মনের মহাজন খুঁজে ফিরি.... প্রতি বছরই একটি করে মাছের প্রজাতি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। মিঠা পানির মাছের প্রায় ২০ শতাংশ প্রজাতিই বিপন্ন। এর মধ্যে সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় ৪০ প্রজাতির ছোট মাছ। এ-জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসভূমি এতটাই দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, টিকে থাকার উপযোগী জায়গা সংকীর্ণ হতে হতে কোথাও কোথাও প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া এবং ছোট মাছ সংরক্ষণে আইন না থাকায় ছোট প্রজাতির মাছ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
আবার পুকুরেও বড় মাছ চাষের আগে ছোট মাছ বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ মাছের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। এতে হারিয়ে যাচ্ছে ছোট প্রজাতির
বিভিন্ন মাছ।
বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা এসব মাছের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাতাসি, কাজলি, বাইলা, মলা, ঢেলা, বাটা, পুঁটি, বাইম, রানী, পাবদা, টেংরা, পোয়া, মোয়া, কাকিলা, খলিসা, ছোট চিংড়ি, চান্দা, টাকি, চ্যাং, গুতুম/গতা, চ্যাপিলা, ভেদা, তারা, মেনি, তিতপুঁটি, খোকসা, খরকুটি, দেশী জাতের শিং ও কৈ, দারকিনা, পটকা, কাশ খয়রা, টাটকিনি, গোলসা, রয়না, তেলা টাকি, তারাবাইন ও শালবাইন।
দেশী জাতের এসব ছোট মাছ পাওয়া যায় মূলত হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর ও বিভিন্ন নদীতে। একসময় এ-জাতীয় মাছের উৎস হিসেবে সুনামগঞ্জের হাওর, ভৈরবের বিল, নাটোরের চলনবিল, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, নওগাঁর বিভিন্ন বিল, কুমিল্লার মৎস্য এলাকাসমূহ, হাকালুকি বিল এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিলের সুনাম ছিল। এখন এসব উৎস থেকে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কারণে দেশবাসী পুষ্টিগুণসম্পন্ন মাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও উদ্বেগজনক।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেটিভ ন্যাচারের (আইইউসিএন) এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে গত এক দশকে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায়
২০ প্রজাতির মাছ। এ ছাড়া ৫৪ প্রজাতির মাছ রয়েছে বিলুপ্তির পথে।
এর মধ্যে ২৮ জাতের মাছ রয়েছে বিপন্নপ্রায় এবং ১৪ জাতের মাছের অবস্থা সংকটাপন্ন। মহাবিপন্ন বা চরম হুমকিতে রয়েছে আরও ১২ প্রজাতির মাছ। সংগঠনটির হিসাবে একসময় বাংলাদেশে ৭৩৫ প্রজাতির মাছ ছিল। এর মধ্যে ৫১১ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি। সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে মিঠা পানির মাছসহ ২৬০ জাতের মাছ বিলুপ্ত হতে থাকবে বলে তাদের আশঙ্কা।
নীরবে ঘটে যাওয়া দেশী প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি প্রত্যক্ষ করছেন বিলসংলগ্ন জনগোষ্ঠীও। নওগাঁর আত্রাই এলাকার বেলাল হোসেন জানান, কোনো রকমের চাষ ছাড়াই এ এলাকার বিলে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশী মাছে। অথচ বিলের অধিকাংশ এলাকা এখন ফসল চাষের আওতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার ও পানিস্বল্পতার কারণে এখন আর মাছই পাওয়া যাচ্ছে না।
যাত্রাবাড়ীর কয়েক দশকের মৎস্য ব্যবসায়ী ও মৎস্য আড়ত সমিতির সভাপতি মো. আবু বকর সিদ্দিক। ছোট প্রজাতির মাছের সরবরাহ কমার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাজধানীতে দুটি কারণে ছোট মাছের চালান কমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়া হচ্ছে প্রধান কারণ। এর সঙ্গে বেড়ে গেছে স্থানীয় চাহিদা। কাপ্তাই লেক কিংবা সুনামগঞ্জের হাওরসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ বাজারে এক দশক আগেও প্রতিদিন দেশী প্রজাতির ছোট মাছ আসত ২০-২৫ টন।
অথচ এখন তা নেমে হয়েছে ১২-১৪ টনে। চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা এখন এ-জাতীয় মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে মাছের উৎপাদন ৩০-৩২ লাখ টন। এর মধ্যে দেশী প্রজাতির বিভিন্ন ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ টন, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের উৎপাদনের প্রায় ৩২ শতাংশ। এ-জাতীয় মাছ বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে মৎস্য অধিদফতরের চিহ্নিত অবক্ষয়িত জলাশয় উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং দেশী প্রজাতির ছোট মৎস্য সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইকবাল আযম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।
বিলুপ্তির পথেও রয়েছে অসংখ্য মাছ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাভূমি বিশেষ করে হাওর-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, প্লাবনভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে (মে-জুন) বৃষ্টি না হওয়ায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। এ ছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, কল-কারখানার রাসায়নিক ও বর্জ্য পদার্থ জলাশয়ে ফেলা, অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার।
আকারে ছোট হলেও এসব মাছ পুষ্টিগুণে সেরা। তাই এসব মাছ বিলুপ্তির কারণে পুষ্টির বড় উৎসও হারিয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূইয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, বড় মাছে শুধু প্রোটিন থাকে। কিন্তু ছোট মাছে প্রোটিন ছাড়াও ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন ও ভিটামিন ‘এ’ থাকে, যা চোখ ভালো রাখে ও দেহ গঠনে সহায়তা করে। এ ছাড়া কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে, ফুসফুসের প্রদাহ কমায় এবং দাঁত ও হাড়ের গঠন ভালো রাখে।
তবে মৎস্য অধিদফতর এ-জাতীয় মাছ রক্ষার্থে কিছু কার্যকর উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ছোট প্রজাতির দেশী মাছ কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার জন্য পদক্ষেপও নিচ্ছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে, পোনা মজুদ ছাড়াও মৎস্য অভয়াশ্রম উদ্ধার ও নতুন অভায়শ্রম প্রতিষ্ঠা করা। জলাশয়ে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ ফেলা রোধ করা, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, ক্ষতিকর মৎস্য আহরণের যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং নিষিদ্ধ মৌসুমে ও নিষিদ্ধ জলাশয়ে মাছ না ধরার বিষয়ে জনসচেতনা বাড়ানো।
মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, বিদ্যমান মৎস্য রক্ষা আইন দিয়েই ছোট মাছ রক্ষা করার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে জনসচেতনতা থেকে শুরু করে মাছের অভায়শ্রম তৈরি সবই আছে। একই সঙ্গে মাছের কৌলিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, গবেষণার মাধমে কৃত্রিম প্রজনন, চাষ পদ্ধতি এবং বংশ বৃদ্ধির উপায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে
সূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।