আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন ওবামার উত্থান

বক্সে জমা থাকি , কলমের আগার খসখসে দাগ, ভাঁজ করে পকেটে অবস্থা অতপর ঝুড়িয়ে নিক্ষিপ্ত..... কিন্তু অসংখ্য গুরুত্বপূর্ন লেখালেখির সাক্ষী তিনি আজ বিশ্বনেতা। শুধু মার্কিন জনগণ নয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যাকে নতুন এক বিশ্ব গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কঠিন এক সময়ে এসে দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে তিনি আজ ইতিহাসের এক মহানায়ক। মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে এক কঠিনতম সময়ে নিজেকে এক আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেলেন বারাক ওবামা। ২০০৪ সালে যার রাজনীতির মঞ্চে আরোহণ, তিনি আজ বিশ্বনেতা।

একজন কালো বর্ণের মানুষের পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব হলো, তা হয়তো অনেকের কাছে রহস্যময়। জন্ম থেকেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয়েছে তাকে। শিশুকালে বাবার বিচ্ছেদ, স্কুলজীবনে বর্ণবাদের সে নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা, বাবার মৃত্যু ট্র্যাজেডি, অধিকারবঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের অভিজ্ঞতাই ওবামাকে পৌঁছে দিয়েছে সবার উপরে। আজকের এই ওবামা একদিনে তৈরি হননি। তার ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যাবে, বিশ্বনেতা হিসেবে গড়ে ওঠার সব রহস্য।

পুরো নাম বারাক হোসেন ওবামা। জন্ম ১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট। তার বাবা সিনিয়র বারাক ওবামা একজন আফ্রিকার ইমিগ্রান্ট এবং মা অ্যান ডানহাম ছিলেন কানসাসের অধিবাসী। বারাক ওবামার বাবার জন্ম কেনিয়ার নিয়ানজা প্রদেশে। তিনি ছোটবেলায় বেড়ে ওঠেন ছাগল চরানো রাখালদের সঙ্গে।

তবে নিজের লেখাপড়া তিনি চালিয়ে যান। তার স্বপ্ন ছিল মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমানো। তার সে স্বপ্ন একদিন পূরণ হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ে। এখানেই তার পরিচয় হয় অ্যানের সঙ্গে।

সেই পরিচয় থেকেই তাদের মাঝে পরিণয়। ১৯৬১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারা বিয়ে করেন। এর ৬ মাস পর জন্ম হয় ওবামার। ওবামা তার জন্মদাতা বাবার আদর আর ভালোবাসা কখনও পাননি। ওবামার জন্মের পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই তার মা-বাবার দাম্পত্য জীবনে শুরু হয় টানাপড়েন।

আলাদা বসবাস শুরু করেন তারা। এরই মাঝে ওবামার বাবা পিএইচডি করার জন্য চলে যান হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে ওবামার বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখন তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে ওবামার বাবা ফিরে যান কেনিয়ায়। ওই বছরই ওবামার মা অ্যান বিয়ে করেন লোলো সোয়েটরো নামে এক ইন্দোনেশীয় ছাত্রকে।

এর এক বছর পর অর্থাত্ ১৯৬৬ সালে অ্যান তার নতুন স্বামী ও ছেলে ওবামাকে নিয়ে পাড়ি জমান জাকার্তায়। ওই বছরই জাকার্তায় জন্ম হয় ওবামার সত্ বোন মায়ার। পরবর্তী কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে অ্যানের পরিবারে। অ্যান তার শিশুছেলে ওবামার জীবনের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরে তিনি ওবামাকে হাওয়াইয়ে বসবাসরত তার নানা-নানির কাছে পাঠিয়ে দেন।

তখন ওবামার বয়স ১০ বছর। পরে ওবামার মা ও বোনও ফিরে যান হাওয়াইয়ে। ওবামার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হয় জাকার্তায়। হাওয়াইয়ে ফিরে আসার পর তাকে ভর্তি করা হয় পুনাহো একাডেমিতে। এখান থেকেই তিনি ১৯৭৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এই একাডেমিতে পড়ার সময় বর্ণবাদ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করেন ওবামা। এ সম্পর্কে পরে ওবামা বলেছেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমিসহ মোট তিনজন ছিলাম কালো বর্ণের। আমাকে কেউ পছন্দ করত না। বর্ণবাদ নিয়ে আমার মাঝে নানা ধরনের অনুভূতি কাজ করত। মাঝে মধ্যে আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম আর অবাক হয়ে ভাবতাম, আমার সমস্যাটা কোথায়।

’ বুঝতে শেখার পর ওবামা তার বাবাকে একবারই দেখেছেন। ১৯৭১ সালে অল্প সময়ের জন্য হাওয়াইয়ে এসেছিলেন তিনি। ওবামার বাবার শেষ জীবন ছিল ট্র্যাজেডিতে ভরা। সেই ট্র্যাজেডি সম্পর্কে ওবামা বলেন, ‘এটা ছিল ১৯৮১ সালের কথা। আমার বয়স তখন ২১ বছর।

এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা তার দুই পা হারান। তার চাকরি চলে যায়। তিনি বন্দি হয়ে পড়েন হুইল চেয়ারে। ১৯৮২ সালে নাইরোবির রাস্তায় তিনি আবার সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। ওই দুর্ঘটনায় নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ।

বাবার এমন মৃত্যু আমার কাছে আজও রহস্যময়। ’ ওবামা তার বাবা সম্পর্কে পরে বলেন, ‘ঐব রং নড়ঃয সড়ত্ব ধহফ ষবংং ঃযধহ ধ সধহ.’ বারাক ওবামা পরে লস অ্যাঞ্জেলসের অক্সিডেন্টাল কলেজে দুই বছর লেখাপড়া করেন। সেখান থেকে তিনি চলে আসেন নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৩ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। দুই বছর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর ১৯৮৫ সালে ওবামা সিকাগোতে চলে আসেন।

সিকাগোতে তিনি একটি চার্চ গ্রুপের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি নিম্ন আয়ের মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য মনোনিবেশ করেন। এরই মাঝে তিনি কেনিয়া সফরে যান। সেখানে তিনি তার বাবা ও দাদার কবর দেখতে যান। ওই কবরস্থান পরিদর্শন ছিল ওবামার জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবা ও দাদার দুই কবরের মাঝখানে দীর্ঘসময় বসে ছিলাম। আমার মধ্যে এক ধরনের অনুভূতি তৈরি হলো। এমন অনুভূতি অতীতে কখনও হয়নি। আমার চোখের সামনে তখন আমেরিকার জীবন। সেখানে কালো মানুষের জীবন, আমার জীবনের হতাশা এবং আমার দিনগুলোর কথা—সবকিছুই ভাসছিল।

নতুন এক অনুভূতি নিয়ে আমি কেনিয়া থেকে ফিরলাম। ’ ১৯৮৮ সালে ওবামা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে ভর্তি হন। এর এক বছর পর সিকাগোর একটি ল’ ফার্মে তিনি ইন্টার্নশিপ করতে যান। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় মিশেল রবিনসনের সঙ্গে। সিকাগো শপিং সেন্টারের সামনে তারা নিয়মিত ডেটিং করতেন।

অতঃপর ১৯৯২ সালের ৩ অক্টোবর তারা বিয়ে করেন। মালিয়া ও সাশা নামে দুই কন্যাসন্তান তাদের। রাজনীতিতে যোগদানের আগে সিকাগোতে সিভিল রাইটস বিষয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন ওবামা। সিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সাংবিধানিক আইন বিষয়ে শিক্ষকতাও করেন। ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতাকারী হিসেবে ২০০২ সালে তিনি সবার নজর কাড়েন।

তার বক্তৃতা মোহাছন্ন করে সবাইকে। ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় কনভেনশনে মূল প্রবন্ধ তিনি উপস্থাপন করেন। ওই বছরই তিনি ইলিনয় থেকে সিনেট সদস্য নির্বাচিত হন। ওবামা বরাবর একটি উদ্দেশ্যভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করায় বিশ্বাস করতেন। সিনেটর হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা মাত্র ৪ বছর, আর সে মানুষটিই কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান! তিনি আবার কালোদের একজন! যাদের একদিন দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ যেন এক অবাস্তব স্বপ্ন।

কিন্তু সে স্বপ্নকেই তিনি বাস্তবে রূপ দিলেন। ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়নপ্রার্থীর লড়াইয়ে হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিলেন। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইনের বিরুদ্ধে। নতুন এক স্লোগান নিয়ে হাজির হলেন ওবামা—‘উই নিড চেঞ্জ, চেঞ্জ উই ক্যান’। এই একটি স্লোগান সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিল।

রচিত হলো এক নতুন ইতিহাস। হোয়াইট হাউসের কর্তা হলেন একজন কালো মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বকে নতুন এক স্বপ্ন দেখালেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বারাক ওবামা তার নিজ শহর শিকাগোর গ্রান্ট পার্কে যে ভাষণ দেন, তা ছিল এক অসাধারণ বিজয়-ভাষণ। ২০০৮ সালে নভেম্বরের ৪ তারিখ রাতে দেয়া ওই ভাষণের প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিল প্রায় আড়াই লাখ।

আর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে টিভি, ইন্টারনেট ও রেডিওতে তা দেখেছেন-শুনেছেন কোটি কোটি মানুষ। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘ইয়েস উই ক্যান। চেঞ্জ হ্যাজ কাম’। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত একজন অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার সেই সাড়াজাগানো ভাষণে আলোচিত হয় যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্বের তখনকার মূল সমস্যাগুলো। তিনি রিপাবলিকান ভোটার—যারা তাকে ভোট দেননি—তাদের উদ্দেশে বলেন, আমি আপনাদেরও প্রেসিডেন্ট হব।

এ সময় তিনি আবেগমথিত কণ্ঠে তার পরলোকগত নানির প্রসঙ্গও টানেন—যিনি ওই নির্বাচনের মাত্র দুই রাত আগে পরলোকগমন করেন। চার বছর পর ২০১২ সালের ৬ নভেম্বরের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত ওবামা প্রমাণ করেছেন, তিনি আমেরিকার সবার প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। নয় তো দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়া তার পক্ষে অতটা সহজ ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এটি ছিল কঠিনতম এক লড়াইয়ের নজির। গত চার বছরে তিনি অন্তত বিশ্বে যুদ্ধের দামামা বাজাননি।

ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের। মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের সমাধানে তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। নিজ দেশে স্বাস্থ্যনীতি, অভিবাসন নীতি, অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওবামার যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত সত্যিকার অর্থেই তাকে বিশ্বনেতার আসনে আসীন করেছে। আর এ বিশ্বনেতা এবার তার সেরাটাই দিতে চান সূত্র এখানে বারাক ওবামা পারলে আমি পারবো না কেন??????  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.