মনে করতে পারছি না। যেই ভাষা নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল সেই ভাষা আমাদের দেশের সব চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান হয়, এইটা কীভাবে সম্ভব?? সেদিন শাওন কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশায় বুক বেঁধে তারা এক পর্যায়ে আন্দোলন গোড়ে তোলে, তাদের এই সাবজেক্টটাকে বাতিল করতে। কোন এক অজানা কারনে, আওয়ামীলীগ পন্থী শিক্ষকেরাই নাকি, তার ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দেয়। একে একে আন্দোলনকারী ছাত্ররা পিছু ফিরে যায়। যার কারনে, শাওনের কিছুটা দিন বেশি লেগেছে এই মহামূল্যবান সাবজেক্ট থেকে মাস্টার্স করতে।
চলুন এবার দেখে নেয়া যাক, আমাদের শরীরে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) উর্দু কীভাবে এবং কখন ঢুকেছে
১৯২১ সালে ডিপার্টমেন্ট অফ উর্দু এবং পার্সিয়ান এর সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালে উর্দু কে বিএ(অঃ) এবং ১৯৪৯ সালে এমএ (মাস্টার্স) হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে এইটাকে একটা পৃথক ডিপার্টমেন্ট হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
উর্দু ডিপার্টমেন্ট এ দুইজন পাকিস্থানি ব্যাক্তিত্বের নামানুসারে গোল্ড ম্যাডেল দেওয়া হয়ঃ
১) ইকবাল গোল্ড ম্যাডেল
২) ডঃ এ এস নুরুদ্দিন গোল্ড ম্যাডেল
উর্দু ডিপার্টমেন্টে যেসব স্কলারশিপ দেয়া হয় তার প্রায় সবই পাকিস্থানি সরকারের পক্ষ থেকে (আমার মতে পাকিস্থানের কাছ থেকে ভিক্ষা ছাড়া আর কিছুই না)।
উর্দু ডিপার্টমেন্ট এর প্রোফেসররা প্রায়ই পাকিস্থানের পাক মাটিতে চুম্বন দিতে যান।
পাকিস্থান সরকারের কোন ঘরোয়া টাইপের অনুষ্ঠানেও তারা দাওায়ত পান।
বেশ কিছুদিন আগে, উর্দু বিভাগের প্রোফেসর ডঃ কুলসুম আবুল (বাংলাদেশের চার নং আবুল) বাশার , দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক উর্দু কনফারেন্স, করাচিতে যেয়ে বলেনঃ উর্দু একটি সুন্দর এবং মিষ্টি ভাষা, বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার পর, ধারণা করা হত এই ভাষার নিঃশেষ ঘটবে কিন্তু ঘটে নাই। এই ভাষার মিষ্টতার কারনে মাতৃ ভাষা বাংলা হবার পরো, এই ভাষাতে পাঠ্যদানে আমি আনন্দ খুঁজে পাই। (রেফারেন্সঃhttp://sindhstudy.com/node/1323)
করাচী বিশ্ববিদ্যালয় এর (KU) উর্দু ডিপার্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান ডঃ জাফর ইকবাল ঐ একই প্রোগ্রামে বলেনঃ বাংলাদেশে উর্দু ভাষার ধারক হচ্ছে, আটকে পড়া পাকিস্থানিরা ( বিহারি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ডিপার্টমেন্ট।
গত ১৭ অক্টবার, ২০১২ তারিখে, পাকিস্থানি হাই কমিশনারের পক্ষ থেকে এক জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উর্দু ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কাছে কিছু কম্পিউটার তুলে দেন।
আমরা আর কতভাবে এই দেশটাকে, দেশের মানুষের অনুভূতিকে খাট করে দেখব। উর্দু ডিপার্টমেন্টের সুযোগ্য চেয়ারম্যানকে বলিঃ এই কয়টা কম্পিউটার কি কেনার মত ফাণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাই? কেন হাত পাততে গেলেন?
ফেসবুকে একটা পেজ আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ডিপার্টমেন্টের উপরে বেইজ করে, যেখানে বাংলারদু ভাষায় কথোপকথন দেখলে, আপনার রাগে দুঃখে হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। (রেফারেন্সঃhttp://www.facebook.com/pages/DEPT-OF-URDU-LITERATURE-IN-DHAKA-UNIVERSITY/315151271276)
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে, পাকিস্থানিদের জাতীয় নায়িকা (হেনা) কয়েক ঘণ্টার ঝটিকা অভিজানে এসেছিলেন, আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে। আমরা যেই বললাম, তোমাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য একটু সরি বল, তাহলে তিরিশ লক্ষ ভাই বোনের বিদেহী আত্মা একটু হলেও শান্তি পাবে, ওমনি কপালের সামনে চলে আসা চুলগুলো এক ঝাঁকিতে সরিয়ে নিয়ে নায়িকা বল্লেন, ওসব পুরান কথা ছাড়, সরি-টরি নিকুচি করি, পারতো কাঁটা ঘায়ে শিলাই মার, না হয় কষ্টেপ।
আমার মনে হয় সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু ডিপার্টমেন্টের বিলুপ্তি ঘটবে।
এখন যারা দেখেও না দেখার খেলায় মেতে উঠেছে, তারা একদিন বলবে, ইশ, কেন যে আমরা শুরু করলাম না? নতুন প্রজন্ম সেদিন ঠিকই আঙ্গুল দেখিয়ে ঠাটটার হাসি হাসবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।