আমি মহামায়া বহুদিন পর আস্তানায় ফিরে এলাম।
আস্তানা মানে ছদর আলী বোর্ডিং। বছরখানেক ধরে এখনে আছি। আমার ফুপাতো ভাই বাদলের জ্বালায় আগের মেসটা ছেড়ে দি্যেছিলাম। ছদর আলী বোর্ডিং টা খুব একটা খারাপ না।
আগেরটার মত এটাও মজিদের আবিষ্কার।
মজিদের বোনটা মারা গেছে। গত মাসে। মজিদকে আমি কখনই কাঁদতে দেখিনি। বোনের মৃত্যু সংবাদ শুনেও সে কাঁদলনা।
ভাবলেষহীন মুখে শুধু বলল হিমু, চল গ্রামের বাড়ি যেতে হবে।
মজিদ আমার রুমমেট। তার সাথে যে আমার গলায়-গলায় সম্পর্ক তা-না। কিন্তু তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম শুধু এই কারণে যে ছোট ছোট দুটা ভাগ্নে-ভাগ্নিকে দেখেও সে নির্বিকার থাকতে পারে কিনা,কান্নাকাটি করে কিনা সেটা দেখা।
যে ভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক, নির্বিকার থাকার এক অসামান্য ক্ষমতা অর্জন করেছে মজিদ।
কোনকিছুতেই তার বিস্ময় নেই,আগ্রহ নেই।
রূপাকে প্রথমবার দেখলে সব পুরুষই একটা ছোটখাট ধাক্কার মত খায়। সেই রূপার সাথে মজিদ কে একবার বসুন্ধরা সিনে কমপ্লেক্সে পাঠিয়াছিলাম। শো শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছিল।
অথচ এই নির্বিকারত্ব অর্জন করার কত চেষ্টাই না আমি করেছি।
আমার প্রয়াত পিতা আমাকে মহাপুরুষ বানানোর জন্য যে অসংখ্য উপদেশ বাণী লিখে রেখে গিয়েছিলেন তার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নির্বিকারত্ব। বাবা লিখে গেছেন
"নির্বিকারত্ব অর্জন"
বাবা হিমালয়! মহাপুরুষগণের গুণাবলীর মধ্যে নির্বিকারত্ব হইল একটি অন্যতম গুণ। মহাপুরুষ কখনই বিস্মিত হয়না। কোন কিছুতেই বিচলিত হয়না। হে বৎস! এই নির্বিকারত্ব অর্জন করিবার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট থাকিবে।
জগতের মায়া-মমতা,বিস্ময়-আবেগ যেন তোমাকে গ্রাস করিতে না পারে সে ব্যাপারে অতি অবশ্যই সচেতন থাকিবে। ......
আমার পিতার উপদেশ আমি মেনে চলতে পারিনি। মজিদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জড়িয়ে পড়লাম এক অদ্ভুত মায়ায়। ছোট ছোট দুটি দেবতুল্য এতিম শিশু কে দেখে মনে হল বিধাতা মাঝে মাঝে কী নিষ্ঠুর খেলাই না খেলেন!
অথচ মজিদ কী নির্বিকার!ফুলের মত দুইটা ভাগ্নে-ভাগ্নিকে কোলেও নিলনা। দুদিন পরেই সে ঢাকা ফিরে আসতে চাইল।
আমি এইদিন না-সেইদিন না করে একমাস দেরি করলাম। মায়া বড়ই কঠিন জিনিস!
২.
রুমের জানালায় কোন গ্রিল নেই। ছিল কোন এক কালে। হয়ত পাড়ার বখাটে ছেলেটার গাঞ্জা খাওয়ার নেশা উঠেছিল,নিজের মনে করে খুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু গ্রিলের কাঠামোটা রয়ে গেছে।
"নদী শুকিয়ে গেছে,চিহ্নটা শুকায়নি"। কার যেন কবিতা এটা?সুনীলের নাকি হেলাল হাফিজের?
ঘুম থেকে উঠে এসব আবোল-তাবোল ভাবছিলাম। চায়ের অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে। জানালার বাইরের দিকের কার্নিসে দুধের কৌটা দিয়ে বানানো একটি বিশেষ ধরনের ঘন্টি লাগানো আছে। ঘন্টির দড়িটা বাঁধানো আছে রুমের ভিতরে খাটের পায়ার সাথে ।
দড়ি ধরে টান দিলেই ঘন্টিতে ঠনঠন শব্দ হয়। আর শব্দ হলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা হাজির। আমি দড়ি ধরে টান দিই আর "হীরক রাজা"র মত বলি
"দড়ি ধরে মার টান
চা হবে হাজিরান"
সরু গলির এপাশে আমাদের মেস,আর ওপাশে হোটেল। হোটেলের নামটি একটু অন্য রকম। "দি হোটেল বাপের দোয়া"।
এ জাতীয় হোটেলের নাম সাধারণত "বিসমিল্লাহ হোটেল" অথবা "মায়ের দোয়া হোটেল" কিংবা নিদেনপক্ষে "ছলিমুল্লা ভাত-মাংসের হোটেল" কিসিমের হয়। এ ধরনের নাম আমার জীবনে প্রথম দেখা। নামের কারণ টা জানা লাগবে।
হোটেলের মালিক দেখতে অনেকটা আমার বড় মামার মত। আমার মামারা ছিল পিশাচ প্রকৃতির।
মালিক ভদ্রলোক অবশ্য পিশাচ প্রকৃতির না। তিনি ধুর্ত প্রকৃতির। ধুর্ত প্রকৃতির বলেই তিনি মাঝে মাঝে শিয়াল রান্না করেন। তবে সেই শিয়াল সবাইকে খাওয়াননা। তার জন্য স্পেশাল খরিদ্দার আছে।
তিনি ফেন্সিডিলের ব্যবসাও করেন। চায়ের কাপে ফেন্সিডিল দেন। তার অনেক খরিদ্দার।
এসব কথা তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন। আমার রুমের বিশেষ ঘন্টির ব্যবস্হাটাও তিনিই করে দিয়েছেন।
কোন এক অদ্ভুত কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করেন। তার নামটাও অদ্ভুত। শাহ আহমেদ চৌধুরী। এ ধরণের নাম হোটেল ব্যবসার সাথে যায়না।
পৃথিবীতে একমাত্র শাহ আহমেদ চৌধুরীই আমাকে হিমালয় নামে ডাকেন,কেন ডাকেন জানিনা।
তিনি মাঝে মাঝে আমাকে বলেন "বুঝছেন হিমালয় ভাই,টাকা-পয়সা কিছুইনা। টাকা-পয়সা হইল তেজপাতা। আমি তেজ-পাতা জমাইতাছি। যখন বস্তা-বস্তা তেজপাতা জমব, তখন আল্লাহর নামে হজে যামু। সব তেজপাতা পুড়াই ফেলামু।
কী কন,হিমালয় ভাই ?"
আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পোষা কাকটার কাকা ডাকে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল। এই কাকটা প্রতিদিন আমার চায়ের উচ্ছিষ্ট অংশ খেয়ে যায়। আমি চা খেয়ে কাপটা জানালায় রেখে দিই। কাকটা এসে বাকিটুকু খটখট করে খায়।
সেই হিসেবে এটি আমার পোষা হয়ে গেছে। আজকে ব্যাটা পুরো চা-টাই খেয়েছে।
আমি কাকটাকে বললাম ক্যায়া ভাই চিড়িয়া,চায়ে আচ্ছা লাগতা হ্যায় ক্যায়া?অউর পিনেকা ইরাদা হ্যায়?
কেন যেন আমার মনে হয় কাকেরা বাংলার চেয়ে হিন্দি ভাল বুঝে।
৩.
শুয়ে শুয়েও বঝতে পারলাম কেউ একজন দরজা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। দরজার দিকে মাথা রেখে শোয়ার কারণে কে উঁকি দিচ্ছে সেটা আমার পক্ষে বুঝা মুশকিল।
কিন্তু আমি একশত ভাগ নিশ্চিত যে ভদ্রলোক বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার বদরুল সাহেব। উনি প্রায়ই এই কাজটি করেন। কেন করেন জানিনা।
আমি ডাকলাম-বদরুল সাহেব,ভিতরে আসুন।
বদরুল সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
গলা খাকারি দিয়ে তিনি তার অপ্রস্তুত অবস্হা কাটানোর চেষ্টা করলেন। তিনি এইভাবে অনেকবারই ধরা পড়েছেন। প্রত্যেকবারই অপ্রস্তুত হয়ে যান এবং সেটা কাটানোর জন্য গলা খাকারি দিতে থাকেন।
-হিমু ভাই, আসব?
-আসতেই তো বলালাম।
- কেমন আছেন,হিমু ভাই? কাল রাতে আসলেন বুঝি? আমি তো ছিলাম না......তারপর...... শরীর-স্বাস্হ্য ভাল?
-ভালো,সবই ভালো।
আপনার খবর-টবর কী?
বদরুল সাহেব গলার টাই টা একটু ঢিলা করে নিয়ে আমার বিছানায় বসলেন। তিনি বি.এ. পাশ করেছেন এবং সেই দাবিতে তিনি সকাল থেকে রাত অবধি গলায় টাই ঝুলিয়ে রাখেন।
-টবর তো ভালো,কিন্তু খবর ভালো না। বউয়ের অসুখ। এদিকে মেয়েটার আবার সামনে বৃত্তি পরীক্ষা।
ক্লাস এইটের বৃত্তি। জুনিয়র বৃত্তি-বুঝেন তো কেমন কঠিন। মেয়েটার রোল আবার এক।
-হুমম,খবর তো দেখছি খারাপ। তাইলে টবর টা ভালো হইল কেমনে?
-এক জায়গায় সি.ভি. দিয়েছি।
নবাবপুরের এক বড় মেশিনারির দোকানে,ক্যাশিয়ারের পদ। টাকা-পয়সার হিসাব আর যোগ-বিয়োগের কারবার। আপনাকে তো বলেছি আমি গণিতে কত ভালো ছিলাম। মেট্রিক পরীক্ষায় গণিতে লেটার মার্কস্ পেয়েছিলাম। ৯০ সালের মেট্রিকের গণিত পরীক্ষাটা কেমন কঠিন ছিল শুনেছেন তো।
জ্যামিতির অন্তস্হ কোণ আর পরিধিস্হ কোণের সম্পর্কের উপপাদ্যটা গোটা হলের কারোরই কমন ছিলনা। আমাদের ফার্স্টবয়েরও না। একমাত্র আমারই কমন ছিল। আর ঐ যে পীথাগোরাসের উপপাদ্যটা......
বদরুল সাহেব তার গণিত-কীর্তির কথা কম করে হলেও এক হাজারবার আমাকে শুনিয়েছেন। নতুন করে আর শুনতে চাইনা।
তাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম-তো বদরুল সাহেব, চাকরি টা কি হবে?
-অবশ্যই হবে। আমার বউয়ের মামাতো ভাইয়ের দুলাভাই সেই দোকানের ম্যানেজার। তিনিই আমাকে সি.ভি. দিতে বলেছেন। বিশাল বড় দোকান।
বদরুল সাহেব এর আগেও বহু জায়গায় সি.ভি পাঠিয়েছেন, ভাইভা দিয়েছেন।
প্রত্যেকবারই বলেছেন চাকরিটা একেবারে নিশ্চিত। এবারের টা হবেই। কোন মিস নাই। বিফলে মূল্য ফেরত।
কিন্তু কোনবারেই হয়নি।
কেউ কথা রাখেনি। তবুও তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রবার্ট ব্রুসের মত অপরিসীম অধ্যবসায়ী।
হঠাৎ "কিছু একটা মনে পড়েছে" ভঙ্গীতে বদরুল সাহেব বললেন -ওহো হিমু ভাই, আপনার একটা চিঠি আছে। খুব সুন্দর একটা আপু গত পরশু এসে দিয়ে গেছেন।
বলেছেন আজকে আবার আসবেন।
-কৈ দেখি। রূপা এসেছিল নাকি?
না। রুপা ম্যাডাম কে তো আমি দেখেছি। ইনি আরেকজন।
এই যে নিন।
বদরুল সাহেব আমাকে চিঠিটা দিলেন। সাদা খামের উপর গোটা গোটা মেয়েলী হাতে লিখা
"রুনিজা বাদল ইসলাম, বনানী"
হায় খোদা! বাদল কি বিয়ে করেছে নাকি? মেয়েটা কি বাদলের বউ?আমার ঠিকানা পেল কি করে?
আজকে সে কি আবার আসবে?
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।