আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীল চাদরে ঢাকা (পর্ব১)

আমি খুব সাধারণ একজন। আমার অবুঝ মন। কি যেন চায় সারাক্ষণ। কখনো পায়,কখনো পায় না। ।

পাত্রপক্ষ এসে শিমুকে দেখে গেছে। বলে গেছে মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। খুব শিঘ্ররই তারা বিয়ের দিনক্ষণ জানিয়ে দেবেন। কিনত্দু শিমুর এবিয়েতে মত নেই,তাই সে মাকে গিয়ে বলল,তোমরা সবাই এখনই ক্যান আমার বিয়ে দেবার জন্য উইঠা পড়ে লাগছ? রহিমা মেয়ের কথা শুনে অবাক হলেন। বললেন,সেকিরে কথা!মেয়ে বড় হইলে মেয়ের বিয়ে দেয়া বাবামার কর্তব্য,উইঠা পড়ে লাগা বলছিস ক্যান? আমি কি তোমাদের কাছে অনেক বড় হয়া গেছি নাকি বেশি হয়া গেছি যে তোমরা এখনই আমারে বিদায় করতে চাইছ? তোর সমস্যাটা কি? সমস্যা কিছুনা।

আমি এখন বিয়ে করব না। আমি এখন পড়ব। পড়বি পড়,তাতে সমস্যা কি,বিয়ের পর কি ল্যাখাপড়া করা যায়না নাকি?এ্যা?আমিতো তোর বাবার সাখে বিয়ের পরই মেট্টিক পাস করলাম। আহা মা বুঝতেছনা ক্যান?তোমাদের সময় আর আমাদের সময় আলাদা। তাছাড়া আমার আরো সমস্যা আছে।

একটা জিনিস জোর কইরা আমার উপরে চাপায়া পারনা, মা? শিমু চড়া গলায় কথা বলছে। রহিমা ভেতরে উতলা হলেন। শিমু বলল,আমার কি ব্যক্তিস্বাধীণতা বলতে কিছু থাকতে পারেনা,নাকি? তোর সেই ব্যক্তিস্বাধীণতাটা কি খুইলা বল আমারে। শিমু মাথা নিচু করে বলল,মা আমি একটি ছেলেকে পছন্দ করি। আমি ওরে কথা দিছি মা।

রহিমা মেয়ের কথা শুনে আতকে উঠে দাতে জিভ কাটলেন। বললেন,চুপ,চুপ এই কথা আর বলিস না তোর বাপ শুনতে পাইলে একদম মাইরা ফেলবেন। শিমু কাদো গলায় বলল,তুমি একটু বাবাকে বোঝাও মা। তোমরা এমুন কইরা একটা জিনিস আমার উপরে চাপায়া দিতে পারনা মা। রহিমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলে বিলি কেটে বললেন,তুই আমারে আগে বলস নাই ক্যান?এখন অস্থীর হইসনা দেখি কি করা যায়।

রাতের বেলা শোয়ার সময় স্বামীর কাছে কথাটা পাড়লেন রহিমা। বললেন,অনুমতি পাইলে একখানা কথা বলতাম্ আনোয়ার হোসেন সত্দ্্রীর দিকে মিটমিট করে তাকালেন। বললেন,১০খানা কথা বলার অনুমতি দিলাম। কথাটা কিনত্দু সিরিয়াস শুইনা কিন্তু রাগতে পারবা না। বিবেচনা কইরা দেখবা।

আচ্ছা ঠিক আছে বল। শিমুর এবিয়েতে মত নাই। মত নাই মানে কি? মত নেই মানে ও এখন পড়ালেখা করতে চাইতেছে। পড়ালেখাতো করবেই। বিয়ের পর কি পড়া লেখা করা যায়না,নাকি? তারপরও মেয়েটার মন তুমি বুঝবা না? আনোয়ার হোসেন বিরক্ত হলেন,মন কি বুঝব এ্যা?অযথা ঘ্যানর ঘ্যানর করতেছ।

তুমি চাওনা মেয়ের ভাল যায়গায় বিয়ে হউক,মেয়ে সুখে থাকুক। চাইতো। তাহলে বোঝনা কেন?আরে সবসময় কি এমন ভাল সম্বন্ধ হাতে পাওয়া যায়নাকি,এ্যা? রহিমা চুপসে গেলেন। ৰণিক থেমে আনোয়ার হোসেন আবার বললেন,আর শোন মেয়েরা বিয়ের সময় এমন একটু আধটু করেই এ নিয়া ব্যসত্দ হইবার কিছু নাই,চিনত্দার ও কিছু নাই। তুমি আমারে আর একটা পান দাওতো,তারপর মেয়েটারে পাঠায়া দাও দেখি কি হইছে।

আনোয়ার হোসেন বালিশে হেলান দিয়ে ডান পায়ের উপরে বাম পা তুলে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে পান চিবুতে লাগলেন। কিছুৰণ পরে শিমু এসে বিনিত ভঙ্গিতে দাড়াল তার সামনে। আনোয়ার হোসেন হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বললেন পাসে। শিমু বসল। আনোয়ার হোসেন বললেন,কি বলেছিস তোর মাকে? বাবা একটা সমস্যা হইছে।

শিমু সব ঘটনা তার বাবার কাছে খুলে বলল। সব শুনে আনোয়ার হোসেন বললেন ঠিক আছে তুই ছেলেটাকে নিয়া আস আমার কাছে। কথা বলে দেখি যদি তোকে গ্্রহন করার মত যোগ্যতা ওর থাকে তাহলে অবশ্যই তোর কথা মেনে নেব। শিমু যেন হাফ ছেড়ে বাচল,ঠিক আছে বাবা। আমি দু এক দিনের মধ্যেই ওর সাথে কথা বলতে চাই।

থ্যাঙ্ক ইউ বাবা। ওকে এখন যাও ঘুমাও গিয়ে। শিমু প্রফুল্ল মনে চলে গেল। রমনা পার্ক। পরের দিন সকাল ১০টা।

বকুলের জন্য অপেৰা করছিল শিমু। বকুল এলে শিমু বলল,কখন আসতে বলছি? ১০টায়। এখন কয়টা বাজে? ১০.৩০। দেরি করলা কেন? স্যরি। স্যরি বইলা পার পাইবা না।

কি হইছে এমন করতাছ কেন? হইব আবার কি,গুড নিউজ আছে একটা তাই এমন করতাছি। গুড নিউজ, কি গুড নিউজ বল? তার আগে চল বসি ওখানটায়। দুজনে গিয়ে বসল একটা গাছের নিচে। শিমু বলল,আমাকে ভুলে যাও। বকুল বোকার মত তাকাল ওর চোখের দিকে, তারপর সহজ গলায় বলল,আচ্ছা যাও ভুলে যাব।

দ্যাখ আমি কিনত্দু সিরিয়াসলি বলতাছি। আমিওতো সিরিয়াসলিই নিতাছি। ভালবাসনা আমাকে? বাসিতো। তাহলে আপত্তি করতাছনা কেন? আপত্তি করতাছিনা এজন্য যে তুমি সত্য বলতাছনা… বকুলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শিমু বলল, না বকুল সত্তি আমাকে ভুলে যেতে হবে তোমার। কাল এসে আমাকে দেখে গ্যাছে।

বাবা ওদের সাথে কথা এক প্রকার পাকাপাকিই করে ফেলেছেন। ছেলে সৌদি ফেরত এখন ব্যাবসা করছে। বকুল এতৰণে সিরিয়াস হল,বল কি দেখে একদম কথাও পাকাপাকি হয়ে গিয়াছে। তুমি কিছু বল নাই? কি বলার আছে আমার? কিচ্ছু বলার নাই? বাবাকে বলছি। কি বলছ? বলছি তোমার কথা।

বাবা বলছেন তোমারে দেখা করতে। বকুল চমকে উঠল বলল,তোমার বাবার সঙ্গে এখন দেখা করব আমি? হ্যা,তুমি! মাথা খারাপ নাকি তোমার? তাহলে তুমি কি করতে চাও? বকুল পাল্টা প্রশ্ন করল,তুমি কি করতে চাও? শিমু বিরক্তভরা কন্ঠে বলল,আমাকে জিঞ্জাসা করতেছ ক্যান?করবা তো তুমি,তুমি যা করবা তাতেই আমি রাজি আছি। বকুল বোকার মত শিমুর দিকে তাকিয়ে রইল। শিমু মাটির দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খুড়তে খুড়তে ধরা গলায় বলল,যদি বুকে সাহস থাকে তাহলে কিছু করে দেখাও। আর যদি না থাকে তাহলে এই মুহুর্তে চইলা যাও আর কখনো সামনে আইসো না।

শুধু মনে রাইখো কোন এক অবুঝ মেয়ে ভালবাসতো এক কবিকে। কিছুৰণ দুজনেই চুপচাপ রইল। কেউ কোন কথা বলল না। রমনা পার্কের বেনচিতে বসে আছে দুজন। গাছের পাতা ভেদ করে ছাড়া ছাড়া সূর্যেও আলো এসে পড়েছে শিমুর মুখে।

কয়েকটা দুষ্ট চুল এসে পড়েছে কপালের উপর। মৃদু বাতাসে সেগুলো খেলা করছে। হাত দিয়ে সে দুষ্ট চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিতে ভুলে গেছে শিমু। কৃষ্নচুড়া,কামরাঙার ডালে কাক,শালিক,টুনটুনির কোলাহল। লেকের পানিতে টোকাই ছেলেরা বারবার লাফিয়ে পড়ে সাতরাচ্্েছ।

পিছনে পার্কের বাইরের রাসত্দা দিয়ে প্যাপু শব্দ করে গাড়ী আসা যাওয়া করতেছে। ওরা যেখানে বসেছে তার আসে পাসে আরও কয়েকটা জুটি বসে আছে। আস পাস দিয়ে কত লোকজন আসা যাওয়া করতেছে কিনত্দু এই মুহুর্তে ওরা কিছুই লৰ করছে না,বাইরের কোন কিছুই ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না। ওরা এখন চলে গেছে ভিন্ন এক জগতে। এভাবে বসে এক ঘন্টা পার করে দিল ওরা।

এক সময় বকুল লৰ করল শিমু কাদছে। নীরব কান্না। ধীর গতিতে গাল বেয়ে অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ছে। শিমুকে দেখে বকুলের নিজেরও কান্না পেল। বসা থেকে দাড়িয়ে বকুল শিমুর সামনে গিয়ে ওর নিচু মুখ উচু করে ধরল।

দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রম্ন মুছে দিল। তখনি বাধ না মানা বন্যার পানির মত অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়তে লাগল শিমুর চোখ থেকে। বকুল শিমুকে জড়িয়ে ধরল। বকুলের বুকের মধ্যে মাথা গুজে শিমু ফিসফিসিয়ে বলল,আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা বকুল পিস্নজ তুমি কিছু একটা কর। শিমুর মানসিক অবস্থা কল্পনা করে পৃথিবীর আর সব কিছু ভুলে গেল বকুল।

শিমু ছাড়া,প্রেম ছাড়া,ভালবাসা ছাড়া পৃথিবীতে আরও কিছু আছে এটা তার মনে হলনা। সে মরিয়া হয়ে উঠল যে করেই হোক ভালবাসাকে জয় করতেই হবে। এইমুহুর্তে তার কাছে মনে হল ভালবাসার জন্য পৃথিবীর আর সব কিছু সে ত্যাগ করতে পারবে। বকুল বলল,প্লিজ লক্ষী তুমি থাম। এমন অবুঝ হয়োনা।

আমি কালই আসতেছি তোমাদের বাসায়। কথা বলব আমি। যে করেই হোক তোমাকে আমার করবই। আত্মবিশ্বাস আর বলিষ্টতার ছাপ বকুলের চোখে মুখে স্পষ্ট হল। তা দেখে শিমু স্বসত্দির নি:শ্বাস ফেলল।

বিকেলবেলা বাসায় ফিরে এসে বকুল দেখতে পেল তালাবন্ধ রম্নমের সামনে মেঝচাচা বসে আছেন। বকুলকে দেখেই তিনি উঠে দাড়ালেন। বললেন,তোর মোবাইল বন্ধ ক্যান?সেই দুপুর থেকে ট্রাই করতাছি। মোবাইল হারায়া গ্যাছে। কোথায় হারিয়েছে, কিভাবে হারিয়েছে সে কথা জিঞ্জেস না করেই তিনি বললেন, চল।

জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল বকুল। বাড়ি যেতে হইব এখনই। বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল বকুলের। বলল,ক্যান কি হয়াছে,এখনই যাইতে হইব ক্যান? কিযে হয়াছে সেইটাতো আমিও জানিনারে বাপ। চাচার কথা এবং বলার ভঙ্গির মধ্যে কেমন একটা বিপদের গন্ধ খুজে পেল বকুল।

ওর চোখে জল চলে এল। চেপে ধরল চাচার হাত। কি হইছে খুইলা কন আমারে। চাচা বকুলের কাধের উপরে সানত্দনার হাত রাখলেন। বললেন,তেমন কিছু হয়নাইকা।

তুই ঘাবড়াইসনারে বাপ। আগে বারিত যাই তারপর দেখি কি হইছে। ক্যান কি হইছে?বললে কি হয় আমারে? কালু শেখ আর মুখ খুললেন না। সেদিন রাত বারটার দিকে তিনি বকুলকে নিয়ে বাড়ি এসে পৌছলেন। হ্যাজাক লাইটের উজ্জল আলোতে আলোকিত হয়ে আছে বাড়ির উঠান।

সেই আলোতে বকুল দেখতে পেল মানুষের সমাগম। পাচ ছয়জন করে দলে বিভক্ত হয়ে নীরব গুন্জন করছে। বাড়ির গাছপালাগুলোও কেমন ঝিম মেরে রয়েছে। পূবপাসে তিনটি তেতুলের গাছ। উত্তরে একপায়ে দাড়িয়ে থাকা নারকেল ও সুপারির গাছ।

বকুল অন্যসময়ে দেখেছে তেতুল গাছে পাতাদের নেচে উঠতে। নারকেল পাতাদের ছন্দে ছন্দে দুলে উঠতে। সে দোল খাওয়া ঘন হলে কি সুন্দর ফর ফর আওয়াজ হত। এসব দৃশ্য বকুল একা একা বসে কতদিন দেখেছে। কিনত্দু আজ এরা সবাই নিশ্চুপ কেন? পূবকোনে তেতুলতলে লাস গোরোস্থানে নেবার খাটিয়া।

উঠোনের মাঝখানে একটি বিছনার উপর মশারি খাটানো। সবুর মোলস্না কচকো সাবানের প্যাকেট খুলছেন। কেউ দুজন ধরাধরি করে এক পাতিল গরম জল এনে রাখল। বকুল ধীরেধীরে এগিয়ে গেল। দৃষ্টিপাত করল মশারির ভেতর শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে।

লালু শেখ। যে মানুষটা বাঘের মত তেজী ও বদমেজাজি অথচ বকুলের বাবা। কিনত্দু লোকটা এভাবে এখানে শুয়ে আছে কেন?আর সবুর মোলস্নাই বা এমন কচকো সাবান আর গরম জল নিয়ে রেডি হয়েছেন কেন?সবুর মোলস্নাতো কেবল মানুষ মরে গেলেই শেষ গোস দিতে আসেন। তবে কি বকুলের বাবাটা আজ মরে গেছে। আর এজন্য এমন চুপচাপ শুয়ে আছে।

যে বাবাকে বকুল জ্ঞান হওয়া অবধি একদিনের জন্যও ভালবাসতে পারে নাই সে বাবার জন্য সাত সাগরের নোনা জল তার চোখে এসে ভর করল। হাটু গেড়ে বসল বাবার শিওরে দুহাত মাটির উপরে ভর করে নির্বাক চেয়ে রইল নীথর মুখপানে। আর বাধ না মানা অশ্রম্নগুলো বড় বড় ফোটায় রম্নপানত্দরিত হয়ে মুক্তি পেতে লাগল। কোন ফাকে যেন রুকু আর মুকুলটা ওর পাসে এসে দাড়িয়েছে। ওরা হেচকি তুলে তুলে সুর করে কাদছে।

একবার ডানহাতে একবার বামহাতে পালা করে চোখ মুছছে। ডবডবে দৃষ্টিতে ওদের দিকে মুখ ফেরাল বকুল। সবচে ছোট যে ভাইটা মুকুল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তাতে ওর কান্না আরও বেড়ে গেল। ধরা গলায় বকুল বলল,কান্দিসনারে ভাই, কান্দিসনা।

ভাইয়া আমাদের বাবা মইরা গেছে তাইনা ভাইয়া? নারে ভাই না বাবা মরে নাই বাবা ঘুমাইছে। তাইলে উঠানের মধ্যে ঘুমাইছে ক্যান?আগেতো কোনদিন উঠানের মধ্যে ঘুমায় নাই। এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলনা বকুল। শুধু বলল,চুপ থাক ভাই চুপ থাক। কিন্তু চুপ থাকতে চাইলেই কি আর চুপ থাকা যায়,যায়না।

কিন্তু কি করার আছে?এ নিষ্ঠুর সত্যতো মেনে নিতেই হবে। বোনটাকেও কাছে টেনে আনল সে। দুটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। নিজে কাদছে অথচ ওদেরকে বলল,কান্দিস না তোরা কান্দিস না। ওরা কান্না থামাল না।

নীরবে বকুলের বুকে মাথা রেখে কাদতে লাগলো। ঘরের পিছনে নারকেল এবং সুপারি গাছের উপর দিয়ে যে আকাশটা দেখা যায় সে আকাশের দিকে চেয়ে রইল বকুল। আকাশের বিশলতার কথা চিনত্দা করতে লাগল। কত বিশাল আকাশ। তার বুকে ঠাই নিয়ে বিসত্দর তারকারাজী।

একেকটা তারা নাকি পৃথিবীর চাইতেও কয়েক লাখগুন বড়। এত বড় বড় তারকারাজী আকাশ তার বুকে ঠাই দিয়েছে। বকুল মনে মনে বলল,হে আলস্নাহ তুমি আমার বুকটাকে ঐ আকাশের মত বিশাল করে দাও,যেন আমি আমার এই বুকে আমার এই অসাহায় ভাই,বোন এবং আমার মাকে স্থান দিতে পারি। তুমি আমাকে শক্তি দাও আলস্নাহ, তুমি আমাকে শক্তি দাও আলস্নাহ। আমি আমার এ জীবনে আর কিছুই চাইনা।

সবুর মোলস্না লালু শেখকে গোসল করাচ্ছেন। একটু পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে মসজীদ প্রাঙ্গণে। সেখানে জানাজা হবে। তারপর খালের ওপারের বাশবাগানের পারিবারিক গোরস্থানে তার বাবার পাসে তাকে চীর নিদ্রায় শায়িত করা হবে। বকুলের মনে হল, ইস কি কঠীণ!আচ্ছা সত্য এত নিষ্ঠুর কেন?কি নির্মমতায় ভরা মানুষের জীবন।

যে মানুষটা সকালেও শুয়ে ছিলেন তার ঘরে,কত মানুষজন ছিল তার পাসে অথচ আজ সে শুয়ে থাকবে সাড়ে তিন হাত মাটির অন্ধকার কবরে। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে কবরের মাঝখানে শুইয়ে দেবে,বাশের চাটাই আর কলাপাতার ছাউনি দিয়ে দোচালা ঘরের মত মাটি উচু করে দিবে। কিছুৰণ দাড়িয়ে দোয়া দুরম্নদ পড়বে সবাই। এক সময় কেউ আর থাকবে না ওখানে। থাকবে শুধু বাশবাগান।

রাত নিশুথে যে বাশবাগানে রাত জাগা পাখির ধ্বনি। হয়তো পরের দিন বকুলরা যাবে তার বাবর কবরের পাসে। কিছুৰণ দাড়িয়ে দোয়া দুরুদ পড়বে,প্রার্থনা জানাবে তারপর দীর্ঘশ্বাস নামের ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চলে আসবে। এভাবে একদিন দুইদিন এক সপ্তাহ তারপর হয়তো মানুষটাকে তারা ভুলে যাবেনা,কিন্তু আগের মত কওে আর মনেও রাখতে পারবে না। বকুল মনেমনে বলল,সত্যিই কি আমরা ভুলে যাব আমাদেও বাবাকে! এমনইতো হয়! এমনইতো দেখেছে সে তার দাদাজানের বেলায়।

কালুশেখের শীতল স্পর্শে উঠে দাড়াল বকুল। পরম নির্ভরতায় পিঠ চাপড়ে কালুশেখ বললেন,শক্ত হ বাপ,শক্ত হ। তোর বাপ আমার ভাইনা?আমার কি কষ্ট হইতাছে না?কিনত্দু কি করবি বল?আলস্নার বিধানতো মাইনা লইতেই হইবো। তার বিধান কনডানোর কোন উপায় নাই। সবচে বড় কথা হল তোর উপর এখন অনেক দায়িত্ব।

কাজেই তোর এখন ভাঙ্গা পরলে চলবনা। তোওে এখন শক্ত হতে হইব,পাথরের মতন শক্ত। চাচার মুখের দিকে নিসত্দব্ধ হয়ে চেয়ে রইল বকুল। কালুশেখ বললেন,চল ঘরে চল, তোর মার কাছে যাই,তার অবস্থাও এখন ভালনা। একচোট কেদে কেটে মূর্ছা গেছেন।

তুইতো আইসা অব্দি এইখানেই বইসা রইলি তার কাছেও তোর যাওয়া দরকার। কমলা চৌকিতে শুয়ে আছেন। তার পাসে চিনত্দিত বসে আছেন বকুলের চাচী। পাসের বাড়ির জমিলা ফুফু। কমলা এক দৃষ্টিতে ঘরের চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন।

দৃষ্টি নড়ছে না। বকুল কাছে গিয়ে বসল। তবু তিনি দৃষ্টি নড়ালেন না। অল্প শোকে পাথর অধিক শোকে কাতর। হয়তো এখন তার অবস্থা ঐপাথরের মত।

পাথরের গায়ে হাত রাখলে পাথর যেমন অনুভব করতে পারেনা তেমনি বকুল তার কপালে হাত রাখলে তিনিও অনুভব করতে পারলেন না। বকুল অস্ফুট স্বরে বলল,মা!মা! কমলার চোখের দৃষ্টি নড়ল না। যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন সেভাবেই তাকিয়ে রইলেন। শুধু বড় বড় অশ্রু ফোটাগুলো দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। যে স্বামীর সংসারে কমলা এক ফোটা সুখের দেখা পাননি কোনদিন,আজ সে স্বামীর মৃত্যুতে তার কি দশা।

একথা ভেবে বকুলের মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠল তার প্রতি। মনে মনে বলল,বাবাকে হারিয়েছি তোমাকেও যদি হারাতে হয় তাহলে আমি বাচব না মা,মা এটুকু তুমি বোঝ মা। কালু শেখ বকুলকে ইশরা করে ডাকলেন আয়। লালুশেখকে খাটিয়ায় করে বয়ে নিয়ে চলল সবাই। বকুলের বুকটা ভেঙ্গে যেতে লাগল।

এবাড়িতে মানুষটার কত আধিপত্য ছিল এতদিন। কত শাসন আর ভালবাসায় ভওে রাখতেন সবাইকে। অথচ আজ তিনি চলে যাচ্ছেন। জন্মের মত যাচ্ছেন। আর কোনদিন ফিরে আসবেন না।

কিনত্দু বকুলের মনে হল তিনি ফিরে আসবেন। কি ভাবছে বকুল এসব। এসব ভাবা ঠিক না এতে মুর্দারের কষ্ট হয়। সব ভাবনাকে দুরে ঠেলে বকুল সবার সাথে তাল মিলিয়ে পড়তে লাগল কলেমা শাহাদাত,আস্হাদু আলস্না ইলাহা…… সমাধীকার্য সমাপ্ত করে সবাই যখন চলে আসবে তখন বকুল শুনতে পেল তার বাবর গলা। থমকে দাড়াল বকুল।

চলে যাচ্ছিস বাপ। হু হু করে কেদে ফেলল বকুল। আবারো স্পষ্ট শুনতে পেল,তোর মা এবং ভাই বোনদের দেখিস বাপ। বকুল অস্ফুট স্বরে বলল, দেখব বাবা তুমি আমাকে দোয়া কর। কালুশেখ বকুলকে জড়িয়ে ধরলেন,চলে আয় বাপ চলে আয়।

বকুল যখনি চলে আসতে উদ্যত হয় তখনি তার বাবার গলা শুনতে পায়,আমারে একলা রাইখা চলে যাচ্ছিস বাপ। বকুল আবারো ঝরঝর করে কেদে ফেলল,না বাবা আমি কোথাও যাবনা আমি তোমার কাছেই থাকব। কালুশেখ বললেন,চল। লালুশেখের গায়েবী কন্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়ে বকুলের কানে বাজল,বকুল!বকুল! বকুল বলল,বাব!বাবা! লালুশেখ মারা যাবার তিনদিন পর্যনত্দ কমলা ওভাবেই পড়ে রইলেন। না বিছানা ছেড়ে উঠলেন,না কোন কথা বললেন,না কিছু খেলেন।

রুকুটার অবস্থাও তাই। কোনও কথা বলেনা। কোথাও যায়না। শুধু ঘরে বসে কোরান মাজীদ পড়ে। পড়া শেষ হলে কোরান মাজীদ বন্ধ করে একপাসে রেখে মোনাজাত করে।

অনেকৰণ ধরে মোনাজাত করে ও। যতৰণ হাত উচু করে ধরে রাখে ততক্ষণই কাদে। খেজুর রসের মত টপটপ ফোটায় ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মুকুলের অবস্থা ভিন্ন। ও দিব্যি আছে খাচ্ছে দাচ্ছে স্কুলে যাচ্ছে।

যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। কিনত্দু পড়া শোনায় মন আছে। বাবার অবর্তমানে সংসারের সব দায়ীত্ব এসে পড়ল বকুলের উপর। এখনও নিজের পড়াশোনা শেষ হয়নাই। সংসারে সবার ভরনপোষণ তার উপর ছোট দুভাইবোনের পড়াশোনর খরচ।

কোথা তেকে আসবে এসব। অতি দ্রুত চিনত্দার অথৈ সাগরে পড়ে গেল বকুল। মানুষ অভাবে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। ন্যায় অন্যয়ের তোয়াক্কা নাকওে সে তখন শুধু অভাব হতে মুক্ত হতে চায়। শিমুর সাথে দেখা করা এখন বকুলের জুরুরী।

কথা ছিল তার বাবার সাথে দেখা করবে। কিনত্দু এই জুরুরী কাজটাকে এখন তার কাছে মোটেও জুরুরী মনে হলনা তার কাছে। এখন তার সবচে বেশি প্রয়জন হল একটা চাকরী। ইচ্ছে করেই বকুল শিমুর কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রাখল। আর শিমু শত চেষ্টা করেও বকুলের কোন সন্ধান বের করতে পারলনা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।