আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাঙ পারাতি কয় আনা? রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... গাঙ পারাতি কয় আনা? ১. কাদের মাঝিকে চেনে না এমুন মানুষ দশ গ্রামে নাই। বুড়ো খুড়ো গুরো সবাই চেনে কাদের মাঝিকে। আহা আমি যদি কখনো কাদের মাঝি হতে পারতুম! ছোটবেলায় কাদের মাঝি ছিল আমার প্রথম আইডল। সারাদিন কতো যে অচেনা মানুষের সঙ্গে কাদের মাঝি কথা বলেন। কতো যে অজানা বিষয়ে কাদের মাঝি খোঁজ খবর নেন।

কতো রাজ্যের খবর যে থাকে আমাদের কাদের মাঝির কাছে। কাদের মাঝি আসলে একাই একটা রেডিও স্টেশান। ভোররাতে এই স্টেশান চালু হয়। চলে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত। মাঝখানে দুপুরবেলায় একবার এই রেডিও স্টেশানের কেবল ঘোষক বদল হয়।

তখন কাদের মাঝি হয়তো দুপুরের নাওয়া খাওয়ার জন্য বাড়ি যায়। তার পরিবর্তে তখন খেয়া নায়ের হাল ধরে কাদের মাঝির ছেলে ঝড়ু। ঝড়ু বয়সে একটু বড় হলেও আমাদের সঙ্গে খাতির খুব বেশি। সেই খাতিরের অছিলায় আমরা ইশকুল ফাঁকি দিয়ে ঝড়ু’র সাথে কাদের মাঝি’র খেয়া নায়ে বিনা পয়সায় গাঙ পারাই। খামাখা কতোবার যে বলেশ্বরের এপার ওপার যাই, তার হিসাব নাই।

কখনো সামন্তগাতীর ওপারে। কখনো বরইবুনিয়ার ওপারে। কখনো বানিয়ারীর এপারে। কখনো যদি কোনো পারে খেয়া পারানোর মানুষ থাকে বেশি, আমরা তখন সেই পারে নেমে যাই। ঝড়ু সবাইকে অন্য পারে নামিয়ে দিয়ে পরে আমাদের হয়তো পার করে।

কখনো কখনো আবার ঝড়ু অন্য কোনো পারে ইচ্ছে করেই বসে থাকে, যাতে আমরা কাউ কাউ করি। অনেক সময় আমাদের কাউ কাউ শোনার অপেক্ষায় ঝড়ু মাঝ নদীতে ইচ্ছে করেই বসে থাকে। তখন তিন পার থেকেই মানুষ ঝড়ু ঝড়ু বলে হাউ কাউ শুরু করে। ঝড়ু তখন খেয়া নায়ের মাঝখানের পাটাতন সরিয়ে পানি খেচার ভান করে। কখনো কখনো সত্যি সত্যিই পানি খেচে।

কিংম্বা খেয়া নাও পরিস্কার করে। তিন পারের মানুষের হাউ কাউ একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই ঝড়ু তার বুদ্ধি মতো কোনো এক পারে খেয়া ভিড়ায়। কিন্তু কেউ যদি ঝড়ুকে মারতে উদ্দত হয় কিংম্বা গালি পারে তখন ঝড়ু মাঝ নদীতেই মনের আনন্দে বসে থাকে। গান না জানলেও বাবার মতো গান ধরে। আমার সোনার ময়না পাখি...।

তখন মনে হতো ঝড়ু এই রাজ্যের প্রেসিডেন্ট। বরাবরই কাদের মাঝি আসার আগেই আমাদের সটকে পরার নিয়ম। ঝড়ু’র অমুন খামখেয়ালীতে যদি আমরা সামন্তগাতী বা বরইবুনিয়ার ওপারে আটকা পড়ি, কাদের মাঝি আসলে তখন আমাদের সাঁতার কেটেই নদী পারাতে হতো। নতুবা ভুলে কখনো কাদের মাঝি’র খেয়ানায়ে উঠলে গাঙ পারানোর পয়সার বদলে সন্ধ্যার আগেই ইশকুল ফাঁকি দেওয়ার নালিশ চলে যেতো বাড়িতে। আর তখন পরবর্তী কয়েক দিন ঝড়ু’র সাথে আমাদের চলতো রাজ্যের যতো অভিমান।

এমনিতে কাদের মাঝি’র খেয়া নায়ে গাঙ পারাতে বড়দের জন্য এক টাকা, আর মহিলা ও আমাদের মতো লিলিপুটদের জন্যে আট আনা লাগতো। তাছাড়া সারা বছর পারাপারের জন্যে যারা কাদের মাঝিকে ধান দেয় তাদের কোনো পয়সাই লাগতো না। প্রতি বছর ধান কাটা শেষ হলেই কাদের মাঝি আর ঝড়ু বলেশ্বরের তিন পারে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান কালেকশান করতো। প্রতি বছর অনেকের চেয়েই আমরা কাদের মাঝিকে বেশি ধান দিতাম। সেই হিসেবে আমাদের পয়সা না লাগারও কথা।

কিন্তু পয়সার বদলে কাদের মাঝি বাবার কাছে যে খামাখা নালিশ করতেন সেটাই ছিল তাকে ভয় পাবার কারণ। আর যখন কাদের মাঝি’র উপর আমাদের বেশি হিংসে হতো তখন তার ঝাল মিটাতাম আমরা ঝড়ু’র উপর। ঝড়ুকে আমরা দেখলেই তখন কোরাস ধরতাম- কাদেরের পোলা ঝড়ু, পথে মরা গরু। গরুর নাই শিং, তাধিন তাধিন। গরুর পচা গন্ধ, ইশকুল আজ বন্ধ।

ঝড়ু’র পাছায় গু, ছিঃ ছিঃ, ওয়াক থু, ওয়াক থু... ২. একবার কাদের মাঝি আমাদের উপর ভীষণ চটলেন। আগাম ঘোষণা দিলেন, ‘ঝড়ুকে নিয়ে যারা ছড়া বানাইছে, ধরতি পারলি তাগো হাড় মাংস গুড়া বানাই দিমু’। ওই ঘোষণার পর থেকেই আমরা আসলে একটু বেশি বেশি ইশকুল মুখী। কিন্তু সময় পেলে মনসুরের রাইস মিলের সামনে দুপুরের দিকে আমরা তখনো একটু জটলা পাকাতাম। ঝড়ু যখন বরইবুনিয়ার ওপার মানুষ পার করে বানিয়ারীর এপারে আসতে থাকতো তখন আমাদের জটলা থেকে কোরাসের ভলিউম বাড়তো।

ওই দিন কীসে যে কী হল, কাদের মাঝি হয়তো নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই বাড়ি থেকে ফিরলেন। আমরা কেউ তা খেয়াল করিনি। দানবের মতো হঠাৎ কেত্থেকে কাদের মাঝি সেখানে এসে হাজির হলেন। আর আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই টিরিপ কাদের মাঝি’র বাজখাই কব্জায় বন্দী হল। আমরা যেভাবে যে পারলাম ভো দৌঁড়।

টিরিপ কাদের মাঝি’র রাক্ষসি হামলার খবলা থেকে রেহাই পেল পেচ্ছ্বাব করে নিজের প্যান্ট ভেজানোর পর। তার আগে অবশ্য কাদের মাঝি টিরিপের কাছ থেকে আমাদের সবার নাম ধাম ইত্যাদি জেনে নিয়েছেন। মনসুরের রাইস মিলের পার্মানেন্ট চাল ঝাড়ুণি ছিল ফতের মেয়ে জোছনা, যাকে আমরা তখনো খুদবুড়ি হিসেবে ক্ষেঁপাতাম। সেই খুদবুড়ি সেদিন কাদের মাঝি’র উপর উল্টো চড়াও হলেন টিরিপকে বাঁচাতে। টিরিপ ছাড়া পেতেই খামাখা বিবাদে জড়িয়ে গেলেন কাদের মাঝি আর ওই খুদবুড়ি।

সেই বিবাদে কার দোষ কতোটুকু বা বেশি তা নির্নয় করা তখন ভারী কঠিন। কারণ, মনসুরের রাইস মিলে তখন চলছিল কানাই মণ্ডলের ধান ভানা। ধান ভানার কাজ সহযোগীদের উপর চাপিয়ে ওই বিবাদ ঠেকাতে তখন সেখানে নাক গলালেন স্বয়ং কানাই মণ্ডল আর খোড়া বজলু। ঘটনা তখন আর শুধু ঝড়ু’র ছড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। কবে কখন কোথায় খুদবুড়ি কার কার চাল চুরি করেছিল, কাদের মাঝি তখন অকথ্য ভাষায় সেইসব ফিরিস্তি দিলেন।

খুদবুড়ি বা কম কীসে? খুদবুড়িকে তখন বাগে আনে এমুন সাধ্য কার? কোন বার কোন ভোটের সময় কোন চেয়ারম্যান প্রার্থীর টাকা খেয়ে কাদের মাঝি খেয়া পারাপারে কতো সময় কতোবার ফাঁকি মেরেছিলেন সেই হাড়ির খবর ঠায় মুখের উপর বলে দিলেন খুদবুড়ি। কাদের মাঝি আর খুদবুড়ির বিবাদের সূত্রে উভয়ের গুনধর সব বিখ্যাত কুখ্যাত অখ্যাত ঠাপানি তখন এমুন পর্যায়ে পৌঁছালো যে কানাই মণ্ডল আর খোড়া বজলু ওই বিবাদ থেকে নিজেরাই পিছিয়ে গেলেন। সেদিন ছিল হাটবার। তখন বলেশ্বরের তিন পারে অনেক লোকের জটলা। কারণ, খেয়া নিয়ে মাঝ নদীতে বসে তখন ঝগড়া দেখছিল আমাদের বন্ধু ঝড়ু।

এক সময় কাদের মাঝি নিজেই বিবাদ স্থান মানে মনসুরের রাইস মিলের ফ্রন্ট সাইড ত্যাগ করলেন। আর কাদের মাঝির চিক্করে ঝড়ু যখন খেয়া নিয়ে এপারে ভিড়লো তখন খুদবুড়ি’র উপর জমানো রাগ গিয়ে খামাখা আবার চড়াও হল ঝড়ু’র উপর। কাদের মাঝি যে নিজের ছেলে ঝড়ুকে অমুন মার মারতে পারে তা কেউ সেদিন কল্পনাও করতে পারেনি। সেদিন ছিল তারাবুনিয়ার হাট। হাট করতে অপেক্ষমাণ হাটুরেরা তখন কাদের মাঝিকে অনেক কষ্টে থামালেন।

আর ঝড়ু চোখ মুছতে মুছতে মুখস্থ ঠুটস্থ দুনিয়ার সব গালাগালি আওড়াতে আওড়াতে মনসুরের রাইস মিলের পেছনে গিয়ে খাঁড়ালো। মনসুরের রাইস মিলের পেছনে ছিল পাশাপাশি অতি আশ্চর্য ম্যানমেড দুই পাকা পুকুর। পুকুরের তলদেশ আর চারপাশ ছিল পাকা। ওই দুই পাকা পুকুর নিয়ে আমরা এর আগে বহুত গবেষণা করেছিলাম। পাশাপাশি দুই পাকা পুকুরের একটার পানি ভারী গরম।

আরেকটার পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। গরম পানির পুকুরে রাইস মিল থেকে একটা পাইপ থেকে কল চালুর সময় অনবরত পানি পরতো। কিন্তু ঠাণ্ডা পানির পুকুরের রহস্য তখনো আমাদের অজানা। সেই রহস্যের জাল ভেদ করতেই ঝড়ু তখন সেখানে গবেষণায় লেগে গেল। ওই দুই পাকা পুকুরের পেছনেই ছিল খুদবুড়ি’র আস্তানা।

ঝড়ুকে একাকী ওভাবে খাঁড়াতে দেখে খুদবুড়ি কী ভাবলো কেউ জানে না। কোন এক ফাঁকে খুদবুড়ি রাইস মিল থেকে পেছনে তার আস্তানায় ঢুকলো। নিজের লান্স করার সময় তখনো ঠিক হয় নাই। কিন্তু খুদবুড়ি তার হাড়ি পাতিল থালায় কিছুক্ষণ টুং টাং সব শব্দ করলো। মাটির বাসনে ভাত, ভ্যাদা মাছ, লাউ শাক আর বেগুন ভর্তা বারলো।

তারপর সুপারির খোলের ঝুপড়ির ফাঁক গলিয়ে ঝড়ুর উদ্দেশ্যে হাঁক ঝাড়লো- ‘ওই নাঙ্গের পো, এই দিকে আয়’। ঝড়ু তখনো দুনিয়ার সেরা গবেষণায় ভারী ব্যস্ত। একটু আগে নিজের বাবাকে যে খুদবুড়ি অতোগুলো মানুষের সামনে ইচ্ছে মতো ঠেঙ্গিয়েছে তার কথায় ঝড়ু’র কর্ণপাত না করারই কথা। ঝড়ু মনের ভুলেও ঝুপড়ির ওপাশের সেই কর্কশ কণ্ঠের মায়াবী আহবানকে পাত্তা দিলো না। বরং মনের ক্ষোভ মেটাতে একটার পর একটা ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়তে লাগলো নিশ্চল ঠাণ্ডা পানির পুকুরের ঠিক মাঝখানে।

ছোট ছোট ঢেউ গুলো চার পাশের বদ্ধ পাকা দেয়ালে মিলিয়ে যাবার আগেই পেছন থেকে খপ করে খুদবুড়ি ঝড়ুকে হ্যাচকা এক টান মারলো। দুনিয়ার কোনো ইতিহাসে সেই হ্যাচকা টানের ভাব তাৎপর্য লেখা নাই। তবু ঝড়ু হাতের ঢিলটি না ছুঁড়েই খুদবুড়ির জবু থবু কাঁচা খুপরির ভেতর নিমেষে আত্মসমর্পণ করলো। এমনিতে খুদবুড়ির যৌবনকালে একবার বিয়ে হয়েছিল চালিতাবাড়ির কেতাব ফকিরের সঙ্গে। চৌদ্দ বছর সেখানে ঘর সংসার করার পরেও কোনো বাচ্চা কাচ্চা হয় নাই।

কেতাব ফকির মারা যাবার তিন বছর আগে বাজা খেতাব দিয়ে খুদবুড়িকে তখন তালাক দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিল। বছর খানেকের মধ্যে খুদবুড়ির অবশ্য আবারো একটা নিকা বিবাহ হয়েছিল আমাদের গ্রামের মসজিদের তখনকার খাদেম ইজ্জ্বত মুন্সীর সঙ্গে। কিন্তু বছর না যেতেই মসজিদের দানবক্সের টাকা চুরির অপরাধে ইজ্জ্বত মুন্সীকে গ্রামবাসী হাতে নাতে ধরে কিছু উত্তম মাধ্যম দিয়ে বিদায় করে দেওয়ায় খুদবুড়ি’র আর কোথাও যাবার সুযোগ রইলো না। পরে অবশ্য অনেকেই নাকী খুদবুড়িকে বিবাহ করার খায়েস দেখিয়েছিল। কিন্তু খুদবুড়ি নিজেই নাকী নতুন করে বিবাহে আর রাজী হয় নাই।

তখনো সবাই জানতো এই খুদবুড়ি ছিল কানা লইত্যা আর ফতের একমাত্র কন্যা ওই সময়ের দাপুটে সুন্দরী জোছনা বেগম। কেউ কেউ বলতো বাজা জোছনা। মনসুরের রাইস মিলে চাল ঝাড়ুণির কাজ নেবার পর থেকে ধীরে ধীরে বাজা জোছনা থেকে সে হয়ে গেল খুদবুড়ি। একমাত্র ভোটার লিস্ট ছাড়া জোছনা বেগম নামে যার আর কোনো অস্তিত্ব নাই। ঝড়ুকে আয়েসি ঢঙ্গে খুব স্বস্থির সঙ্গে ভাত গিলতে দেখে খুদবুড়ির চোখের কোনায় অকারণে কেনো যেনো চিকচিক করে উঠলো।

নাকী খুদবুড়ির নিজের কোনো ছেলেমেয়ে যে নাই, সেই নিদারুণ সত্যকে চাপা পাথরের মতো বুকের গহীনে অনন্তকাল আটকে রাখার যে অদৃশ্য জ্বালা, সেই অর্ন্তজ্বালার হঠাৎ অমুন বহিঃপ্রকাশে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে সে আবার যৌবনের জোছনা হয়ে উঠেছিল। নইলে এতোদিন পর খুদবুড়ির অন্তরে হঠাৎ আজ কীসের এতো উতলধারা? সেই উথলিয়া বিষের ধারার দিকে ঝড়ুর চোখ পড়তেই বুকের আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে খুদবুড়ি খুপরি থেকে এক ঝটকায় বেড়িয়ে গেল। ওপাশে মনসুরের রাইস মিলের ডুগ-ডুগ ডুগ-ডুগ গর্জণে খুদবুড়ি’র উচ্চারিত কোনো ভাষা বোঝার আর কোনো উপায়ই রইলো না। ..................................... চলবে................. ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।