আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাজা-১ম পর্ব (Gaza -1st chapter )

প্রবাসী লিখতে শুরু করছি আমার স্কুল জীবনের ঘটনা দিয়ে। নবম শ্রেনীতে পড়ার সময় প্রানীবিদ্যার শিক্ষক আজিজ স্যার আমার সহপাঠী লুৎফরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন “কলা” কয় প্রকার এবং কি কি । লুৎফরের উত্তর ছিল “কলা অনেক প্রকার , যেমন চাপা কলা, সাগর কলা, বিচি কলা ইত্যাদি। লুৎফরের উত্তর শুনে হতবাক শিক্ষক তাকে বলেছিলেন “ হতভাগা , এ কলা সে কলা নয় এ কলা হল জীববিদ্যার কলা। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আজিজ স্যারকে স্মরন করে সবাইকে বলে রাখি এ গাজা সেবনের গাজা বা গঞ্জিকা নয়, এ গাজা হল ছোট এক ভুখন্ডের নাম।

ইজরায়েল এবং মিশর সংলগ্ন ফিলিস্তিনীদের নিয়ন্ত্রিত ছোট ভুখন্ড গাজা। ভুমধ্যসাগরের পূর্ব তীরের এই ভুখন্ডের উত্তরে ভুমধ্যসাগর। সাগর ছাড়া প্রায় পুরো ভুখন্ডের দক্ষিন,পুর্ব্ এবং উত্তরের কিছু অংশ ইজরায়েল দিয়ে ঘেরা। শুধুমাত্র দক্ষিন পশ্চিমে ১১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে মিশরের সাথে। ৪১ কিলোমিটার লম্বা এবং ৬-১২কিমি চওড়া গাজা ভুখন্ডের আয়তন ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১৭ লক্ষ যার মধ্যে ১১ লক্ষ হল ইজরায়েল থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনী শরনার্থী।

নাতিশীতোষ্ণ ভুমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ার গাজায় শীতকালে মৃদু শীত এবং গরমকালে কখনোসখনো বেশ গরম পড়ে। প্রধানতঃ সমতলভুমি এবং স্বল্পোচ্চ দু একটা পাহাড় রয়েছে এখানে। এক তৃতীয়াংশ এলাকা আবাদযোগ্য বাকী এলাকা মরুভুমি বা আধা মরভুমি। জলপাই এবং কমলা প্রধান ফসল। খনিজ সম্পদের মধ্যে আছে প্রাকৃতিক গ্যাস।

গাজা ভুখন্ডের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর হল গাজা সিটি। শিল্প বলতে আছে কিছু টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরন এবং আসবাবপত্র শিল্প । অর্থনীতি আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল। গাজায় মিশরীয় পাউন্ড এবং নতুন ইজরায়েলী শেকেল মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত। গাজার ইতিহাস – প্রাচীন কাল (খৃস্টপূর্বকাল থেকে ১৯৪৮ সাল ) - গাজার ইতিহাস ৪,০০০ বছরের চেয়েও পুরনো।

প্রায় ৩৫০ বছর ধরে প্রাচীন মিশরীয় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে থাকার পর ফিলিস্তীনীরা গাজা দখল করে নেয় দ্বাদশ খৃস্টপূর্বাব্দে। রাজা ডেভিড ১০০০ খৃস্টপূর্বাব্দে ইজরায়েল সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে গাজাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর ব্যাবিলনিয়ান এবং পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে গাজা। গ্রীক সম্রাট আলেক্সান্ডার গজা দখল করে নেন খৃস্টপূর্বাব্দ ৩৩২ সালে। এরপর কখনো তা থেকেছে সেলুসীয় বা মিশরের টলেমীয় সাম্রাজ্যের অধীনে।

৯৬ খৃস্টপূর্বাব্দে গাজা রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। রোম সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই এলাকা পূর্ব রোমান বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে থাকে। ৬৩৫ খৃস্টাব্দে হযরত ওমরের শাসনকালে তা রাশীদুন খিলাফতের অধীনস্থ হয় এবং এই এলাকা মুসলিমদের করায়ত্ব হয়। ১১১০ থেকে ১১৮৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রুসেডাররা দখলে রাখে গাজাকে। মিশরীয় সেনাপতি সালাদ্দীন ক্রুসেডারদের কাছ থেকে গাজা দখল করে নেন ।

এরপরা তা থেকেছে মিশরের মামলুক সম্রাটদের অধীনে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সময় কালে এই এলাকা থাকে অটোম্যান তুর্কীদের অধীনে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে শেষ হওয়ার পর ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তা থাকে বৃটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে। । সাম্প্রতিক ইতিহাস - ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাস্ট্রের প্রতিষ্ঠা আরব রাস্ট্রগুলো মেনে নেয় নি।

ফলে শুরু হয় প্রথম আরব- ইজরায়েল যুদ্ধ যা শেষ হয় ১৯৪৯ সালে অস্ত্র বিরতির মধ্য দিয়ে। সেই সময়েই গাজা বর্তমানের আলাদা ভুখন্ড হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং ১৯৪৮ সালে আরব লীগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “All Palestine Government” এই এলাকার শাসনভার পায়। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ ক্রাইসিসের সময় স্বল্পকালের জন্য তা বৃটিশ , ফরাসীদের অধীনে থাকে। ১৯৫৯ সালে আরব লীগ “All Palestine Government” ভেঙ্গে দেয়। তখনকার মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের গাজাকে ইউনাইটেড আরব রিপাব্লিক(UAR) এর অন্তর্ভুক্ত করে নেন।

আরব জাতীয়তাবাদী নেতা নাসের যে অখন্ড আরব জাতির স্বপ্ন দেখতেন তার অংশ হিসাবে ছিল সিরিয়া এবং মিশরের অধীনস্থ প্যালেস্টাইন এলাকা গুলো। ১৯৬৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশান বা PLO ‘র প্রতিষ্ঠার পর নাসের গাজাকে প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশানের অধীনে ন্যাস্ত করার ঘোষনা দেন যদিও তা কার্যতঃ থেকে যায় মিশরের অধীনে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসের ৬ দিনের দ্বিতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে ইজরায়েল এই এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৭৯ সালে মিশর ইজরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে সিনাই উপদ্বীপ মরু এলাকা ফিরে পায় কিন্তু গাজা থেকে যায় ইজরায়েলী নিয়ন্ত্রনে। ইজরায়েল গাজায় ২১টি ইহুদী বসতি গড়ে তোলে।

১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইজরায়েল পি,এল,ও ‘র যৌথ ঘোষনায় পর্যায়ক্রমে পশ্চিমতীর এবং গাজা থেকে ইজরায়েলী সৈন্য প্রত্যাহার এবং এই এলাকার নিয়ন্ত্রন প্যালেস্টানীদের অধীনে ন্যাস্ত করার কথা বলা হয়। ১৯৯৪ সালে পি,এল,ও এবং ইজরায়েলের মধ্যে অসলো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৯ সাল নাগাদ গাজা এবং পশ্চিমতীরের অধিকাংশ এলাকা প্যালেস্টাইনী কর্তৃপক্ষ বা Palestinian Authority (PA) এর নিয়ন্ত্রনে আসে। ২০০০ সালে শুরু হয় ২য় প্যালেস্টাইনী ইন্তিফাদা বা পুনর্জাগরন। ২০০৩ সালে জাতিসঙ্ঘ এর তত্বাবধানে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০০৫ সাল নাগাদ স্থায়ীভাবে এই এলাকায় গনতান্ত্রিক প্যালেস্টাইনী এবং ইজরায়েল রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়।

২০০৪ সালে প্যালেস্টাইনী নেতা ইয়াসির আরাফাত মারা গেলে মাহমুদ আব্বাস পি,এল,ও’র প্রেসিডেন্ট হন ২০০৫ এর জানুয়ারীতে । মাহমুদ আব্বাস মিশরের “শার্ম-আল শেখ” এ ইজরায়েলের সাথে প্রতিশ্রুত শান্তি চুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যাক্ত করেন। সেপ্টেম্বর ২০০৫ এ ইজরায়েল একতরফাভাবে গাজা থেকে সেনাবাহিনী এবং ইজরায়েলী বসতি প্রত্যাহার করে নেয়। তবে গাজার আকাশ এবং, সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রন থেকে যায় ইজরায়েলের হাতে। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে স্থলপথে গাজা ভুখন্ডের চারদিকে ইজরায়েল গড়ে তুলেছে সুউচ্চ কাটাতারের প্রাচীর বেস্টনী।

২০০৫ সালে মিশর অনুরুপভাবে গড়ে তুলেছে প্রাচীর বেস্টনী। ফলে গাজা কার্যতঃ এক অবরুদ্ধ ভুখন্ড। শুধুমাত্র ৫টি নির্ধারিত পথ দিয়ে গাজার অধিবাসী ফিলিস্তিনীরা মিশর এবং ইজরায়েলের মধ্যে চলাচল করতে পারে । ২০০৬ সালে প্যালেস্টাইনী সঙ্গঠন হামাস নির্বাচনে জয়লাভ করে। শুর হয় প্যালেস্তাইনের অপর সঙ্গঠন ফাত্তার সাথে যুদ্ধ।

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে মক্কায় হামাস সংগঠনের রাজনৈতিক প্রধান খালিদ মিশাল এবং মাহমুদ আব্বাসের মধ্যে চুক্তির ফলে হামাস সদস্য ইসমাইল হানিয়াকে প্রেসিডেন্ট করে গঠিত হয় প্যালেস্টাইনী জাতীয় সরকার। কিন্তু ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে। ২০০৭ সালের জুন মাসে হামাস গেরিলারা গাজার প্রশাসনিক এবং সামরিক স্থাপনাগুলো দখল করে নেয়। মাহমুদ আব্বাস জাতীয় সরকার ভেঙ্গে দেন। অতঃপর পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রন থাকে প্যালেস্টাইনী কতৃপক্ষের হাতে এবং গাজা থাকে হামাস নিয়ন্ত্রাধীন।

সুত্র- . ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।