যে মতাদর্শের জন্য জীবনের প্রায় গোটাটাই তিনি উৎসর্গ করেছেন, ঘটনাসন্নিপাত এমনই যে সেই মতাদর্শের সার্থক রূপায়ণের দিনটিতেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। তবে চার বছর আগে। ১৯১৩ সালের ৭ই নভেম্বর। বুধবারই বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে মহান নভেম্বর বিপ্লব দিবস, তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে, নতুনতর উৎসাহে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশ-বিদেশের মানুষ। কলকাতা বা পশ্চিমবাংলাতেও তার অন্যথা হয়নি।
বরং রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নভেম্বর বিপ্লব দিবস উদ্যাপনে এবছর নতুন মাত্রা এনেছিল এক কমিউনিষ্ট বিপ্লবীর শততম বর্ষে পদার্পণ।
ছাত্র থাকার সময়েই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে যাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। কমিউনিষ্ট আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে দেশের গণআন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে থেকে আজ জীবনের উপান্তে ১০০তম জন্মদিবস অতিক্রম করলেন সমর মুখার্জি। এই বিরল ঘটনাকে স্মরণীয় রাখতে ব্যাতিক্রমী এক অনুষ্ঠানে সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত বললেন, ১৯৪০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার পর থেকে গত ৭২ বছর ধরে পার্টি অফিস বা পার্টি কমিউনেই জীবন কাটিয়েছেন সমর মুখার্জি। তাঁর গোটা জীবনটা এমনই, যা প্রতিটি কমিউনিষ্টেরই হওয়া উচিত।
তিনি আমাদের মধ্যে আজো আছেন, এজন্য আমরা খুশি। আমরা চাই তিনি আরো অনেক বছর আমাদের মধ্যে থাকুন, আমাদের আন্দোলনে উৎসাহ যোগাতে, সাহস যোগাতে, তাঁকে চোখের সামনে দেখে তাঁর জীবন ও কর্মধারাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার সুযোগ করে দিতে।
কমিউনিস্টরা কোনো নেতার জন্মদিবস পালন করে না। একমাত্র ব্যাতিক্রম কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মদিন পালন। ১৯৬৩ সালে একটা বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, যখন কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচী নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না, তখন এই ব্যাতিক্রমী অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
একইভাবে, দেশের গণআন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের এই শীর্ষ নেতার শততম জন্মদিবসের মতো বিরল ঘটনা উপলক্ষে তাঁকে সংবর্ধিত করার ব্যাতিক্রমী সিদ্ধান্ত নেয় সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। বুধবার তাঁর বাসস্থান, ৯, দিলখুসা স্ট্রিটে পার্টি কমিউনের সামনেই বাম আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা সমর মুখার্জির হাতে তুলে দেন পুষ্পস্তবক। পার্টির রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু তাঁর হাতে তুলে দেন মানপত্র, যাতে তাঁর সংগ্রামী জীবনকে চুম্বকে তুলে ধরা হয়েছে। বিমান বসু তা পাঠ করেন দিলখুসা স্ট্রিটের উপ্চে পড়া সভায়।
পরে সমর মুখার্জির বিপ্লবী জীবনের কয়েকটি দিক সংক্ষেপে তুলে ধরে বিমান বসু বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের হাওড়া জেলার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছিলেন সমর মুখার্জি।
এমনকি প্রদেশ কংগ্রেসেরও সদস্য ছিলেন তিনি। পরে কমিউনিষ্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সেই চল্লিশের দশকেই হাওড়া জেলায় কুম্ভকারদের জীবনে কিভাবে সঙ্কট নেমে আসছে, শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিতে তার ব্যাখ্যা করে ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখেছিলেন সমর মুখার্জি। পরবর্তী জীবনে শ্রমিক আন্দোলন ও গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন সমর মুখার্জি। প্রথমে বিধায়ক এবং পরে সাংসদ হিসাবে প্রতিনিয়ত মেহনতী মানুষের কথা আইনসভায় তুলে ধরেছেন তিনি।
বিমান বসু বলেন, ওপার বাংলা থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের জন্য লড়াই করতে সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ (ইউ সি আর সি) তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। উদ্বাস্তুদের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে কখনো দিল্লি, কখনো কলকাতায় সরকারের কাছে গিয়ে হাজির হতেন তিনি।
প্রকাশ কারাতও তাঁর জীবনের উজ্জ্বল কয়েকটি দিক তুলে ধরে বলেন, সমর মুখার্জি গোটা দেশের কমিউনিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের একজন সৈনিক ও পরবর্তীকালে শীর্ষ নেতা ছিলেন। সাংসদ হিসেবেও লোকসভা ও রাজ্যসভায় তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। কারাত বলেন, পার্টি থেকে যখন তাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি তা এতটাই নিখুঁত ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করতেন যে তা সকলের কাছে শিক্ষণীয় ছিল।
প্রয়াত কমরেড জ্যোতি বসু প্রায়শই সমর মুখার্জি সম্পর্কে বলতেন, উনি হচ্ছেন ‘গড’স্ ওন ম্যান’। ইংরাজী পরিভাষায় যার অর্থ হচ্ছে, সমস্ত দিক থেকে নিখুঁত একজন ব্যক্তি।
১৯৭১ সালে সমর মুখার্জি লোকসভায় পার্টির সহকারী দলনেতা থাকার সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার কথা বলেন প্রকাশ কারাত।
কতটা কৃচ্ছ্রসাধন করে তিনি দিন কাটাতেন, তার উদাহরণ তুলে প্রকাশ কারাত বলেন, সাংসদ হিসেবে তাঁর মাসিক ভাতার অধিকাংশটাই পার্টি তহবিলে জমা দেওয়ার পরেও যা অবশিষ্ট থাকতো, সেই টাকাও প্রতিবছর কোনো এক সময়ে কখনো ৫০হাজার, কখনো ৬০হাজার টাকা পার্টি তহবিলে জমা দিয়ে দিতেন। অর্থাৎ তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সেই টাকা কখনো ব্যয় করতেন না।
বিমান বসুও এদিন বলেন, সমরদা রাজ্য দপ্তরেও এভাবে টাকা জমা দিতেন। তাঁর জীবনধারাতে তিনি দেখিয়েছেন যে একজন কমিউনিষ্টের জীবন-যাপনে অত টাকা লাগে না। তাঁর জীবনধারা-কর্মধারা থেকে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাম আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষ, যিনি কিছুদিন আগেই নব্বই বছরে পা দিয়েছেন। সমর মুখার্জির শততম জন্মদিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তিনি বললেন, শুধু সি পি আই (এম)-ই নয়, গোটা ভারতের সাম্যবাদী-সমাজবাদী আন্দোলনে, বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং পরবর্তী সময়ে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমর মুখার্জির মতো নেতাকে আমরা পেয়েছি, এজন্য গর্বিত। একজন পশ্চিমবঙ্গীয় হয়েও পুর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের স্বার্থে আজীবন তিনি যে লড়াই করেছেন, তা প্রেরণাযোগ্য।
বুধবার সকাল থেকেই দলে দলে মানুষ এসেছেন ফুল-মিষ্টি-মালা নিয়ে তাঁদের প্রিয় নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে এসেছে অসংখ্য শুভেচ্ছাবার্তা। দেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের প্রবীণ নেতা এ বি বর্ধন শুভেচ্ছাবার্তায় বলেছেন, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার একমাত্র লক্ষ্যে আপনার গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন, সর্বদা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা।
একটি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন কমিউনিষ্ট বিবেকই আপনার দীর্ঘ জীবনের গোপন রহস্য। আপনার জীবন সকলের কাছে প্রেরণার উৎস। লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চ্যাকটার্জি সকালেই পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছেন। সঙ্গে তাঁর নীরোগ জীবন কামনা করে পাঠানো বার্তায় বলেছেন, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের মুক্তিযুদ্ধে আপনার বিরল অবদান ও নিরলস প্রচেষ্টা আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছে।
এদিন অনুষ্ঠানে সমর মুখার্জির জীবনের ওপর বিভিন্ন জনের লেখা ও তাঁর নানা লেখা নিয়ে এন বি এ-র পক্ষ থেকে দুটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
ইংরাজী সংকলনটি প্রকাশ করেন প্রকাশ কারাত এবং বাংলা সংকলনটি প্রকাশ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সি পি আই (এম) হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে সংকলিত একটি বইয়েরও প্রকাশ করেন প্রকাশ কারাত। অনুষ্ঠানে সি পি আই-র রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদার, সি পি আই (এম) পলিট ব্যুরো সদস্য সুর্যকান্ত মিশ্র, এ কে পদ্মনাভন, আর এস পি নেতা সুকুমার ঘোষ, মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিম চ্যাপটার্জি, এস পি-র জন্মেঞ্জয় ওঝা, ডি এস পি নেতা প্রবোধ সিনহা, আর সি পি আই নেতা মিহির বায়েন, ওয়ার্কাস পার্টির নেতা শৈবাল চ্যাটার্জিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এদিন বিকালেই সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ (ইউ সি আর সি)-র পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয় সমর মুখার্জিকে। সংগঠনের সভাপতি কান্তি বিশ্বাস, নেতা রবি গাঙ্গুলি, কৃষ্ণকুমার দাস, হরিপদ দাস প্রমুখ মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
ই এস আই সি এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কর্মচারী আন্দোলনের নেতা অজয় মুখার্জিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।