ক্যাম্পাসে ঢুকেই নজরে পড়ে, একটা পোষ্টার। লেখা-“প্রগতিহীন হেফাজতের ১৩ দফা মানি না”। কয়েকদিন পর প্রত্যেক বিভাগের সামনে পোষ্টারিং। পোষ্টারের নিচে স্ব স্ব বিভাগের নাম। তবে লক্ষ্যণীয়, সব বিভাগের প্রায় অধিকাংশ পোষ্টারই এক রকম।
সাধারণ ছাত্রীরা হয়ত পোষ্টারে বিভাগের নাম দেখে ভাবতে পারে যে, এটা বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে একই ধরণের পোষ্টার সব বিভাগ কি করে বানায়? সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, ক্যাম্পাসে যারা হেফাজতবিরোধী তথা ধর্ম নিয়ে অপপ্রচার চালাতে চায়, তাদের সংগঠনগুলো প্রত্যেক বিভাগে এমনটি করার নির্দেশনা দিয়েছে। এদিকে ৬ এপ্রিলের পর হেফাজতের বিরোধীতা করে যে মিছিলটি করা হয়েছিল, সেখানে ক্যামেরায় যে মেয়েটিকে আমি দেখেছিলাম সে আমাদেরই কলেজেরই এক রাজনৈতিক দলের নেত্রী। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়- এসব পোষ্টারে বিভাগের নাম শুধুই লোক দেখানো। আসল কাজ করছে কয়েকটি সমমনা দল।
‘প্রগতিশীল’ নাম দিয়ে আগামী ২৭ এপ্রিলের নারী সমাবেশকে সফল করতে কলকাঠি নাড়াচ্ছে এসব সংগঠনের নেত্রীরা। আবার ভিন্নভাবে বলতে এসব নেত্রীদের ব্যবহার করছে তাদের নেতারা। মজার ব্যাপার হলো, পোষ্টারগুলো এমনভাবে লেখা যে, এক নজরে যে কেউ তাদের পোষ্টারের কথাগুলোকে সমর্থন করবে তবে সচেতন মেয়েরা যদি পোষ্টারগুলো গভীরভাবে দেখে তাহলে বুঝবে, কিভাবে মাছি পড়া খোলা মিষ্টিকে লোভ দেখানোর জন্য তাদের সামনে রাখা হয়েছে। আমরাজানি, হঠাৎ করে এক অরাজনৈতিক সংগঠন- ‘হেফাজতে ইসলাম’ দেশের সংকট মুহুর্তে এক নতুন মোড় নিয়ে এসেছে। তারা ১৩ দফা দাবির বাস্তবায়ন চায়।
এদিকে ১৩ দফা নিয়ে বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকতেই পারে। তবে আমরা লক্ষ্য করছি হেফাজতের নামে এমন কিছু অপপ্রচার তথা জঘণ্য মিথ্যাচার বিশেষ করে নারী বিষয়ক নীতি নিয়ে এমন উদ্ভট প্রচারণা চালানো হচ্ছে যা আলেমরা বলেন নি, বুঝান নি এবং উল্লেখও করেন নি। তাই মনে হচ্ছে, এক কুচক্রি মহল হেফাজতের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য, বিতর্কিত করার জন্য নারীদের ইস্যুকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে ধরছে। যদিও আমরা জানি, আল্লাহ ও রাসূলের অবমাননা করার জন্য হেফাজতের নেতারা ফুসে উঠেছিলেন। যাদের সাথে যোগ দেয় দেশের সাধারণ মানুষ।
কিন্তু এখন দেখছি- সেই কুচক্রি মহল ১৩টা পয়েন্টের মধ্যে ১০ নং ও ৮নং পয়েন্টকে উপরে তুলে এনে যাচ্ছেতাই ভাবে বর্ণনা দিয়ে, অপপ্রচার চালিয়ে হেফাজতের পুরো আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে। আসলে সব কিছু যেন পরিকল্পিতই মনে হয়। আমরা জানি, ৬ এপ্রিলের সেই সমাবেশে একুশে টিভির নারী রিপোর্টারের উপর হেফাজতের কর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। এবং এরই রেশ ধরে হেফাজতে ইসলামকে ‘নারী বিদ্বেষী’ বলা হয়। যদিও একটা জিনিস লক্ষ্যণীয় যে, সেই সমাবেশে এতগুলো মিডিয়া থাকলেও নারী রিপোর্টার অপমানের কোনো ছবি আমরা দেখিনি।
বরং একটা ফুটেজ দেখালাম যেখানে সেই রিপোর্টারকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছে দুই হেফাজত কর্মী। তাহলে প্রশ্ন জাগে-কে দাড়ি টুপির আড়ালে সেই নারীকে লাঞ্ছিত করেছে? এরা কি তারা, যারা হেফাজতকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে। এদের কি এমনটিই প্লানিং ছিলো যে, তাদের প্রতিহত করতে পরবর্তীতে নারীদের এভাবে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করবে?
অপপ্রচারকারীরা, হেফাজতের ১৩ দফার ৮ দফায়-“ ......সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যাভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ......” যেখানে বন্ধের কথা বলা হয়েছে সেটাকে এই বলে প্রচার করছে যে- হেফাজতে ইসলাম এখন ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দিবে না, কর্মস্থলে যেতে দিবে না, তারা নারীদের গৃহবন্দি করে রাখতে চায়-ইত্যাদি। যদিও সত্য হলো হেফাজতের নেতারা কিন্তু এমন কিছু বুঝাতে চান নি। আর এসব কথা উনারা পত্রিকায়, বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।
এদিকে কো-এডুকেশনের তথা সহশিক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞাস করায় হেফাজতের এক নেতা টক শো’তে বলেন-‘তারা কো-এডুকেশন সমর্থন করেন না, তবে চলমান কো-এডুকেশনের বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো তারা ভাঙতে চান বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা সঠিক নয়’। অপরদিকে, আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে-দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু এমনিতেই নারী-পুরুষের বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যাভিচার, অবাধ মেলামেশা কিংবা বিয়ের আগে সম্পর্ক গড়ে ঘুরে বেড়ানোকে খারাপ চোখেই দেখে- সেক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলাম কিন্তু কোনো অদ্ভুত নয় বরং সাধারণ মানুষের চেপে থাকা কথাটাই যেন প্রকাশ করেছে। এদিকে ‘অবাধ বিচরণ’ নিয়ে একটু বলতে-এটা ঠিক, সহশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় হৈ-হুল্লোড় করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই সীমা-অতিক্রম হয়ে যায়। যেমনঃ সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নববর্ষের উৎসবে রং খেলায় দুই মেয়েকে ইচ্ছাকৃতভাবে রং দিয়ে লাঞ্চিত করা হয়। তাছাড়া সহশিক্ষার আরো কিছু বিতর্কিত বিষয় উল্লেখ করলে বলা যায়- কিছু ছেলে/মেয়েদের দেখা যায়- যারা ক্লাসের সহপাঠি মেয়ে/ছেলের সাথে অহেতুক কথা বলতে, একসাথে রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে, কিংবা নির্জন স্থানে গিয়ে কথা বলায় কোনো সমস্যা দেখে না, বরং এসব নিয়ে বলতে গেলে উল্টো শুনতে হয়-“আশ্চর্য! এখানে খারাপের কি হলো? সে তো আমার ফ্রেন্ড!” তাই যারা জানতে ও বুঝতে চায়- তাদের উদ্দ্যেশে বলতে- মাহরাম (বিয়ের যাদের সাথে নিষিদ্ধ) ছেলে/মেয়ে ব্যতিত অন্য কোনো ছেলে বা মেয়ে সাথে অবাধ মেলামেশা সম্পূর্ণ অনৈতিক।
ইসলামের বিধান হলো- ‘প্রয়োজন ব্যতিরেকে অন্য কোনো পুরুষের সাথে কথা বলবে না’। একই বিধান ছেলেদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুতরাং প্রয়োজন ছাড়া আপনি কেনো কথা বলতে যাবেন? আপনি হয়ত বন্ধু-বান্ধবী বলে সবকিছুকে জায়েজ করে নিতে চান-তবে আমরা কি ভুলে গেছি সেই হাদিস যাতে স্পষ্ট বলা আছে-‘অবিবাহিতএকটা ছেলে-মেয়ে যখন নির্জন স্থানে একত্রে মিলিত হয় তখন সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে শয়তান প্রবেশ করে’। আপনি হয়ত অনেক ভালো , তবে শয়তান আপনার হাত দিয়ে কি করিয়ে নিবে, তা আমরা নিজেও বুঝতে পারবো না। আর পরবর্তীতে নিজের স্বার্থে কাউকে সাক্ষীও পাওয়া যাবে না।
এবার বলুন- ইসলাম প্রগতিশীল নাকি তারা- যারা প্রগতির কথা বলে আমাদের জীবনটাকে অন্ধকারে ঠেলতে চায়? এ ব্যাপারে আরো একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই-যেহেতু এই বিষয় নিয়ে অনেক অপপ্রচার চলছে। এটা ঠিক প্রাকৃতিক নিয়মে বিপরীত লিংগের প্রতি মানুষের আকর্ষন থাকে। আর কো-এডুকেশনের ক্ষেত্রে ভদ্র ছেলেমেয়েরা তাই একসাথে পড়তে গিয়ে কিছু ব্যক্তিগত বাঁধা-নিষেধ মেনে চলে সঠিকভাবে পড়াশুনা করে। এর বিপরীতে যারা অভদ্র তারা কো-এডুকেশনে যেন অবাধ মেলামেশা ও অনৈতিক কাজে মেতে উঠার সুযোগ পেয়ে বসে। তাই বলতে- হেফাজতের নেতারা যেখানে ছেলেমেয়েদের নৈতিকতা হেফাজতের কথা বলছেন, তাদের অবাধ মেলামেশা থেকে দূরে থাকার কথা বলছেন, অনৈতিক সম্পর্ক গড়া থেকে নিরাপদে থাকার কথা বলছেন ও তেমনই ব্যবস্থা করতে বলছেন- তাহলে এখানে সমসায় কোথায়?
অনেক সময় কথাচ্ছলে আমরা বলি- “কোথাকার কথা কোথায় গিয়ে লাগাচ্ছো”? আজ বাস্তবে দেখছি তেমনটি হচ্ছে।
অবাধ বিচরণ বন্ধের প্রস্তাবকে অপপ্রচারকারীরা নারীদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে গৃহবন্দির সাথে তুলনা করছে। স্লোগান দেয়া হচ্ছে “ নারী যদি ঘরে রয়, জাতির জন্য অন্ধকারময় ”–যদিও সত্য হলো, হেফাজতে ইসলাম নারীদের গৃহবন্দির কথা বলেনি, বরং ধর্মীয় শালীনতা বজায় রেখে তারা নারীদের যেকোনো কাজে অংশগ্রহণের পক্ষে। এখানে লক্ষণীয় তারা কিন্তু নারীদের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার কথা বলছে না, বরং তারা বক্তৃতা গিয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তবে এখানে কেউ যদি উগ্রভাবে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়- তাহলে আমি বলবো হেফাজতে ইসলাম নয় বরং ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না, নারী জেনে বুঝে উপলব্ধি করে ভালো পথ গ্রহণ করুক, বরং তারা চায়- নারীরা যাতে তাদের অপপ্রচারের গোলাম হয়ে থাকুক। আজ তারা একটা নারীর গৃহে অবস্থানকে খাটো করে দেখছে। একটা গৃহিনীকে ‘গৃহবন্দি’র সাথে তুলনা করছে।
মাতৃত্বের অধিকারকে নির্মূল করার চেষ্টা করছে। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, প্রাকৃতিকভাবেই সমাজে কিছু জায়গায় নারীদের দায়িত্ব বেশি আর কিছু জায়গায় পুরুষের দ্বায়িত্ব বেশি। আর এই প্রাকৃতিক নিয়মকে অনেকে প্রতিবন্ধকতার চোখে দেখেন বলেই তারা নর-নারীর উপর এমন কিছু চাপিয়ে দিতে চান, যা উভয়ের জন্যই কষ্টকর হয়ে উঠে। আল্লাহ পুরুষকে তার পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দিয়েছেন আর নারীকে এ দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এদিকে পুরুষের উপার্জনে তার পরিবারের অধিকার আছে অথচ নারী যদি উপার্জন করে তবে তাতে অধিকার স্বয়ং তার নিজের।
সে ইচ্ছা করলে তবেই সেটা অন্য কেউ ভোগ করতে পারে। তবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মেয়েদের কে বাইরে যেন বের হতে বাধ্য করা হচ্ছে। মেয়েদের চাকরির প্রসঙ্গটা মুখ্য করা হচ্ছে। যে দায়িত্ব থেকে সয়ং আল্লাহ তাকে মুক্ত রেখেছেন। তাকে সেই দিকে বাধ্য করা হচ্ছে।
নারীর সাংসারিক কাজরে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। গৃহিনীদের ছোট করে দেখছে। প্রশ্ন হলো-কেনো এমন পক্ষপাত? আমরা কখনোই বলছি না, ঘর সামলানো শুধু নারীড় একার দায়িত্ব, বরং বুখারি হাদিস হতে আমরা জানি, নবী সাঃ ঘরে অবস্থান করলে স্ত্রীদের কাজে সহায়তা করতেন। সুতরাং, ইসলামে পারষ্পরিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া হয় নি।
এখন আমরা না মানলে সেটা আমাদের সমস্যা। কিন্তু আজ স্লোগান দেখে মনে হচ্ছে তারা নারীদের ঘর থেকে বের হতে বাধ্য করছে। যারা আজ এই প্রচারণায় লিপ্ত- তাদের আমি জিজ্ঞাস করতে চাই- ঘর গুছিয়ে রাখা কি অন্ধকারময়? পরিবারের জন্য রান্না করা কি অন্ধকারময়? স্বামীর অনুপস্থিতিতে বাড়ীর কর্ণধার হিসাবে দায়িত্ব পালন করা কি অন্ধকারময়? বরং আমরা দেখতে পারছি- একজন ‘সফল গৃহকর্ত্রীর ক্রেডিট থেকে নারী সমাজকে বাধ্য করে দূরে ঠেলে ফেলা হচ্ছে। এদিকে জরিপ করে দেখা যায়- অধিকাংশ মহিলারা যারা ঘরের বাইরে চাকরি করছেন তাদের কিন্তু একসাথে দুই দিক সামলাতে হচ্ছে। সংসার এবং বাহির।
আর এক্ষেত্রে অনেককেই দেখা যায়-দুই দিক ঠিকভাবে কর্তব্য পালন করতে সমস্যা হচ্ছে আর পারিবারিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকছে। ফলে সেই মহিলা নির্বিগ্নে কাজ করতে পারছে না। ভুগছে বিসন্নতায়। বরং তাকে কিন্তু এটা মেনেই চাকরি জীবনে ঢুকতে হচ্ছে যে,এখন থেকে আমাকে দুই দিক সামলাতে হবে। এক্ষেত্রে একটা নারী যদি সন্তুষ্ট থাকে তাহলে কোনো সমস্যা নেই।
এদিকে কোনো নারীই তার ঘরের দায়িত্বকে অস্বীকার করে না। বরং সে চায় সংসারে তার কর্তৃত্ব থাকুক। সে নিজেকে ‘হাউজ ওয়াইফ’ নয় বরং ‘হোম ম্যানেজার’ হিসাবে ভাবতে বেশি পছন্দ করে। এদিকে অধিকাংশ নারীদের – ‘জব কেনো করছো? জিজ্ঞাস করলে, বলে- ‘সামান্য কিছুর জন্য স্বামীর কাছে হাত পাততে ভালো লাগে না। আর অযথা ঝগড়া-ঝাটির কি দরকার? তাই এর চেয়ে ভালো জব করা।
এটা আমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’। তবে এখানে একটা জিনিস ভেবে দেখার মত যে, সে তাঁর হাত খরচের জন্য জব করছে, সেই হাত খরচের টাকা যদি তাঁর কাছে থাকতো তাহলে সে জবটি করতো না। সেই উদ্দ্যেশে বলতে- একটা মেয়ে যদি বিয়ের পর তার বাবার দিক থেকে, স্বামীর দিক থেকে উত্তরাধিকার পেয়ে যায় (ইসলাম বিবাহিত নারীকে উভয় সিক থেকে সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে)- তাহলে কি সে সেই সম্পদকে বিভিন্ন খাতে কাজে লাগিয়ে, ব্যবসা করে নিজের বাড়তি প্রয়োজন মেটাতে পারতো না? হ্যা, পারতো। কিন্তু এমন সিস্টেম আমাদের সমাজে নেই। আর এই সিস্টেম যাতে না প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর জন্য হেফাজতের ১০ নং দফার বিরোধীতা করা হচ্ছে।
হেফাজতের নেতারা ইসলাম অনুযায়ী নারীনীতি প্রণয়নের কথা বলছেন। যা বাস্তবায়ন হলে খুব সহজেই নারী তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু বড় আফসোসের বিষয়-কিছু বিধর্মী নামধারী মুসলমান আল্লাহ’র আইন বাস্তবায়ন তো দূরে থাক বরং সংবিধান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত করতে চাচ্ছে না। এদিকে নারীর চাকরির প্রসঙ্গ যখন এসেছেই তাহলে বলতেই হয়। সমাজে এমন অনেক নারীদের দেখি তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা স্বত্ত্বেও চাকরি করেন।
তাদের যুক্তি হলো- “ পড়াশোনা করেছি, জব করবো না”? তবে তাদেরই ঘরে দেখা যায়- তার নিজ সন্তান বাইরে টিউটরের কাছে গিয়ে পড়ে। আমি সেই সব মা’দের বলতে চাই- আপনি আপনার বিদ্যার কথা বলে, সেটা প্রয়োগের কথা বলে বাইরে জব করছেন, অথচ আপনার সন্তানকে পড়াতে, তার দিকে আপনার জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে আপনার সমসায় কোথায়? আপনি কি সন্তানের শিক্ষক হওয়ার ক্রেডিট নিতে চান না? এদিকে এমনও অনেক মেয়েদের দেখি যারা- ক্যারিয়ার বলতে শুধু টাকা উপার্জন করা মনে করেন। যদিও ক্যারিয়ার মানে নিজের জীবনকে সুন্দর এক উদ্দেশ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। নিজের মূল্যবোধকে বিকশিত করা। আর আমি মনে করি যাদের পরিবার স্বচ্ছল সে সব ঘরের মহিলারা পরিবারের পুরুষের তুলনায় সামাজিক উন্নয়নমূলক ও দাতব্য কাজে বেশি অবদান রাখতে পারেন।
আমাদের সমাজে অনেক অহেতুক অনাচার, অন্যায়, কুসংস্কৃতি, কুসংস্কার রয়েছে- সেই সব দূর করে এক মহিলা সংগঠন গড়ে সামাজিক অবিচারকে দূর করার কাজে অবদান রাখতে পারেন। ঘরের দায়িত্বগুলো পালন করে অবসর সময়ে শুধু টিভি না দেখে এ সমাজকে নিয়ে ভাবা উচিত। একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। চিন্তা করলে কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে- একটা ভালো পরিবার, একটা ভালো সমাজ থেকেই কিন্তু একটা ভালো মানুষের জন্ম হয়। আমরা কি পারি না সমাজে তেমন সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে।
আমাদের মহিলারা যেহেতু আর্থিক দায়িত্বমুক্ত, তবে কি আমরা আমাদের অবসর সময়কে সেই দিকে ইনভেস্ট করতে পারি না? এবার কর্মজীবী নারী যারা একান্তই বাধ্য হয়ে পরিবারের অর্থিক করূণ অবস্থায় চাকরি করতে বাধ্য হয়- তাদের স্বার্থে বলতে হয়- তারা যে এত কষ্ট করে উপার্জন করে সংসারে খরচ করে কয়টা পরিবার তাদের সেই বাড়তি খাটুনির মূল্যায়ন করে? কয়টা স্বামী তার স্ত্রীর এই বাড়তি শ্রম যেটা সে পরিবারের জন্য বাধ্য হয়ে করছে-সেই কাজের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে? বরঞ্চ কিছু স্বামীদের ৫০%-৫০% নীতির কথা বলতে শুনা যায়। তারা স্ত্রীদের বলেই দেন সংসার যেহেতু তোমার আমার- তাই অর্ধেক খরচ তুমি তোমার চাকরির টাকা দিয়ে দাও আর বাকিটা আমি চালিয়ে নেবো। কিন্তু একটা স্বামীর এটা বুঝা উচিত, যে সে কিন্তু তার স্ত্রীর উপর বাড়তি চাপ দিচ্ছে। যারা ৫০% নীতি নিয়ে চলছেন তাদেরকে বলতে চাই-তারা কি সংসারিক কাজে ৫০% নীতি মেনে নেবেন? স্ত্রী সকালের নাস্তা বানালে, দুপুরের খাবারটা না হয় স্বামী রান্না করুক। স্ত্রী ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে মুঝে দিলে কাপড় ধোয়াটা না হয় স্বামী করুক।
কি ৫০%- ৫০% হলো? এবার অনেকে স্বামীই কিন্তু নারীর পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে কথা বলবেন। আসলে এভাবে সংসার চলে না। আর ইসলামও তেমন ৫০% নীতি নিয়ে আসেনি। ইসলাম কোনো ক্ষেত্রে নারীকে মর্যাদা ও দায়িত্ব বেশি দিয়েছে কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে বেশি দিয়েছে। একটা নারীকে সন্তান জন্মের মর্যাদা দিয়ে তার পায়ের নিচে যেমন জান্নাত ঘোষণা করা হয়েছে, তেমনি পরিবারের সদস্যদের এক লোকমা খাবার মুখে দেয়াটাকে পরিবারের কর্তা তথা উপার্জনকারী পুরুষের জন্য সাদকা স্বরূপ ঘোষণা করা হয়েছে।
সুতরাং এই পার্থক্যটি যেসব তথাকথিত আধুনিকমনা ও ইসলামবিরোধী প্রচারকরা বুঝবেন না বা বুঝতে চাইবেন না, তারা রীতিমত বিশৃংখলতার শিকার হবেন।
এদিকে সূরা নিসার ১১নং আয়াত (“ ………………….ছেলের অংশ দুইজন মেয়ের সমান………………., আর যদি একটি মেয়ে ওয়ারিশ হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক তার। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে, তাহলে তার বাবা-মা প্রত্যেকে ছয় ভাগের একভাগ পাবে। আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং বাবা-মা তার ওয়ারিশ হয়, তাহলে মাকে তিন ভাগের এক ভাগ দিতে হবে। যদি মৃতের ভাইবোনও থাকে, তাহলে মা ছয় ভাগের একভাগ পাবে।
…………………”) পড়ে অনেকেই বলেন – “নারী পুরুষের অর্ধেক পাবে কেনো? ক্ষেত্র বিশেষে নারীকে ছয় ভাগের বা আট ভাগের মাত্র একভাগ কেনো দেয়া হবে? কেনো সমান সমান দেয়া হবে না। তাহলে তো সংবিধানের নারীনীতির ২৩.৫ এ যেখানে সম্পদে সম-অধিকার লেখা আছে– তাহলে তো সেটাই সঠিক!” এ বিষয়ে বলতে আমি আগেই উল্লেখ করেছি, নারী পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে গুরুত্বারোপের কথা। পুরুষদের উপার্জনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলেই স্বাভাবিকভাবে তাকে সম্পত্তির অংশ বেশি দেয়া হয়েছে। এটাই সহজ কথা। এদিকে আইনমন্ত্রী একবার এমনও বলেছিলেন- “ পুত্র সন্তানের অবর্তমানে পিতার সমস্ত সম্পতির অধিকার কন্যা সন্তানের”- এটাও কু'রআন তথা মানবতা বিরোধী।
কু’রআনের আইন নিয়ে যাদের মধ্যে সমস্যা তাদের জানা উচিত, কু’রআনে শুধু একপক্ষ বিবেচনা করে আদেশ দেয়া হয় নি বরং পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, এতিম- সর্বোপরি পুরো সমাজ-ব্যবস্থার কল্যাণে সম্পদ বন্টনের আদেশ দেয়া হয়েছে। পুত্র না থাকলে সম্পত্তির অর্ধেক মেয়ে নিজে রেখে বাকিটা কুরআনের আইনমাফিক জ্ঞাতি ভাইদের দিয়ে দিবে। একজন বিবেকবান ব্যক্তি হিসাবে আমরা কি চাইবো- আমাদের জ্ঞাতি ভাইরা বঞ্চিত হোক বা অসহায় থাকুক? অন্যের কাছে হাত পাতুক? আমরা কি নিজে আরামে থেকে তাদের রাস্তায় ঠেলে দিতে পারি? যদিও আমাদের পিতার সম্পত্তিতে তাদের অধিকার আছে? অর্ধেক সম্পত্তি একটা মেয়ে পেয়ে বাকি অর্ধেক তার জ্ঞাতি ভাইদের দিতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা কি আমাদের মন-মানসিকতায়? আজকে যারা কুরআনের আইনের বিরোধীতা করেছেন তারা এদিকটা ভেবে দেখেছেন কি? এদিকে, অনুমোদিত নারীনীতির ২২.৩ অনুচ্ছেদে ‘সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নারীদের বর্ধিত অংশগ্রহণের’ কথা উল্লেখ আছে। আমি বলতে চাই-তারা আর কত বর্ধিত অংশগ্রহণ করাতে চায়? আর বর্ধিত মানে তো বুঝাই যাচ্ছে ছেলেদের চেয়ে বেশি। এমনিতেই, দিন দিন সংস্কৃতির মধ্যে অপসংকৃতির প্রভাব , অন্ধ অনুকরণ, সেটাকে আপন করে তোলা আর মহিলাদের নিয়ে এসব খাতে ব্যবসা করা, -এসব আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
নারীজাতির সম্মান নিয়ে যেন খেলাধুলা চলছে। নির্লজ্জভাবে পুরুষদের সামনে নারীদের উপস্থাপন করা হচ্ছে। তাই এই ধারা দিয়ে কি সরকার আরো বেশি করে নারীদের এসব করাতে চায়?
অনেক নারীরাই বলেন-“ নারীনীতি নিয়ে পুরুষরা এত কথা বলে কেনো? তারা কি আমাদের উন্নয়ন চায় না”? এটা ঠিক, নারীনীতি নিয়ে নারীদেরই বলা উচিত যদিও অবাক লাগে যখন দেখি খোদ নারীই জানে না ইসলাম ধর্ম তাকে কি মর্যাদা দিয়েছে আর এই সমাজ কোন পথে চলছে। আর দেখা যাচ্ছে নারীদের এই অজ্ঞতার সুযোগই উঠাচ্ছে কিছু সুবিধাবাদী অপপ্রচারকারী মহল। যারা নারীদের নিয়ে, শুধু ব্যবসায় করছে।
কখনো তার সৌন্দর্য নিয়ে , কখনো তার সম্মান নিয়ে। আর এসব করে তারা নারীদের মনটাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। বরং আমি মনে করি, আজ নারী জাতি যদি সত্যি তার প্রকৃত অধিকার, সম্মান, মর্যাদার ব্যাপারে জানতো , তবে তাদের হয়ে আজ সচেতন পুরুষদের নয় বরং নিজেরাই আন্দোলন করতো। প্রসঙ্গ সাপেক্ষে এটা বললে ভুল হবে না যে, নারীদের নিয়ে এত অপপ্রচার চলছে, টাকার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে, নারী শ্রমিকদের বাধ্যকরা হচ্ছে ২৭ এপ্রিলের নারী সমাবেশকে সফল করার জন্য অথচ আমরা কোনো আদর্শভিত্তিক নারীদের আন্দোলন করতে, সাধারণ একটা মানব-বন্ধন কিংবা সংবাদ সম্মেলন করে সমাজের সাধারণ নারীদের জাগিয়ে তুলতে দেখছে না। পরিশেষে, আজ যারা নারী জাতিকে বিভ্রান্ত করছে, তাদের মনভুলানো গল্পকাহিনী, গুজব রটাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই-কোনো আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ সম্মেলন কখনো মিথ্যার উপর সফল হতে পারে না।
আর মহান আল্লাহ তো বলেছেন- “ এমন কিছু লোকও আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্যে মনভুলানো কথা ক্রয় করে আনে……… এমন লোকদের জন্যে অপমানকর শাস্তি রয়েছে” (সূরা লুকমানঃ আয়াত-৬)। আছি সেই শাস্তির অপেক্ষায়...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।