আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাল ঠাকরে: কার্টুনিস্ট থেকে মারাঠা সম্রাট

Shams জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে, পুনায়। কখনো কি কেউ ভেবেছিল 'ফ্রি প্রেস জার্নাল'-এর নিতান্ত সাধারণ এক কার্টুনিস্ট একদিন ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য শাসন করবে? তার হুংকারে দিল্লির মসনদ কেঁপে উঠবে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাল কেশ ঠাকরে এক রহস্যের নাম। ভক্তদের কাছে বালা সাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি কোনো দিন নির্বাচনে দাঁড়াননি।

কোনো প্রশাসনিক পদেও বসেননি। তা সত্ত্বেও ছিলেন ভারতের অন্যতম ক্ষমতাবান- 'মহারাষ্ট্রঞ্চ গডফাদার'! যেন মারিও পুজোর গডফাদার উপন্যাসের ভারতীয় সংস্কার। বাল ঠাকরের আদলে রামগোপাল ভর্মা বলিউডে তৈরি করেন চলচ্চিত্র 'সরকার' ও 'সরকার রাজ'। যেখানে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্চন। ১৯৫০ সালের গোঁড়ার দিকে ঠাকরের একমাত্র পরিচিতি ছিল তার কার্টুন।

তীব্র রাজনৈতিক শ্লেষ থাকত তার কার্টুনে। আর সম্পাদক অনেক সময়ই কাটছাঁট করে ছাপাতেন। এর প্রতিবাদে ফ্রি প্রেস জার্নালে কার্টুনিস্টের চাকরি ছেড়ে ভাইকে নিয়ে ১৯৬০ সালে শুরু করেন মারাঠি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা 'মার্মিক'। এ সময় তার মাথায় আসে 'মারাঠি মানুস'-এর ভাবনা। 'মারাঠি অস্মিতা'কে তুলে ধরার প্রয়াস।

তখন বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) 'বহিরাগত' নিয়ে উত্তপ্ত। সেই সুযোগে সাধারণ মারাঠিদের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। ঘোষণা করেন, তার একমাত্র লক্ষ্য ভূমিপুত্রদের রক্ষা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মারাঠিদের মন জয় করেন। তীব্র রাজনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন ঠাকরে সেই আবেগকে কাজে লাগিয়েই বাবা কেশব সীতারাম ঠাকরের পথ অনুসরণ করে ১৯৬৬ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছর ১৯ জুন গড়ে ওঠে উপমহাদেশের অন্যতম উগ্র কট্টরপন্থী সংগঠন শিব সেনা (টাইগার আর্মি)। দলের ঘোষিত আদর্শ 'আমরা মহারাষ্ট্রের মারাঠি এবং হিন্দুস্থানের হিন্দু'। ঠাকরে প্রচার করতে থাকেন, ভিন রাজ্যের লোক এসে তাদের শহর মুম্বাইয়ের দখল নিয়ে নিচ্ছে। সে সময় তার নিশানায় ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয়, গুজরাটি ও মারওয়াড়িরা। 'অমারাঠিদের খেদাও'-এর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি গোটা মুম্বাইয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন।

ঘোষণা করেন, প্রতিটা মারাঠি ভাষীর জন্য চাকরি সুনিশ্চিত করাই শিব সেনার লক্ষ্য। প্রকাশ্যেই ঠাকরে জানিয়েছিলেন, লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য তিনি হিংসার পথ নিতে পিছপা হবেন না। বাড়তে থাকে শিব সেনার জনপ্রিয়তা। মুম্বাই শহরে তার কথাই হয়ে ওঠে শেষকথা, হয়ে ওঠেন মারাঠি ভাষীর 'রক্ষক'। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানীর 'নিয়ন্ত্রক' হয়ে ওঠেন প্রাদেশিক রাজনীতিকে ভিত্তি করে।

জাতি-ধর্ম-ভাষা বিদ্বেষকে পুঁজি করে এগিয়ে চলে ঠাকরের শিব সেনার বিজয়রথ। ঠাকরে হয়ে ওঠেন 'মারাঠি হৃদয় সম্রাট'। ঠাকরের রাজনীতির ভিত্তি ছিল বিদ্বেষ, ঘৃণা। কখনো গুজরাটি, কখনো তথাকথিত বাংলাদেশি, কখনো দক্ষিণ ভারতীয় আবার কখনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন তার নিশানায়। বলা যায় তিনি সব সময় রাজনৈতিক শত্রু খুঁজে ফিরেছেন।

অতি-দক্ষিণপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী এই নেতা তির্যক ব্যঙ্গ-চিত্রকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও নিজের দল এবং রাজনীতির প্রতি কোনো রকম তির্যক দৃষ্টি কখনো সহ্য করেননি। ভারতে হিন্দুত্বের রাজনীতির উত্থান ১৯৮০-র দশকের শেষে। ওই উত্থান ঠাকরেকে জাতীয় রাজনীতিতেও কর্তৃত্ব দেখানোর সুযোগ করে দেয়। মারাঠা বীর শিবাজী মহারাজের 'হিন্দু পদপদশাহী'ই ছিল তার রাজনৈতিক ভিত্তি। ১৯৮৫ সালে মুম্বাই পুরসভা দখল নেওয়ার পর ১৯৮৮ সালে বিজেপির সঙ্গে জোট করেন।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতিতে হয়ে ওঠেন 'হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম জঙ্গি রক্ষাকর্তা'। ১৯৯২-৯৩ সালে মুম্বাই দাঙ্গায় শিব সেনার ভূমিকা প্রশ্নাতীত। ঠাকরের 'লার্জার দ্যান লাইফ' চরিত্র সে সময়ই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তা কাজে লাগিয়েই ১৯৯৫ সালে শিব সেনা-বিজেপি জোট প্রথম ক্ষমতায় আসে মহারাষ্ট্রে। ঠাকরে হয়ে ওঠেন সেই সরকারের 'স্বৈরাচারী রিমোট কন্ট্রোল'।

সেই জোর এমনই, যা মুম্বাইয়ের প্রতিটি প্রভাবশালী মানুষকে তার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। শিল্পপতি থেকে চলচ্চিত্র শিল্প, কেউ-ই তার 'স্নেহ' বঞ্চিত হওয়ার সাহস দেখাননি! হিটলার-অনুরাগী এই নেতা মুম্বাই তথা মহারাষ্ট্রকে 'শাসন' করেছেন তার নিজস্ব পন্থায়। অ্যাডলফ হিটলারকে অসামান্য মানুষ বলে মনে করতেন। হিটলারকে অসাধারণ শিল্পী এবং হিটলারি বক্তৃতাকে মানবেতিহাসের বাগ্মিতার উজ্জ্বল মাইলফলক বলে মনে করতেন ঠাকরে। মুসলিম-বিদ্বেষ হাতিয়ার করে গত তিন দশক মহারাষ্ট্রে একের পর এক হামলা সংঘটিত করার পিছনে শিবসেনার কৃতিত্ব ভাগ বসানোর অন্য দাবিদার যেমন আর নেই, অপছন্দের শিল্প-সাহিত্য_ অর্থাৎ যা কিছু ঠিক বুঝলাম না_ যেমন মকবুল ফিদা হুসেনের ছবি বা রোহিনত্দ মিস্ত্রির উপন্যাস ছিঁড়ে পুড়িয়ে গেরুয়া পতাকার শান ও শওকত বাড়ানোতে তাদের সমকক্ষ পাওয়া কঠিন।

২০০৩ সালে যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দল ভারত সফরে এলো, তার নির্দেশে শিব সৈনিকরা পিচ খুঁড়ে দিয়েছিল। তাণ্ডব চালানো হয় বিসিসিআই দফতরেও। যে আশা জাগিয়ে বাল ঠাকরে ও তার দল শিব সেনা এসেছিল, তা বজায় রাখতে পারেননি। ক্ষমতা শিব সেনার মধ্যেও দুর্নীতির জন্ম দেয়। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বহু ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়াল স্রেফ ফাঁকা বুলি হয়ে।

খুব দ্রুত তারা জনসমর্থন হারাতে থাকে। মুম্বাই ও মহারাষ্ট্রের লাইফলাইন তার 'কমমোপলিটন' চরিত্রই। তাই 'মারঠি অস্মিতা'র তত্ত্ব বেশি দিন টেকেনি। ১৯৯৯ সালে শিব সেনা জোট মহারাষ্ট্রে পরাজিত হয়। শক্তি হারানোর শুরু তখন থেকেই।

দলত্যাগ করেন বেশ ক'জন প্রভাবশালী নেতা। পুত্র উদ্ভব ঠাকরে ও ভ্রাতুষ্পুত্র রাজ ঠাকরের মধ্যেও বিরোধ দেখা দেয়। ঠাকরে সেই বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ২০০৬-এর ৯ মার্চ শিবসেনা থেকে বেরিয়ে রাজ ঠাকরে কাকার আদর্শেই গড়েন 'মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা'। ২০০৯- শিবসেনা ছাড়েন বাল ঠাকরের পুত্রবধূ স্মিতাও।

যোগ দেন কংগ্রেসে। জীবনের শেষ কয়েক বছর ঠাকরে ছিলেন অনেকটাই শক্তি হারানো বাঘের মতো। শিব সৈনিকরা রাস্তায় নেমে হল্লা করছেন, তিনি নীরব দর্শক হয়েই থেকেছেন। মোহাম্মদ রফি-লতা মুঙ্গেসকারের গান আর ক্রিকেটের ভক্ত ঠাকরের মাইকেল জ্যাকসনকেও স্বাগত জানিয়েছিলেন। এমনকি পাক ক্রিকেটার জাবেদ মিঁয়ান্দাদকে সপরিবারে অতিথি করেছেন তার বাড়ি 'মাতোশ্রী'তে।

বিতর্কিত নানা মতামত প্রকাশ করলেও বাল ঠাকরে কখনোই অবশ্য নিজেকে মুসলিমবিরোধী বলে মানতে চাইতেন না। যদিও তিনি নিজেকে পাকিস্তানবিরোধী বলে বর্ণনা করতেন। গত ১৭ নভেম্বর মুম্বাইয়ের এই 'মুকুটহীন সম্রাট' শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষ হলো ব্যক্তি বাল ঠাকরে অধ্যায়। তবে শেষ হয়নি তিনি যে উগ্র রক্ষণশীল রাজনীতির ধারা শুরু করেছিলেন তার।

এই বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতি সহ-অবস্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে চ্যালেঞ্জ করে যাবে বার বার। শামস্ বিশ্বাস-এর আরো লেখা  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।