আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৭১ থেকে ৭৫ - অস্থির সময়, অসহায় সময়

জোর হোক শুধু গলার আওয়াজ, গায়ের জোরটা তোলাই থাকুক আমি ওই সময়টা বোঝার চেষ্টা করছি অনেক দিন ধরে। যতখানি সম্ভব লেখাপড়ার চেষ্টা করছি। লেখাপড়ার সাথে সাথে ভাবনা বদলায়। ভাবনার সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যায়। আমার এখন পর্যন্ত মনে হয়েছে: সে সময়টা একটা অদ্ভুত সময় ছিল।

অন্য কোন সময়ের সাথে তা মেলানো যাবে না। পরবর্তী বাংলাদেশে কোন পরিস্থিতির সাথেই না। ৯ মাসের যুদ্ধ আমাদের দেশের মানুষগুলোকে হঠাৎ বদলে দিয়েছিল। এতখানি বদলেছিল যা কল্পনায় আনা কঠিন। সংগ্রাম শেষ হবার আগেই - কি পেলাম, কি পাইনি পরিস্থিতির মুখে নিজেদের ঠেলে দিয়েছিল।

অস্থির হয়ে গিয়েছিল। এখানেই সবচেয়ে বড় সর্বনাশ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ করা পর্যন্ত সবার একই এজেন্ডা ছিল - স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রত্যাশা একটি স্বাধীন দেশের। তার মধ্য দিয়েই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি।

যুদ্ধের পরে অন্তত ১০ বছর কঠিন ত্যাগের মধ্য দিয়েই তা হয়ত সম্ভব ছিল। স্বাধীনতার পরের মাস থেকেই প্রত্যেকের নিজের নিজের এজেন্ডা তৈরি হয়ে গেল। জনতার অর্থনৈতিক মুক্তির এজেন্ডা লাথি মেরে। সবাই উঠিয়ে নেয় ব্যক্তিগত চিরস্থায়ী অর্থনৈতিক মুক্তির এজেন্ডা। অন্য সরকারের সময় সরকারি দলের লোকজন লুটপাট করে।

বিরোধীরা চুপ করে থাকে। সে সময় বাংলাদেশের সকল মানুষ সরকারি দলের, অল্প কিছু চিন্হিত দালাল ছাড়া। সুতরাং বোঝাই যায় পরিস্থিতি। সেসময় বিরোধী দল ছিল না। তবে দুটো দল ছিল।

বঙ্গবন্ধু বনাম সরকারি দল। কারও কোন ধৈর্য নাই। সবাই এক রাতের মধ্যে কোটিপতি হতে চায়। যে কর্মী একসময় পার্টির পায় পয়সার হিসেবে রেখেছে। ১০ টাকা হারিয়ে ফেললে নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে পূরণ করে দিয়েছে।

এখন তার হাত দিয়ে পাঠানো রিলিফ, বিতরণের বদলে স্রেফ বিক্রি করে দেয়। তার জিম্মায় দিয়ে পাঠানো শ্রমিকের বেতন, বিতরণের বদলে বাড়ি নিয়ে চলে যায়। মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছেলেটা মাতাল। অন্য কারও ক্ষতি না করতে পারলে বাড়ি ফিরে বাবার জিনিসপত্র ভাঙ্গে। গ্রাম থেকে আসা ভাতিজাটাও সবকিছু একবারে চায়, যা তার শহরে থাকে ভাইটা এতদিনে পেয়ে এসেছে।

অনেক দিনের ত্যাগী, সাম্যবাদী ছাত্রনেতাটি যেন সবচেয়ে বড় বুর্জোয়া। নিচে নিচে হয়ে উঠেছে ভয়ানক প্রতিক্রিয়াশীল। মনে মনে ভয়ানক লুটেরা। সবখানে সুযোগ খোঁজে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাটি এক বছরে কেমন বদলে গেল।

বেশিরভাগ শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সরকারি পদ চায়। কাজ করার পদ না। ক্ষমতা দেখানোর আয় পয়সা কামানোর পদ। ৩০ বছর বয়সে মন্ত্রী হতে চায়। না হলে অন্তত প্রতিমন্ত্রী।

অন্তত কোন বোর্ডের চেয়ারম্যান যেন করা হয়ই। না হলেই ষড়যন্ত্র। প্রত্যাশার একমাত্র কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু। তিনি লুট করতে না দিলেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ভাবটা এমন -যে বাপ নিজের ছেলের কথা ভাবে না, সে না থাকাই ভাল।

চারদিকে প্রায় সবাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কাউকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। বহুদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী হঠাৎ হঠাৎ অচেনা আচরণ করে। তখন তাকে যেন চেনা যায়না। সময়টা যেন - একদল আততায়ীর সাথে বসবাস।

সশস্ত্র বাহিনী যেন সরকারের বিরোধী দল। মুহূর্তে মুহূর্তে ক্যু। এ ওকে মেরে ফেলে। সে তাকে বন্দি করে। পেশাদারিত্বের নাম মাত্র নাই।

লুটেরা রাজনৈতিক দলের মতই বিশৃঙ্খল। আমলারা আগে যেমন লুটেরা ছিল। পরে তেমনই থেকেছে। আগে পরাধীনতার নিয়ন্ত্রণ ছিল। পরে স্বাধীনভাবে লুট শুরু করেছে।

পুলিশ বাহিনী সবসময় সরকারে পক্ষে; সে সময়ও ছিল। কিন্তু সেটা যেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে না। অপরাধীকে ধরে আনতে পাঠালে তারা যেত। অপরাধীর সাথে ভোজন শেষ করে এসে বলতো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর ষড়যন্ত্রকারীরা আজীবন সংঘবদ্ধ।

তাদের সাথে যৌক্তিক কারণেই যুক্ত হয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধী দালাল, আর বিদেশি শক্তি। তার চতুর, মিষ্টভাষী, শুভাকাঙ্ক্ষীর ভূমিকায় সফল অভিনেতা। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মানুষদের কৌশলে তারা ব্যাবহার করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু কখনো এক কাজ পর পর ৫ জন বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে প্রায় এক রকম ফলই পেয়েছেন। ব্যর্থতা।

বিশ্বাসঘাতকতা, বেদনা, হতাশা। এক কাজে দশজন লোক পাঠিয়েও ফলাফল একই। সেই ঠগ বাছতে যে লোক পাঠানো হতো তারাও ঠগের দলে। প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা লুটেরাদের চাপে একপেশে। লুটেরাদের রঙ্গমঞ্চে লাঞ্ছিত হয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে।

তারাও ভালবাসার অধিকার নিয়ে জোর করে এগিয়ে আসেনি। সেখানেও - তারা এবং বঙ্গবন্ধু - একা, অসহায়, রিক্ত। সেময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে অসহায় মানুষ। বেশিরভাগ সময় কাটাতেন হতাশার বেদনায়। বিশ্বাসঘাতকের বিষের যন্ত্রণায়।

তার বেদনা যদি কথা বলত, হাজার রাতের পালা হতো। যদি লেখা যেত, কয়েকশো মহাকাব্য হতো। *লেখাটি পুরনো। ছাত্রলীগের ছোটভাইদের জন্য লিখেছিলাম। আজ কুমারখালি উপজেলা আওয়ামীলীগ এর অস্থির সম্মেলনের পরে অনেকে অনেক প্রশ্ন করলো।

তাই এই লেখাটি রিপোস্ট দিলাম। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।