প্রথম পর্ব
সূর্যোদয় দেখা হল জঙ্গলের ভেতরে।
জঙ্গলে সূর্যোদয় কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ব্যাখ্যা করি। রেমা কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে পাহাড়ের পাদদেশে ধানক্ষেত আছে। আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে - ওই অঞ্চলে প্রধান শস্যই হল ধান।
পাহাড়ের ধারে আমরা সব মিলিয়ে চারটে ধানক্ষেত পেয়েছি - প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, এই ধানক্ষেতের অপরপাশ দিয়ে বোধহয় আধাঘন্টা আগে গিয়েছিলাম। এরকম মনে হওয়ার কারণ হল জঙ্গলে ঢোকার আধাঘন্টা বাদেই আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে গল্প পরে আসছে। দশটাকা দিয়ে টিকেট কেটে জঙ্গলে ঢুকে রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগোতেই প্রথম যে ধানক্ষেতটা পড়ল, তারই অপরপ্রান্তে সূর্যটা দেখা গেল - গাছগুলোর মাথা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
আব্দুর রহমান ভাইয়ের কটেজে খাওয়ার খরচ অনেক।
রাতের খাবারে রেট ছিল জনপ্রতি দুইশ টাকা। বাজার থেকে অনেক দূরে কটেজ অবস্থিত বলে রেট বেশী - এটা আব্দুর রহমান ভাইয়ের যুক্তি। আমরা যারা ঘুড়ে বেড়াই, তারা সবাই মোটামুটি গরীব মানুষ। কত কম খরচে ঘুরে আসা যায় তা আমাদের প্রত্যেক ট্যুরের অন্যতম টার্গেট থাকে। রাতের খাবারটা আমরা পাউরুটি কলা দিয়ে চালিয়ে দিলাম।
অবশ্য শায়েস্তাগঞ্জে বাস থেকে নামার এক ঘন্টা আগে ভালো পরোটা পড়েছিলে পেটে। রাতের কলা রুটিতেই সকালের নাস্তা হল। তারপর বাজারের দোকানে রঙ চা।
এই জঙ্গলের প্রবেশ মুখে ভালো ম্যাপ পাওয়া গেল না যেমনটি পাওয়া গিয়েছিল লাউয়াছড়ার জঙ্গলের প্রবেশমুখে। রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষন যেতেই এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হল।
তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন বামদিকে গেলেই ওয়াচটাওয়ার পাওয়া যাবে। আর ম্যাপ দেখে আমরা জেনেছিলাম ওয়াচটাওয়ারটা একঘন্টা ট্রেইলের শুরুর দিকেই আছে। ঢুকে পড়লাম ট্রেইলে - কিছুদূর যেতে ওয়াচটাওয়ারের দেখা পাওয়া গেল।
ওয়াচটাওয়ার থেকে তোলা ছবি (ছবি: মাহদী)
ওয়াচটাওয়ার থেকে নেমে সামনের দিকে এগোতে দুটো পথ পাওয়া গেল - দুটোই পায়েচলা সরু পথ। আমরা বামদিকের পথটা ধরলাম।
সেই পথ কিছুদূরে গিয়ে একটা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে চলল। আরও কিছুদূরে গিয়ে পথ ধানক্ষেতের আইল ধরে ক্ষেতের অপর পারে চলে গেল। কোন বসতিতে ঢুকে পড়বো ভেবে পিছু ফিরে এলাম। কিছুদূর ফিরে দেখলাম একটা রাস্তা ডানদিকে চলে গিয়েছিল - আমরা ভাবলাম এটাই বোধহয় প্রথমদিকের ডানদিকের রাস্তাটা। ঢুকে পড়লাম।
দারুন অভিজ্ঞতা। জঙ্গল ঘন হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। বসে বসে যেতে হল। কাটায় শার্ট আটকে যায়। মিনিট পাচেক আগানোর পরে জঙ্গল হালকা হল এবং আমরা বুঝতে পারলাম - আমরা পথ হারিয়েছি।
জঙ্গলে পথ হারানো মানে যে কোন পথ নেই তা কিন্তু নয়। অনেক পথ কিন্তু কোনটা কোথায় যাবে সেটা জানা নেই। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বেসিসে এগোতে হবে। গাইড নেয়া যেত। ভালো গাইড রহিম ভাইয়ের চার্জ নাকি হাজার বারোশ টাকা।
চার পাচশ টাকায়ও গাইড পাওয়া যেত। কিন্তু ওই গাইড থাকলে কি আর পথ হারানো সম্ভব হত?
পথ হারিয়ে যখন আমরা এদিক সেদিক ঘুরছি, তখনই আমরা জঙ্গলের আসল সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারলাম। গাছে গাছে পাখি। খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়েও তাদের দেখা যায় না। তার বদলে দেখা যায় বিশাল বিশাল কুচকুচে কালো রং এর কাঠবেড়ালী।
এই বড় কাঠবেড়ালি নাকি শুধু এই জঙ্গলেই আছে। আর দেখা যায় বানর, মুখপোড়া হনুমান। এই ডাল থেকে সই ডালে তীব্র চিৎকার সহযোগে লাফ। শুধুমাত্র বানর আর কাঠবেড়ালি দেখার জন্য আমরা ভুলে গেলাম যে আমরা পথ হারিয়েছিলাম - ট্রেইলে উঠতে না পারলে ঘুরে বেড়াতে হবে শুধু। একজন উপজাতি চাষীর সাথে দেখা হয়েছিল এক ধানক্ষেতের পাশে গাছের গোড়ায়।
তার নির্দেশনায় আমরা পার হয়েছি একটি ধানক্ষেত, উঠে এসেছি নতুন এক ট্রেইলে। সেই ট্রেইল ধরে হাটলে নাকি রেমা কালেঙ্গার মূল ট্রেইলে পৌছা যাবে। জঙ্গলের ছবি দেখি।
এক জায়গায় জোকের কামড়ও খেতে হল। এই জোক চোষা শুরু করতেই ব্যাথা লাগছিল, তাই শুরুতেই টের পাওয়া গেল।
অন্যদেরও দুই একটি করে ধরেছিল।
এবার লোকদের দেখা পাওয়া যেতে লাগল। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা রাস্তা দেখিয়ে দেয়। আর তাদের দেখানো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমরা মূল ট্রেইলে পৌছে গেলাম। ততক্ষনে পেরিয়ে গেছে আড়াই ঘন্টা।
এবার শুধু ট্রেইল ধরে হাটা। ঘন্টা দেড়েক হাটলে পৌছা যাবে রেমায়। ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমরা রেমায় পৌছে গেলাম।
রেমা বিটের সাথেই যে পাড়া (নামটা ভুলে গেছি) সেই পাড়ার বাচ্চারা
রেমা বিট থেকে আবার হাটতে হল পাক্কা এক ঘন্টা। অন্য কোন উপায় নাই।
শরীর বিশ্রামের জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু এখানে কোথাও থামার উপায় নাই। থামতে হলে চুনারুঘাটে। চুনারুঘাটে পৌছুতে হলে পার হতে হবে নদী। সেই নদীতে পানি কম।
নদী পার হয়ে গাড়ি পাওয়া গেল। গন্তব্য চুনারুঘাট। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।