আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

MY FAVOURITE PERSON --- আমার প্রিয় ব্যাক্তি

জামাত-শিবির দূরে গিয়া মর! স্কুলের পরীক্ষায় বেশ কয়েকবার এই বিষয়ে রচনা লিখতে হয়েছে। কখনো রবি বাবু, শরৎবাবু, কাজী সাহেব কখনো বা ভাষানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা কে নিয়ে লিখেছি। মাঝে মাঝে রচনার খাতিরে বিদেশী পারসনদের (আইনষ্টাইন, নিউটন, নেপেলিয়ন) রচনায় ইমপোর্ট করেছি। কিন্তু আসলে আমার প্রিয় ব্যাক্তিটি কে? স্যরি বস! এ ব্যাপারে আমি একটু আলাদা। রবি ঠাকুর, আইনষ্টাইন, শেরেবাংলা সহ ট্রেডিশনাল ফেভারিট লিষ্টের সবাই মহাপুরুষ।

এরা পৃথিবীর সবারই প্রিয় পুরুষের কাতারে। আমি সাধারন এক ম্যাংগো পাব্লিক, আমার প্রিয় মানুষটাও আমার মতই আরেকজন ম্যাংগো পাব্লিক। তাকে মহা পুরুষের কাতারে ফেলা যায় না, দু-দশজন ছাড়া তেমন কেউ তাকে চেনে না। মানব কল্যানে তিনি জীবন উৎসর্গ করেননি, দেশের সেবায় আত্মত্যাগও করেননি। তবুও তিনিই আমার প্রিয় ব্যাক্তি, মাই ফেভারিট পরসন।

তিনি আর কেউ নন, তিনি আমার বাবা । আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আমাদের গরিব বলা যায় না, আবার আমরা বড়লোকও নই, উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা চলে। বাবা যতটুকু বিষয় সম্পত্তি করেছেন তার সবই নিজের চেষ্টায় করা। তিনি একজন সেল্ফ মেইড ম্যান।

বাবার বিয়ের বছর না ঘুরতেই দাদা-দাদি আর চাচাদের সাথে মনেমালিন্যের জের ধরে তিনি আমার মাকে সঙ্গে নিয়ে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। তারপর নিজের চেষ্টায় এতদূর এসেছেন। বাড়ি ছেড়ে চলে আসলেও তিনি তার দায়িত্ব ভুলেন নি। বড়ভাইকে বিদেশে পাঠিয়েছেন, ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়া করিয়েছেন, দাদাবাড়ির পুরো সংসার একা চালিয়েছেন। আমার চাচাদেরকে নিজের খরচে বিয়ে করিয়েছেন, তিন ফুফুর সবারই বিয়ের সম্পূর্ন দায়িত্ব একা নিয়েছেন।

বড় চাচা আর ছোট চাচাকে ঢাকায় ব্যবসা গড়ে দিয়েছেন। যদিও এখন তার ভাই-বোন কেউ তাকে প্রতিদান দেয়া দূরে থাক, তার অবদান স্বীকারও করে না। তবুও আমার বাবার মনে এ নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। আমার বাবাকে নিয়ে আমি সব সময় উচু গলায় বলি আমার বাবা সারাজীবন সৎ পথে উপার্জন করেছেন, কখনো অসৎ টাকায় হাত বাড়াননি। এমন কি তিনি কখনো ঘুষ, উপহার, ডোনেশন দিয়ে ফায়দা হাসিলের সুযোগ নেননি।

আমি যখন ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠি, তখন জিলা স্কুলের এক টিচার মাত্র দশ হাজার টাকা চেয়েছিলেন, আমাকে এ্যাডমিশন এর সুযোগ করে দেবার জন্য। কিন্তু বাবা রাজি হননি। আমার বড় বোনের সরকারী চাকরির জন্য সাতলাখ টাকার অপশনটিও লাথি দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ছোটচাচার সাথে তথ্যমন্ত্রীর অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্বেও তিনি এ সুযোগটিও নেননি। তার এক কথা, শিক্ষা বা চাকরির শুরুটাই যদি অসৎ উপায়ে হয়, তবে ভবিষ্যতে আমরা কখনোই সৎ জীবন-যাপন করতে পারবো না।

ঐ ঘটনার দু বছর পর আমি আমার মেধার খাতিরেই জিলা স্কুলে এ্যাডমিশন পেয়েছি, এবং সেখান থেকেই স্কুল জীবন শেষ করেছি। যদিও বড় আপার সরকারি জবটা হয়নি, তবে সেও এখন খারাপ পজিশনে নেই। আমার বাবা আমাকে অনেক ভালবাসেন। দুই মেয়ের পর আমি তার তৃত্বীয় এবং সর্বকণিষ্ঠ সন্তান। আমার জন্মের পর আমার বাবাকে তার বন্ধুরা তাকে কাধে করে পুরো এলাকা মিছিল করেছে।

ছোটবেলা থেকেই বাবা আমাকে অতিরিক্ত ভালবাসেন। তবে সেটা তিনি প্রকাশ করতে চান না। আমার বাবা চরম জেদী এবং একরোখা। কোন জিনিস একবার মাথায় ঢুকলে সেটা তিনি পূরন করবেনই। আমার বড়চাচা আমাকে সাইকেল কিনে দেবার বাহানায় দু মাস ঘুরিয়েছিল।

এই ঘটনাটা বাবা ঠিকভাবে নিতে পারেননি। তিনি আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিলেন সাথে সাথে বড় চাচার মেয়েটাকেও একটা সাইকেল কিনে দিলেন। যদিও বড় চাচা এই ঘটনার পেছনের কাহিনী কিছুই বুজতে পারেন নি। একবার এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে দেখি খাবার সর্ট পড়ে গেছে, হৈ চৈ, হুলুস্থুল কান্ড। সেদিন দাওয়াতে খেতে পারিনি ঠিকই, তবে আমার বাবা আমাদের সবাইকে চাইনিজ রেস্তোরায় খাইয়েছিলেন।

আমার বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতা একদমই সামান্য, সোজা ভাষায় আমার বাবা স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। তবুও তিনি তার ছোট ভাই বোনদের সবাইকেই উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। আমাদের তিন ভাই-বোনকেও উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন। আমার দাদা ছিলেন জমিদার বংশের ছেলে। তিনি এবং তার ভাই উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল পরিমান সম্পদ পেয়েছিলেন।

আমার দাদা কোন কাজ করতেন না, তার কাজই ছিল ভ্যাগাবন্ডের মত ঘুরে বেড়ানো আর সম্পত্তি বিক্রি করে বসে বসে খাওয়া। বসে বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। ফলে ছোট বেলাতেই আমার বাবাকে গোটা সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এবং তিনি সেটা ভালোভাবেই পালন করেছিলেন। আগেই বলেছি আমার বাবা আমাকে অনেক ভালবাসেন।

তিনি কখনো আমাকে ধমক দেন না, কখনো মারধোর করেন না। তবে একবার মেরেছিলেন। আমার তখন দশ-বারো বছর বয়স। কি করেছিলাম মনে নেই, তবে বাবা আমাকে চড় মেরেছিলেন। এবং সেদিন রাতেই দেয়ালে ঘুষিয়ে ঘুষিয়ে তার হাত ফাটিয়ে ফেলেছিলেন।

পরে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিলো। ছোটবেলায় একবার প্রথম আলোর গোল্লাছুট পাতায় আমার একটা গল্প ছাপা হয়েছিল। তিনি সেটি লেমিনেটিং করে রেখেছিলেন এবং সবাইকে সেটা দেখিয়ে বেড়াতেন। এখনও সেটা তার কাছে আছে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন তিনি আমাকে কাধে নিয়ে ঘোড়া হতেন এবং দিনের বেলা আমাকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।

একবার আমার খুব শখ হলো বরশি দিয়ে মাছ মারবো। তখন পুকুর টুকুর শুকিয়ে মাঠ হয়ে গেছে। আমার বাবা আমাকে নিয়ে পদ্মায় চলে গেলেন মাছ ধরতে। সেদিন বড় কোন মাছ পাইনি, তবে বড় একটা তৃপ্তিতে মন ভরে গিয়েছিল। আমাকে নিয়ে প্রায়ই ষ্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতেন এবং বাদাম, ছোলা ভাজা, পাপড়, আইসক্রিম যা খেতে চাইতাম খাওয়াতেন।

ছোটবেলায় একবার আমার পায়ে লোহার কিল ঢুকে গিয়েছিল। ঠিকমত হাটতে পারতাম না। সে সময় আমার বাবা পুরো একমাস নফল রোজা রেখেছিলেন। রাতে অনেক সময় নিয়ে নফল নামাজ পড়তেন, আর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতেন। আমাদের বাপ-বেটার পছন্দ কিন্তু একেবারেই আলাদা।

আমার পছন্দ আবাহনী বাবার মোহামেডান। আমি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করি বাবা ব্রাজিল, আমি বার্সেলোনা বাবা রিয়াল, আমি ঢাকা গ্লাডিয়েটর্স বাবা চিটাগং কিংস। আমি গরুর মাংস পছন্দ করি বাবা খাসীর মাংস ভালবাসেন। কখনো আবার আমাদের পছন্দ এক রকম। দুজনেই টম এন্ড জেরী পছন্দ করি, দুজনেই এ্যাকশন মুভি পছন্দ করি।

দুজনেই সাকিব আল হাসানের ফ্যান। ব্লগিং নিয়েও বাবার সাথে অনেক কথা হয়। বাবা ব্লগিং বোঝেন না। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এইগুলো আবার কি? আমি বুঝিয়ে বলেছি। শেষে বলেছিলাম ব্লগিং অনেকটা ডায়েরী লেখার মতো।

আমি যখন ব্লগ ডেতে যাই তখনো বাবার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করি। ব্লগ ডে থেকে ফিরে কি কি হলো সব বলি। ঢাকা থেকে আসার পর একদিন ব্লগ ডের ছবি গুলো দেখালাম। আর ব্লগ ডের ঘটনাগুলোও বললাম। আরজু পনিকে পানি সাধার ব্যাপারটা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিলেন।

শিপু ভাই এর নাম শুনেই বললেন এই ছেলে কি রাজনীতি করে নাকি? আমি বললাম কেন? বাবা বললেন নামের সাথে ভাই লাগানো! সামু ব্লগের এডমিন জানা’র সাথে তোলা ছবি দেখে বললেন আরে এতো একেবারে বাচ্চা মেয়ে!(সামু এডমিন হিসেবে বয়স্ক কোন মহিলাকে আশা করেছিলেন) আমি বললাম ইনার নিজেরই ফুটফুটে দুটো বাচ্চা মেয়ে আছে। ঢাবি থেকে মিরপুরে ফিরে আসার ঘটনা শুনে এস আর জনি আর অন্যজনকে একসময় চা খাইয়ে ধন্যবাদ জানাতে বললেন। যদিও তাদের চা খাওয়াবার সুযোগ আর পাইনি। যদিও বাবা ব্লগিং ব্যাপারটা বোঝেন না, তবুও রাজীবের মৃত্যুর পর একদিন আমাকে তিনটা চামড়ায় বাধানো দামী ডায়েরী এনে দিয়ে বললেন এই ডায়েরী লেখ, ব্লগিং করার দরকার নাই। আমার বাবা দামী সিগারেট এর প্রতি দূর্বল।

শুনেছি আগে একরকম সিগারেট ছিল যা কিনা হাতে বানাতে হত (যন্ত্র ছিল), তামাক আলাদা কিনতে হত। বেশ দামী ছিল। বাবা সেই সিগারেট খেতেন। ঢাকা থেকে আসার সময় বাবাকে এক প্যাকেট বেনসন আর পাচটা সিগার উপহার দিয়েছিলাম। তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন।

যদিও চেহারায় মেকি রাগ ফুটিয়ে আমাকে বকা দিয়েছিলেন। জানি না সবার বাবাই এমন কিনা, তবুও আমার বাবাকে আমি পছন্দ করি। তাই আমার প্রিয় পুরুষ হিসেবে কোন মহা পুরুষ বা সুপারহিরোর দরকার নেই। আমার বাবা যেই হোক, যেমনই হোক; সেই আমার সুপারহিরো। আমার বাবাই আমার ফেভারিট পারসন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।