সাধারন ব্লগার
অনেকেই বিভিন্ন ইন্টারভিউতে বলা শুরু করেছিলেন, বাংলাদেশি শ্রোতারা রক মিউজিক নাকি এখন খুব একটা শোনেন না। বাজারে রক মিউজিক খুব একটা চলে না—এসব গুজবের ধোঁয়া তুলে হঠাত্ করে তামিল বা দক্ষিণ ভারতের কিছু সুরের নকল ঢুকে গেল অডিও বাজারে। শুরু হলো লুপ বেসড বিভিন্ন ফোক আর ভাঙড়া গানের জোয়ার। কে গায়, কার মিউজিক কিছুই বুঝা যায় না। সবই যেন একই সুর আর একই গান।
আর আমাদের টিভি চ্যানেল কখনোই কোনো কমিটমেন্টে বিশ্বাসী ছিল না। এ ক্ষেত্রেও থাকেনি। সেই জোয়ারেই মাততে শুরু করেছিল। রাতভর তাদের নিয়ে মাতামাতি। অডিও প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যান্ড মিউজিক অ্যালবামগুলোও রিলিজ দেওয়া বন্ধ করে দিলেন।
এতগুলো কথা খরচ করার একটিই অর্থ যারা ঘরে বসে লুপ বা সফটওয়্যার দিয়ে নিজের কণ্ঠ টেনে হিচড়ে মিউজিক করছেন। তাদের দিয়ে যে মঞ্চ কাঁপানো যায় না। একসাথে একই লয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার দর্শককে নাচানো যায় না, তা এই গেল ৫ বছরে প্রমাণ হয়ে গেছে। আর এটাকেই আবার প্রমাণ করে দিল গত ১৬ নভেম্বরের কনসার্ট।
আর তারই যেন যথার্থ উদাহরণ তৈরি করলেন ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ নামের এই অভাবনীয় সফল কনসার্টে।
কনসার্টটিতে অংশগ্রহণ করেন ১০ টি ব্যান্ড । নগর বাউল , এল আর বি , ফিডব্যাক , মাকসুদ ও ঢাকা , সোলস , ওয়ারফেজ , আর্ক , ডিফরেন্ট টাচ , নোভা , প্রমিথিউস ।
চ্যারিটি কনসার্টে সফটওয়্যার বেজড কণ্ঠশিল্পীদের কোনো রেকর্ড নেই যে, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো দুরারোগ্য রোগীর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এমন নজির পাওয়া যায়নি। বরং হাবিব বা ফুয়াদদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে শাহ আব্দুল করিমের গান নিয়ে নিজেদের মতো করে গাইয়ে নিজের জনপ্রিয়তা হাতিয়েছেন।
এখানে হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কারোরই দোষ দেওয়াটাও অমূলক। কারণ তাদের ক্ষমতারও একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেখানে আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি জেমস, মাকসুদদের মতো তারকাদের টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো উদ্যোগ নেননি। সেখানে অন্য অ-শিল্পীরা যদি সে সুযোগ নেয়, তবে তাতে সেই অ-শিল্পীদের তো দোষ নেই! গতকাল আর্মি স্টেডিয়ামে সেই জাদুতেই নতুন এক জেনারেশন ছুটে আসে রক শুনতে। আর বাঙালি যে দীর্ঘদিন এইসব মৃদু বাজনার গলা চেপে আওয়াজ করে ভাঙড়া আর নকল সুরের চর্চা শুনতে শুনতে যে মহাবিরক্ত তাই প্রমাণ করল গত ১৬ নভেম্বরের কনসার্ট।
কনসার্টে আসা ইডেন কলেজের এক ছাত্রী কামরুন্নাহার মিশু বলেন, ‘টিভি আর এফএম স্টেশনে একই টাইপের একই রকম কণ্ঠের গান শুনতে শুনতে আমরা বিরক্ত, তাই এই কনসার্টে এসেছি কিছুটা প্রাণের স্বাদ নিতে। নিজের কানকে একটু স্বস্তি দিতে। ’
কনসার্টে আসা মডেল অভিনেতা নিরব বলেন, ‘আমি খানিকটা ধীরে-সুস্থেই বেরিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এখন তো রক গানের শ্রোতার সংখ্যা খুব একটা নেই। তাই ভিড় ভাট্টাও খুব একটা হবে না।
কিন্তু ভেন্যুর কাছে আসতে না আসতেই যে পরিমাণ মুনষের ঢল দেখলাম। সত্যিই খুব ভালো লাগলো। ছেলেবেলা থেকেই এই রক গান শুনেই বড় হওয়া। কোনো বড় আসরের কনসার্ট হলে যে করেই হোক দেখতে আসতাম। এখন তো অনেকদিন ধরে এধরনের বড় কোনো আসরই জমে না।
তবে রক গান যে বাঙালির ভেতর মরেনি তাই প্রমাণ করল। ’
অধিকাংশ দর্শকদের কাছেই এই ধরনের অভিযোগের কথাই শোনা গেল। এদিনের অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন পর জেমস, মাকুসদ ও ঢাকা, ওয়ারফেইজের অনবদ্য পারফর্মেন্স ছিল সত্যিই নজরকাড়া। এ ছাড়া দীর্ঘদিন পর নোভার ভোকাল আহমেদ ফজলের ‘স্কুল পলাতক মেয়ে’ যখন গেয়ে উঠলেন তখন সামনে উন্মাতাল তরুণেরা একই সুরে গেয়ে উঠলেন নিজেদের প্রিয় গান। গ্রিনরুমে ফজল বললেন, ‘আজ যেই জেনারেশনের সামনে গাইলাম।
তাদের অনেকের জন্মের আগেই আমরা মিউজিক করছি। তাই আমরা যে একটা জেনারেশনের কাল উত্তীর্ণ করতে পেরেছি তাই যেন দেখলাম আজ। ’
সারাদিনই যেন রক মিউজিকের দখলে ছিল এইদিন। মাকসুদ ও ঢাকা গেল দুই বছর ধরেই আবারও নতুন গেটআপ আর বরাবরের নতুনত্ব নিয়ে মঞ্চে গাইছে। তবে দীর্ঘদিন পর একই মঞ্চে এমন আসরে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল কনসার্ট।
একে একে মাকসুদের জনপ্রিয় গানের সাথে সাথে দর্শকদের দোলা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। মাকসুদ বললেন, ‘ব্যান্ড মিউজিক কখনওই অনালোচিত ছিল না। আর কোনো কিছু দিয়ে এটাকে ঢেকে রাখা যাবে না। বরং কোনো কিছু দিয়ে এটাকে ঢাকতে গেলেই তা আরও বড় আকারে দর্শকদের সামনে আসবে। আজ আমি নিজেও ভাবিনি এত সাড়া মিলবে।
ব্যান্ড পাগল দর্শকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবসময়ই ছিল, আছে, থাকবে। এটা প্রমাণিত। ওরা আমাদের প্রাণ। নয়তো এখন বিনোদন এত এত মাত্রা থাকতে ভর দুপুরে এই ৩০ হাজার ছেলে মেয়ে এসেছে একেবারে রক মিউজিকের সাথে সাথে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে। ’
নগরবাউল জেমসের কথা তো বলাই বাহুল্য।
মঞ্চে উঠতেই ‘গুরু’ ‘গুরু’ ধ্বনিতে যেন মুখর হলো পুরো স্টেডিয়াম। মঞ্চে অধিকাংশ গানই তার পুরোটা গাইতে হয়নি। বরং শুধু তিনি তার দর্শকদের সাথেই সঙ্গত করে গেলেন। অভাবনীয় এই দৃশ্য যেন অনেক ব্যান্ড মিউজিককে নিয়ে বলা অনেক নিন্দুকের জন্য কড়া জবাব হয়ে এলো।
এদিনের কনসার্টও ছিল আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য অর্থ উত্তোলনের কাজে্ সেই পরিসংখ্যানই যেন বারবার বেশ কয়েকজন মনে করিয়ে দিল।
খোদ আয়োজকসহ বেশ ক’জন তরুণ অর্গানাইজার আক্ষেপ করে বললেন, ‘প্রথমত সফটওয়্যার বেজড সিঙ্গারদের সাথে কথা বলতে আমাদের আগে আইনজীবীর সাথে কথা বলতে হয়। তাদের কোনো সামাজিক কমিটমেন্ট নেই। অথচ ব্যান্ড মিউজিক এ দেশের সমাজকে যতটা সহযোগিতা করেছে। বিনোদনের কোনো মাধ্যম তা করে নি। এরপর চ্যারিটি কনসার্টেও তাদের পাওয়া যায় না।
’
একজন প্রতিবেদককে প্রশ্ন করে বললেন, ‘আপনি নিজেই বলুন গত কয়েক বছরে হাবিব, ফুয়াদ গোষ্ঠীর স্টুডিও বেজড শিল্পীরা কয়টা চ্যারিটি ফান্ড তুলেছে? সামাজিক ভাবে তাদের কমিটমেন্ট কী?’ একজন অর্গানাইজার বললেন, ‘এই শিল্পীদের একজনের কাছে আমি এক ক্যান্সার রোগীর ফান্ড তোলার ব্যাপারে চ্যারিটি কনসার্ট করার জন্য কথা বলতে গেলে দীর্ঘক্ষণ আমাকে তার স্টুডিওতে বসিয়ে অনেকক্ষণ পর ভিখারির মতো কিছু টাকা ধরিয়ে বলেন, কনসার্ট করতে পারবনা এই টাকাটা নিয়ে যান। রাগে দুঃখে সেই শিল্পীকে টাকাগুলো ছুড়ে ফেলে বলে এসেছি এই ভিক্ষাবৃত্তির জন্য আসিনি আপনার কাছে। আর তোমার শিল্পী বাবাও কী তবে এই শিক্ষাই দিয়েছে তোমাকে। ’
এমন নানান কথার চাষবাস হচ্ছিল ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ কনসার্টের গ্রিনরুমে। মাঠের সামনে উন্মাতাল রকপাগল দর্শকদের প্রাণোচ্ছল চিত্কার যেন আবারও ব্যান্ড মিউজিকের জোয়ারে ভাসার এক নতুন ঘণ্টা বাজাল।
সুত্র --- ইত্তেফাক । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।