জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো ... এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো
অধিকাংশ পিরানহা মাছই দেখতে দারুণ সুন্দর কিন্তু খুবই আক্রমণাত্মক স্বভাবের মাছ। আমাদের দেশে লাল পেটওয়ালা পিরানহা (Red Bellied Piranha) এবং লাল পেটওয়ালা পাকু (Red Bellied Pacu) এ দুটি প্রজাতির পিরানহা কেউ কেউ চাষ করছেন, অনেকে শখের বশে বাহারি মাছ হিসেবে এ্যাকুয়ারিয়ামে লালন-পালন করছেন। আমাদের দেশে বিদেশী বাহারি মাছ হিসেবে এ্যাকুয়ারিয়ামে লালন-পালনের জন্য এবং অধিক উৎপাদনশীল মাছ হিসেবে চাষের জন্য চীন ও থাইল্যান্ড থেকে আনা হলেও আজ তা সেখান থেকে চলন বিলের মত উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এ প্রজাতির দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনবাসী পিরানহা দলবদ্ধ আক্রমণে যে কাউকে ২ বা ৩ মিনিটে সাবাড় করে দিতে সক্ষম। তাই দেরিতে হলেও এর ক্ষতিকর বিষয়টি অনুধাবন করে মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন অনুসারে পিরানহার সব প্রজাতির চাষ, প্রজনন, ক্রয়-বিক্রয় ও দখলে রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শ্রেণীবিন্যাসীয় অবস্থান:
পিরানহা Characidae (or Characin) পরিবারভুক্ত মাছ। বৃহৎ এই পরিবারে ১২০০ এর অধিক প্রজাতি আছে। পিরানহার উপ-পরিবারের নাম Serrasalmidae (serra means ‘saw’, ‘sawed’ or ‘serrated’, salmus means ‘salmon’), অর্থাৎ এ পরিবারের সদস্যদের ধারালো দাঁত আছে । এই উপ-পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ে মতভিন্নতা ও বিতর্ক আছে । তবে যতদূর জানা গেছে, এই উপ-পরিবারে এখন পর্যন্ত ৮০ টির অধিক ভিন্ন জাতের প্রজাতি সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
এর মধ্যে আবার রুপালি ডলার (Silver Dollars -Silver Dollar, Striped Silver Dollar, Spotted Silver Dollar, Red-Spot Silver Dollar, Speckled Silver Dollar, Red Hook Silver Dollar , Black-Barred Silver Dollar,Hard-Bellied Silver Dollar ), পাকু (Pacu - Common Pacu, Red Pacu, Black Pacu, Silver Pacu, Sheep Pacu, Parrot Pacu ) এবং হুইমপল (Whimple - Wimpel Piranha ) পিরানহা ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত করার যৌক্তিকতা থাকায় হিসেব করলে প্রজাতির সংখ্যা আরও অধিক হবে। এই উপ-পরিবারের গণ (genus) মোট এগারোটি। বিস্তারিত শ্রেণীবিন্যাস নিচে দেয়া হল-
Serrasalminae Classification (per Nelson, 1994)
Phylum: Cordata (Animals with brains)
Subphylum: Vertebrata (Animals with backbones)
Superclass: Gnathostomata (Jawed vertebrates)
Class: Actinopterygii (Ray-finned fishes)
Division: Teleostei (True bony fishes)
Super Order: Ostariophysi (Bony fishes)
Order: Characiformes (Characin forms)
Family: Characidae (Characins)
Subfamily: Serrasalmidae (‘Serrated salmon’ family)
Genera:
• Pygocentrus: Caribe / ‘True’ Piranha’s
• Serrasalmus: Pirambeba’s
• Pristobryon: Pirambeba’s
• Pygopristis: Pirambeba’s
• Catprion: Wimpel Piranha’s
• Colossoma: Tambaqui / Pacu’s
• Acnodon: Sheep Pacu’s
• Ossubtus: Parrot Pacu’s
• Metynnis: Silver Dollars
• Myleus: Silver Dollars
• Mylossoma: Silver Dollars
আমাদের দেশে যে দুই প্রজাতির পিরানহা আনা হয় সে দুটি হচ্ছে-
• Pirapitinga, Piaratus brachypomus
Taxonomic formula: D. 1/16-18; P1. 7; P2. 7; A. 9/24-25
• Red Piranha, Pygocentrus nattereri
Taxonomic formula: D. 16-18; P1. 14-17; P2. 5-8; A. 25-28
শারীরিক গঠন:
প্রায় সব ধরনের পিরানহা মাছেই আছে রেজরের মত ধারালো দাঁত ও অত্যন্ত শক্ত নিম্ন চোয়াল। আর এজন্যই ওরা খুব দ্রুত কামড়িয়ে খেতে পারে। এতে শক্তিশালী নিম্ন চোয়াল ছাড়াও আছে উন্নত ও পুরু মাংসপেশি ও পার্শ্বীয়ভাবে চাপা দেহ।
লক্ষণীয় যে, পিরানহার নৌকার পাটাতনের (keel ) ন্যায় শারীরিক গঠন (মাথা হতে লেজ পর্যন্ত), বড় ও শক্তিশালী লেজ, ছোট ছোট আঁইশ দিয়ে ঢাকা শরীর দেখতে পাওয়া যায়; যা দ্রুত সাঁতরানোর জন্য সহায়ক। পিরানহার চোখ দুটি বেশ বড় এবং দ্রুত শিকার ধরে সহায়ক। আবার এর নাকটিও বেশ বড় যাতে আছে অধিক দ্রুত পানি প্রবাহ নির্গমনের উপযোগী বড় বড় নাসারন্ধ্র এবং এটি শিকারের গন্ধ অনুসরণের জন্য উপযোগী। এই ধরনের শারীরিক গঠনের জন্যই এটি যেমন ক্ষিপ্র গতি সম্পন্ন তেমনি শক্তিশালী আক্রমণকারী। এসব বৈশিষ্ট্যই পিরানহাকে ভয়ঙ্কর এক রাক্ষুসে মাছের পরিচিতি প্রদান করেছে।
কি ধরনের পরিবেশে পিরানহা বসবাস করে?
খুবই আক্রমণাত্মক পিরানহা মাছের অনেক প্রজাতি স্বাদু পানিতে এবং কিছু প্রজাতি লোনা পানিতে বসবাস করে। দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এমনকি আফ্রিকাতেও এদের নানা প্রজাতির বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। এসব এলাকার প্রচুর সংখ্যক নদী, খাল ও হ্রদে এরা বসবাস করে। বড় ও অগভীর জলাশয়ে বেশি দেখা গেলেও এ্যাকুয়ারিয়ামের ছোট্ট পরিবেশও এরা স্বচ্ছন্দে মানিয়ে নিতে পারে।
পিরানহার সামাজিক আচরণ কেমন?
পিরানহা সাধারণত দলবদ্ধভাবে শিকার অনুসরণ ও আক্রমণ করে ।
দলবদ্ধভাবে অবস্থানকারী পিরানহা মাছকে আপাতদৃষ্টিতে শান্ত-ভদ্র মনে হলেও তাদের মধ্যে সবসময় পারস্পারিক অবিশ্বাস ও ভয় কাজ করে। কারণ তাদের মধ্যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় তথা খাদ্য স্বল্পতা অবস্থায় নিজের প্রজাতির সদস্যদের ভক্ষণের প্রবণতা দেখা যায়। এ স্বভাবের জন্য তারা পরস্পরকে মারাত্মকভাবে আহত করতে বা পরস্পরকে হত্যা করতেও সক্ষম। আর বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের সবসময় অন্যদের অবস্থান জানা এবং আক্রমণের জন্য বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত থাকার প্রয়োজন হয়। তারা কুমিরের ন্যায় ধৈর্যের সাথে পাখির ছানাটি কখন ভুলক্রমে বাসা হতে পানিতে পড়বে এজন্যও অপেক্ষায় থাকে।
এমনকি শক্ত খোসা বিশিষ্ট ফল, সাধারণ ফলফলারি, বীজ বা পাতা খেয়েও ক্ষুধা নিবারণ করে। শুষ্ক মৌসুমে খাদ্যাভাব দেখা দিলে সবল পিরানহা নিজেদের দলের দুর্বল সদস্যকে আক্রমণ করে থাকে। খাদ্য স্বল্পতা বা ক্ষুধার্থ অবস্থার চেয়ে প্রজননকালে এরা আরও বেশি আগ্রাসী স্বভাব প্রদর্শন করে, এ সময় তারা হায়েনার মত পরস্পরের উপর বেশি আক্রমণাত্মক হয়। এ অবস্থায় একই জলাশয়ে স্বাভাবিকভাবেই তারা অন্য মাছের উপস্থিতিই সহ্য করে না, যদিও কখনো কখনো শান্ত আচরণও প্রকাশ করে থাকে। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এটি পরিবেশগত, খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবের কারণেই হয়।
পিরানহা কি খায়?
পিরানহা সর্বভুক প্রকৃতির অর্থাৎ এরা উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয় ধরণের খাবারই খেয়ে থাকে। তবে প্রাণীই এদের প্রথম পছন্দ। তবে মূল বিষয় হচ্ছে খাবার গ্রহণের সময় প্রকাশিত এদের আক্রমাত্মক চরিত্র যা বিশেষত খাদ্য স্বল্পতায় অধিক প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
পিরানহার প্রধান প্রধান খাদ্যের তালিকা-
• ছোট-বড় মাছ
• মৃত প্রাণী
• জলজ উদ্ভদরাজির পাতা, ফল ও ফলের বীজ
• শামুক, ঝিনুক বা এদের ডিম
• যে কোন বয়সের ব্যাঙ
• জলজ মাছ ও পোকামাকড়ের ডিম, পোকামাকড় ইত্যাদি
পিরানহা কোথায় ও কখন ঘুমায়?
পিরানহা দিনের বেলা শিকারের সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত থাকলেও রাতে তারা বিশ্রাম নেয় যাকে অনেকেই ঘুমায় বলে থাকেন।
পিরানহা কোথায় ডিম পাড়ে?
পিরানহা প্রাকৃতিক পরিবেশে পানিতেই ডিম ছাড়ে ও বাহ্যিক নিষেক সম্পন্ন হবার পর নিষিক্ত ডিম পরিস্ফূটনের মাধ্যমে পোনায় পরিণত হয়।
পিরানহা মাছ থেকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হ্যাচারিতে ডিম তথা পোনা পাওয়া সম্ভব।
পিরানহা কিভাবে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে?
পিরানহা ১৮-২৪ মাসেই প্রজননক্ষম হয়। প্রজননকালে স্ত্রী- পুরুষ উভয় মাছ আরও উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে। পিরানহা প্রজননকালে একটু শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে। তারা জলাশয়ের তলদেশের উদ্ভিদ পরিষ্কার করে ফেলে, এমনকি ছোট ছোট পাথর লেজ দিয়ে বা মুখ দিয়ে সরিয়ে দেয়।
অতঃপর সেখানে তারা বাহ্যিক পরিবেশ থেকে নিজেদের একটু আলাদা করে নিরিবিলি পরিবেশে বাসা তৈরি করে। বাসা তৈরির পর বাবা মাছ মা মাছকে বাসার উপরে এনে ডিম ছাড়তে উদ্দীপ্ত করে। মা মাছ ডিম ছাড়লে দ্রুততার সাথে বাবা মাছ নিকটবর্তী স্থানে শুক্রাণু ছাড়ে যাতে সহজেই ডিমগুলো নিষিক্ত হতে পারে। প্রজনন শেষে বাবারা নিষিক্ত ডিমসহ বাসা পাহারা দেয়। কোন কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে মায়েদেরও পাহারার কাজ করতে দেখা যায়।
কমলা রঙের নিষিক্ত ডিমগুলো থেকে ২-৩ দিনের মধ্যেই ক্ষুদ্রাকার ডিম-পোনা পাওয়া যায়, যা প্রথমে কুসুম থালিস্থ কুসুম হতে পুষ্টি নিয়ে বড় হতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই কুসুম নিঃশেষ হবার পর এরা প্রাকৃত পরিবেশে থেকে খাবার খেতে শেখে।
পিরানহা কত বড় হয় ও কতদিন বাঁচে?
অধিকাংশ পিরানহা ১৫- ২৫ সে.মি. পর্যন্ত বড় হয়। তবে লাল পেটওয়ালা (Red Bellied Piranha) পিরানহা ৩০ হতে ৪০ সে.মি.পর্যন্ত, এমনকি তার চেয়েও বড় হয়। অধিকাংশ পিরানহার আয়ুষ্কাল ৫ বছর তবে তার বেশিও বেঁচে থাকে।
পিরানহা কি মানুষকে আক্রমণ করে?
পিরানহার হাঙ্গরের দাঁতের ন্যায় ধারালো দাঁত আছে। এরা হাঙ্গরের মতই দ্রুত কামড়িয়ে খেতে পারে এমন কি মানুষকে আক্রমণ করতে সক্ষম। পিরানহা সর্বভুক হলেও জীবিত প্রাণীই তাদের অধিক প্রিয়। পরিবেশে প্রাকৃতিক খাবার স্বল্পতার সময় অথবা ক্ষুধার্ত অবস্থায় এরা নাগালের মধ্যে পেলে মানুষসহ যেকোনো প্রাণীকে খাবারের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক খাদ্যের ঘাটতির সময় এ আচরণ আরও বিপদজনক হয়ে দেখা দেয়।
প্রাণিজাত খাবারসহ এর কাছাকাছি গেলে এটি গমনকারী মানুষের চেয়ে তার দেয়া খাদ্যর প্রতি অধিক আকর্ষণবোধ প্রকাশ করে। পিরানহার ঘ্রাণ শক্তি প্রবল, এটি দূর হতেই রক্তের উপস্থিতি টের পেলে সেদিকে ধাবিত হতে পারে এবং তুলনামূলক অনেক বড় আকারের প্রাণীকেও এরা আক্রমণ করে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে রক্তাক্ত অবস্থার ব্যক্তিকে ঘ্রাণের সাহায্যে এরা অনেক দ্রুত শনাক্ত ও আক্রমণ করতে পারে। তাই তাদের পিরানহার নিকটবর্তী হওয়া অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। মনে রাখা প্রয়োজন, একটি ক্ষুধার্ত পিরানহা হাঙ্গরের ন্যায় সবকিছু কামড়ে খেতে চায়-এমনকি তার নিজ স্বজনদেরও।
আরও কিছু মজার তথ্য
• পিরানহা জেট প্লেনের মত দ্রুতগামী।
• বড় বড় উত্তাল, গভীর ও স্রোতস্বিনী নদীতেও বসবাস করতে পারে।
• ক্যাঙ্গারুর মত পানির উপর লাফিয়ে উঠতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।